Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

এই নির্বাচন কি মেনে নেওয়া যায়?

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এই নির্বাচন কি মেনে নেওয়া যায়?

ফাইল ছবি

কেমন হলো ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। এ উপনির্বাচনে কয়েকজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছিলেন। তবে এদের মধ্যে দুজন মিডিয়ার আলোচনায় ছিল। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে দেশবাসী চিনত টিভি টকশোতে তার অংশগ্রহণের জন্য। পেশাগতভাবে তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। যতদূর জানি তিনি ব্যবসায় বিষয় পড়ান। তার গুরুত্ব শাসক মহলে বৃদ্ধি পায় সুচিন্তা ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হওয়ার ফলে। সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রচেষ্টায়। মোহাম্মদ এ আরাফাত অনন্য গুণের অধিকারী।

এ অনন্য গুণটি হচ্ছে, যা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য বা যুক্তিসংগত নয়-এমন বিষয়গুলোকেই ভাষার মারপ্যাঁচে এবং গবেষণা পদ্ধতিকে কু-যুক্তিতে পরিণত করে দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান করতে পারা। মোহাম্মদ এ আরাফাত দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। অবশেষে তিনি তার নিষ্ঠার জন্য পুরস্কৃত হলেন ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা অর্জন করে।

অন্যদিকে হিরো আলমের আসল নাম আশরাফুল আলম সাঈদ। একটি সাধারণ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। হিরো আলম তার নিজের যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে সারা দেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসেন। তিনি একাধারে চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, গানের জগৎ ও মডেলিংয়ে কাজ করেছেন, বই লিখেছেন, ব্যবসা করেছেন, রাজনীতি ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজেও আত্মনিয়োগ করেছেন। হিরো আলম যতগুণে গুণান্বিত হন না কেন, আমাদের দেশের এলিট সমাজের কাছে তিনি হাস্য কৌতুকের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু নয়। বাংলাদেশের সমাজ ততটা গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেনি যাতে একজন নিম্নবর্গের মানুষ উচ্চবর্গের কাছে হেলাফেলার বিষয় হবে না। উচ্চবর্গের মন মানসিকতা হিরো আলমের পেছনে লেগেছে কায়াহীন মূর্তির মতো। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে বগুড়া ৬ (সদর) ও বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে হিরো আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে দুটি আসনেরই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। উপনির্বাচনে তিনি উভয় আসনে পরাজিত হলেও বগুড়া-৪ আসনের বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধান ছিল ৮৩৪।

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট দিতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা সকাল থেকেই বেশ কম ছিল। কোনো কোনো কেন্দ্রে দেড় ঘণ্টায় ১টি ভোটও পড়েনি। কিন্তু ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকদের জটলা ছিল। ভোটে জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। ভোট পড়ার হার ১১.৫১ শতাংশ। আন্দাজ করা যায় এত ভোটও পড়েনি। অভিযোগ আছে কিছু কিছু কেন্দ্রে অনৈতিকভাবে ব্যালট পেপারে সিল মারা হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা মানুষকে ভোটবিমুখ করে তুলেছে। ভোটাররা জানে তারা ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তাদের ভোট কেউ না কেউ দিয়ে দেবে। ভোটের প্রতি মানুষের অনীহার একটি বড় কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির মূল স্রোতের অন্যতম ধারা বিএনপির ভোটে অংশগ্রহণ না করা। ফলে নির্বাচনগুলো সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না। নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তাতে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য তাড়িত হয়। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে। প্রহসনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ঘোরতর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া বলে মনে করে প্রধান বিরোধী দল। প্রহসনের নির্বাচন যাতে না হতে পারে তার জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। অনেকে মনে করেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবশ্যক। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। বর্তমান সরকার যেভাবে প্রশাসনকে সাজিয়েছে তার মধ্যে নির্বাচন করলে অতীতের মতো ফল দাঁড়াবে শূন্য। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের প্রার্থীরা ভোটের দিন বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তারা জানতে পারলেন ভোটের আগের রাতে শাসক দলের পক্ষে সিল মেরে ভোটের বাক্সগুলো ঠাসা হয়েছে। এ গল্প জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে চাউর হয়ে গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এভাবে ভেঙে পড়ার ফলে গণতন্ত্র দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের জনগণ কতটুকু অধিকার ভোগ করে? পাঁচ বছর পরপর ভোট দিতে পারা এই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। জনগণ যখন দেখে তাদের ভোট অন্য কেউ দিয়ে ফেলেছে, তখন তাদের হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। যখন একটি দেশে সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার থাকে না, তখন সেদেশে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাও থাকে না। দেশ জঞ্জালে আকীর্ণ হয়। শাসকগোষ্ঠী স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে এবং তাদের মর্জিমতো দেশ চালায়। এই অবস্থা যদি অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে থাকে, তাহলে দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্রেও পরিণত হতে পারে, যা কেউ কামনা করে না।

