হেফাজতে মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে?
একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে এলেও থেমে নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে অপমৃত্যুর ঘটনা। বরং দিন দিন হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা যেন বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগে থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে আসছিল। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই এ সংখ্যা কমতে শুরু করে। মেজর সিনহা হত্যার পর প্রায় পাঁচ মাস বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ছিল। এ ঘটনার পর ওই বছর একটি মাত্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২ আগস্ট। অথচ মেজর সিনহার মৃত্যুর আগে ওই বছরেই প্রথম সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১৮৪ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। সবারই জানা আছে, মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে তখন দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত সামরিক কর্মকর্তাদের ভেতর তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। সাধারণ মানুষের ভেতরও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে সরকারেরও টনক নড়ে ওঠে। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে হত্যাকাণ্ডের আইনি প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে সহযোগিতা করে। বিচারে আদালত পুলিশের বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর ৬ পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। দেশব্যাপী সাড়া জাগানো সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে আসে।
তবে, এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর। ২০২১ সালে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর ২০২২ সালে এক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন মাত্র তিনজন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ১৬ জন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগে ২০২১ সালে ৫১ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে, অপরদিকে হেফাজতে মারা গেছেন ৩৯ জন। ২০২০ সালে হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২৪টি। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩ প্রণয়নের পর, গত ১০ বছরে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ৩৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারাগার হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়গুলো খুব বেশি আলোচনায় আসে না। আড়ালেই থেকে যায় অধিকাংশ সময়। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন। এদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ২৮ জন। বিচারাধীন ৩৭ জন। ২০২১ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৮১ জন। তাদের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত ২৯ জন। বিচারাধীন ৫২ জন। তারা পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা এখন অনেক বেশি। তাদের একটি অংশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে প্রেরণ করার পর মারা যান। এসব মৃত্যুর ঘটনা আসলে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনেরই ফল।’
হেফাজতে মৃত্যুর সর্বশেষ শিকার ঢাকার বাউনিয়ার আলাল উদ্দিন। ৬ জুন সকালে তুরাগের বাউনিয়ার একটি বাড়ি থেকে ফাতেমা আক্তার নামে এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বাসায় দারোয়ানের কাজ করতেন আলাল উদ্দিন। সেদিন রাতেই জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ডিবি কর্মকর্তারা আলালকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এরপর ১০ দিন কোনো খোঁজ পায়নি আলালের আত্মীয়রা। ডিবির হেফাজতে থাকাকালীন ১৬ জুন প্রথমে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরে সেখান থেকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পর আলাল মারা যান। স্বজনদের অভিযোগ, ডিবির নির্যাতনের কারণে আলাল মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে তিনি মারা যান। সুস্থ-সবল আলালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ডিবির হেফাজতে থাকাকালে কী এমন হলো যে, তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো? আলালের বড় ভাইয়ের অভিযোগ, ‘ওরা তার ভাইকে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে গেছে। পরে নির্যাতন করে তার পা ভেঙে দিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। নির্যাতনেই তার ভাইয়ের মৃত্যু ঘটেছে।’ হাসপাতালে স্বজনদের আলালের লাশ দেখতে দেয়নি পুলিশ। ডিবি বা পুলিশকে মানুষ এত আতঙ্কের চোখে দেখে যে, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পান না। স্বামীর মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আলালের স্ত্রী বলেছেন, ‘ওরা আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। কিছু বললে যদি আমার সন্তানদের ক্ষতি করে!’
আলালের স্ত্রীর এ বক্তব্য ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তিনি হয়তো আরও কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা হিসাবে সন্তানের মঙ্গলের জন্য চেপে গিয়েছেন। ইদানীং পুলিশ সদস্যদের হিন্দি সিনেমার পুলিশের মতোই আচরণ করতে দেখা যায়। হিন্দি সিনেমায় দেখেছি, ছেলেকে গ্রেফতার করতে এসে না পেয়ে বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের দেশেও একই স্টাইলে পুলিশ এ অন্যায় কাজটি করছে। ২০১৮ ও ২০২২ সালের দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালকে না পেয়ে তার ছেলে নাহিন মুজতাবা সোহানকে ধরে নিয়ে গেয়েছিল পুলিশ। সোহান রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল না। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও ছিল না। একই রকম ঘটনা ঘটেছিল ২০২২ সালেও। ৭ ডিসেম্বর রাত আড়াইটার সময় নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবির বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে ছোট ছেলে প্রীতমকে বাড়ি থেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। একজনের অপরাধে অন্যজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার এ কালচার পুলিশের ভেতর হিন্দি সিনেমা থেকেই এসেছে বলে অনেকে মনে করেন।
উপরের দুটি ঘটনার সঙ্গে হয়তো রাজনীতির গন্ধ থাকতে পারে। তারপরও এ কথা বলাই যায়, পুলিশের এরূপ বাড়াবাড়ি ও অনাকাঙ্ক্ষিত অন্যায় আচরণ সমাজের মানুষের ভেতর আতঙ্কেরও সৃষ্টি করে। ফলে পুলিশ ও নাগরিকদের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। কাজেই, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যতই জনবান্ধব পুলিশ গড়তে চান না কেন, বাহিনীর ভেতর যতদিন না শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে, ততদিন তা সম্ভব হবে না।
২০১৩ সালে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ করা হলেও হেফাজতে মৃত্যুর দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এ আইন যে খুব কার্যকর হয়েছে তেমন নয়। এ আইনের আওতায় দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অতীতে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় অপরাধীদের প্রতি ছাড় দেওয়ারও উদাহরণ আছে। আমার বিশ্বাস, পাঠকদের অনেকেরই মনে আছে, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রুবেল হোসেন ডিবি পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় মৃত্যুবরণ করেন। ২০০২ সালে ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। তখন ডিবি পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার আকরাম হোসেনসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। অপরাধীরা রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই আপিল করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, ২০১১ সালে ১৩ জন আসামিকেই খালাস দেন আদালত। এদিকে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে এ পর্যন্ত মাত্র একটি ঘটনার বিচার হয়েছে। গত ১০ বছরে এ আইনে আর কোনো শাস্তির নজির নেই।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি কিছু দুর্বলতাও রয়ে গেছে। এ আইন নিয়ে অতীতে অবশ্য অনেক চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। এখানে দু-একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। অন্যান্য আইনে যেমন ভুক্তভোগী নিজে অথবা তার পরিবারকে মামলা করতে হয়, এ আইনে সেই বিধানও শিথিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক আদালতে গিয়ে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করতে পারবেন। যদি অভিযোগকারীর বক্তব্যে আদালত সন্তুষ্ট হন, তাহলে এর ওপর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনে আরেকটি ভালো দিক হলো, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি অপরাধ করেননি। এমন একটি আইন থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করার পর ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তার পরিবারকে যে কত ভয়ভীতির অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে ধারণা করাও অসম্ভব। নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দায়ের করতে চাইলে প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের হয়রানি, হুমকি ও প্রতিশোধপরায়ণতার শিকার হতে হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেউ ঘাঁটাতে চায় না। তাছাড়া আমাদের দেশে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে কোনো স্বাধীন বা স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষও নেই। পুলিশই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের তদন্ত করে। অতীতে দেখা গেছে, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা অনেক কিছুই এড়িয়ে যান। এ কারণে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা তার পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পায়।
নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন বা মৃত্যু রোধ না হওয়ার পেছনে আরও কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। সন্দেহ নেই, সরকার একটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুরোধ আইন করেছে। কিন্তু করলে কী হবে; এ আইনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রয়োগ করতে দেখা যায় না। এ আইন যদি প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যখন কোনো আইনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি আইনটির অপব্যবহার করে, তখন সেখানে বাধা দেওয়ার নৈতিক অধিকার থাকে না। অতএব এ ধরনের আইনের সঠিক প্রয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ নির্ভর করে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না বলেই হেফাজতে মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকার হেফাজতে মৃত্যুর দায়ভারও এড়াতে পারে না।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কলাম লেখক