ঢাকা-১৭ আসনটি গুলশান ও বনানীজুড়ে। ঢাকার সম্পদশালী ধনীরা এ এলাকার বাসিন্দা। তবে এখানেও অনেক মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ বাস করে। বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে অথবা তস্করবৃত্তির মাধ্যমে ধনাঢ্য হয়েছে, তারা কেবল নিজের কথাই ভাবে, দেশের কথা ভাবে না। এই শ্রেণির মানুষগুলো যদি দেশ কীভাবে চলছে তা নিয়ে ভাবত, উদ্বিগ্ন হতো তাহলে সরকার এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারত না। তত্ত্ব থেকে আমরা জানি, দেশের ধনাঢ্য গোষ্ঠী সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হলে অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে বড় ব্যবসায়ী ও ধনীরা সরকারের বেশুমার অন্যায়-অপকর্ম দেখেও দেখছে না বলে ভাব করে। বড় ব্যবসায়ীরা সেমিনার করে এখানে সরকারের হাত শক্তিশালী করার কাজে রত আছে। অথচ এ ব্যবসায়ীদের জানা ও বোঝার কথা এই যে, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ও অধঃপতিত ব্যবস্থা শেষ বিচারে তাদেরও স্বার্থের অনুকূলে যেতে পারে না। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে বনানীর একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে হিরো আলমকে মারধর করেন নৌকা প্রতীকের বেশধারী কিছু যুবক। মারধরের পর হিরো আলমকে ধাওয়া দিয়ে এলাকাছাড়া করে হামলাকারীরা। ঘটনাস্থলের আশপাশে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য উপস্থিত থাকলেও তারা ছিলেন ‘দর্শকের’ ভূমিকায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিরো আলম তাকে বাঁচানোর জন্য আনসারদের এগিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু অজানা কারণে আনসাররা এ স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিরাপত্তা বিধান করতে এগিয়ে আসেনি। এ কথা অনেকটাই জানা ছিল যে, যত কমসংখ্যক ভোট পড়ুক না কেন, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাতই জয়ী হবেন। এ অবস্থায় ভোটগ্রহণ যখন সমাপ্তির পথে, তখন হিরো আলমকে মারধর করায় কার কী লাভ হয়েছে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। যারা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সহ্য করতে চায় না, তারা আর যাই হোক দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। তারা কোনো বিচারেই গণতান্ত্রিক নয়।

গত সোমবার অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোটারদের অনাগ্রহকে দূরে সরিয়ে শেষ পর্যন্ত আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াল হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনাটি। এমন সময় এ হামলার ঘটনাটি ঘটল, যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর করছে। তারা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (এ বছর ডিসেম্বরের শেষে বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে হওয়ার কথা রয়েছে।) পরিবেশ এবং নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য এসেছেন। তারা ঢাকায় অবস্থান করে ঢাকায় সংঘটিত দুর্বৃত্তপনার যে আস্ফালন দেখলেন, তাতে তারা সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতিকে কীভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন? ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে হিরো আলমের ওপর হামলার আগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী তারেকুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অসহযোগিতার অভিযোগ এনেছেন তিনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস আগে অনুষ্ঠিত এ উপনির্বাচনে ভোট হয়েছে কাগজের ব্যালটে। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। এর মধ্যে জাল ভোটসহ ভোট পড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। সাংবাদিকরা কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখেছেন, প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরেই নৌকার বেশধারীদের জটলা ছিল দিনভর। অধিকাংশ কেন্দ্রেই ভোটারদের কোনো লাইন ছিল না। ভোটগ্রহণের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা অলস সময় কাটিয়েছেন। নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল নগণ্যসংখ্যক।

সোমবার রাত ৯টার দিকে রিটার্নিং অফিসার এ উপনির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট। সংবাদপত্রের সূত্রে জানা যায়, নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে কেন্দ্রে ভোট দেন, ওই কেন্দ্রে সকাল ৯টা পর্যন্ত ভোটের হার ছিল ০.৬১ শতাংশ। দুপুর পৌনে ১২টায় তা দাঁড়ায় ৩ শতাংশে। বেলা ২টার পর নৌকা প্রতীকের বেশধারীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এরপর বেলা সোয়া ৩টায় দেখা যায় সেখানে ভোটগ্রহণের হার ১০ শতাংশ হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পরিবেশ প্রত্যক্ষ করার জন্য যে টিম ঢাকায় অবস্থান করছে, তাদের জানা হয়ে গেল বাংলাদেশে ভোটের পরিবেশ কেমন। যে উপনির্বাচন সরকারের অস্তিত্বকে সামান্যতম বিঘ্নিত করে না, সেই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ যা করল, তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মনে হচ্ছে নির্বাচনি প্রতিষ্ঠানকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে বাংলাদেশে প্রকারান্তরে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম