চেতনায় বুদ্বুদ
একজন সিরাজুল আলম খান
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সিরাজুল আলম খান এক ব্যতিক্রমী নাম। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমি থাকতাম সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে, আর তখনই তাকে প্রথম দেখি অত্যন্ত কাছে থেকে। তার আগে পত্রপত্রিকায় তার সম্পর্কে মাঝেমধ্যে কিছুটা জেনেছিলাম যে, তিনি একজন মেধাবী ছাত্রনেতা।
এখন যে তাদের তিনজনকে নিয়ে নিউক্লিয়াসের কথা শোনা যায়, তখন এটা তেমন বেশি চাউর ছিল না। আব্দুর রাজ্জাকের নাম ছাত্ররাজনীতিতে আলোচিত হলেও আমরা সবচেয়ে বেশি শুনতাম তোফায়েল আহমেদের কথা। পরে আমাদের কাছে বেশি প্রচারিত হয়ে যায় ‘চার খলিফার নাম-নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুছ মাখনের নাম। সঙ্গে ছিল মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নাম। মতিয়া চৌধুরী ও রাশেদ খান মেনন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের। মতিয়া চৌধুরীকে অগ্নিকন্যাও বলা হতো। পরে দেখলাম আরেকজনকেও-রাফিয়া আক্তার ডলিকেও অগ্নিকন্যা বলা হলো। তিনি পরে আর রাজনীতিতে টিকে থাকেননি, বড় এক আমলার স্ত্রী হিসাবেই ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন-ইপসু ভাগ হলে চীন-রাশিয়ার অনুসারী হিসাবে মতিয়া চৌধুরী ও রাশেদ খান মেনন দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
মেনন সম্পর্কে তেমন খারাপ স্লোগান কখনো না দেওয়া হলেও মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে ছাত্রলীগের কেউ কেউ তোমার আমার ঠিকানার সঙ্গে ভিন্ন কটূক্তি জুড়ে দিয়ে স্লোগান দিয়েছে। তবে মেধাবী, সজ্জন ও ভালো ছাত্র হিসাবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সুনাম ছিল। এমনকি আমরা এমনও শুনেছিলাম যে, খোদ বঙ্গবন্ধুও বলেছিলেন, তোরা সেলিমের মতো ছাত্রনেতা হতে পারিস না?
ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে তেমন একটা যাওয়ার আগ্রহ আমার কখনো ছিল না, কিন্তু জনাব সেলিমের এক মিছিলে আমি অনেকক্ষণ ছিলাম। অপরদিকে মতিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মারাত্মক মন্তব্যও করেছিলেন-বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর তার সেই কুখ্যাত বক্তব্য তখনকার সময়ে রাজনীতি-সচেতন সবাই জানতেন। এ দেশের ষাটের এবং সত্তরের প্রথমার্ধের রাজনীতিতে এসব ছাত্রনেতা বেশ আলোচিত চরিত্র। সময়ের বাঁকে কেউ বা হারিয়ে গেছেন, কেউবা এডাল-ওডাল ধরে টিকে রয়েছেন। আমাদের কাছে এখন আর অবাক লাগে না যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি জনতার বিপ্লবের পর খুশিতে ট্যাংকে নাচনেওয়ালাও শেখ হাসিনার নৌকায় চড়ে মন্ত্রী হন, মতিয়া তো পুরো আওয়ামীই হয়ে গেলেন। রাজনীতিতে চিরশত্রু বা চিরবন্ধু বলে কিছু নেই। ক্ষমতা চাই, ক্ষমতা-অতএব, যখন যাকে যেভাবে বুকে টেনে নেওয়া যায়, তাতে কোনো দোষ নেই। তাই তো আ স ম রবও এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা যেমন হন,
তেমনি শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে তার ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রীও হন; তাই তো যে এরশাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনারা গণ-অভ্যুত্থান ঘটান, সেই এরশাদকেই আবার শেখ হাসিনা আপন করে নেন, এমনকি তার দূতও করেন। নির্বিঘ্নে স্বাভাবিক মৃত্যুর আশায় এরশাদও শেখ হাসিনার ইচ্ছায় টিকে থাকেন। ১৯৮৬-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনা যেভাবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটার্ন নিয়ে এরশাদকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনের বৈধতা দিয়ে দিলেন, তাও নিশ্চয় এরশাদের মনে ছিল।
চার খলিফার তিনজনই চলে গেলেন, সবার আগে চলে গেলেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের এক ছাত্র সত্তরের প্রথমদিকে মাখনের ইংরেজি নাম লিখত আব্দুল কুদ্দুস বাটার। আরেক ছাত্র পোয়াবারো দিয়ে বাক্য রচনা করেছিল, শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে তোফায়েলের পোয়াবারো। সেই তোফায়েল হতাশ হয়ে কেবল বলতেন যে, তার শুধু অতীত আছে, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কিছু নেই। এখন তিনি পস্তান কি না, কেন যে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করে দেশে এনেছিলেন! রাজ্জাক সাহেব তো মহিউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে লেগে থেকে বেশ কবছর বাকশাল করলেন, অবশেষে আওয়ামী লীগে আবার ঘরের ছেলে ঘরে। শাজাহান সিরাজ বিএনপিতে গিয়ে মন্ত্রী বনে গেলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী নীরবে হারিয়ে গেলেন, শেখ হাসিনা-যুগে গুটিয়েই থাকলেন। আ স ম রব মেজর জলিলের সঙ্গে জাসদ করে একাটা রাজনৈতিক ঠিকানা ধরে রাখলেন
। এ জাসদ যে পরে ব্র্যাকেটবন্দি কত জাসদ-বাসদ হলো, তার নাম এখন কজন জানে? এ জাসদ পয়দাকারী একজন সিরাজুল আলম খানও গত ৯ জুন মারা গেলেন। ১০ জুন বেলা ১১টায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে তার জানাজায় গিয়ে জাসদের নেতৃত্বের বিশৃঙ্খলা আবার লক্ষ করলাম। টেলিভিশনের অনেক খবরে বিশ্বাস করতে নেই-তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য ৮টা ৩০ মিনিটে তার লাশ বায়তুল মোকাররমে রাখার খবর ছিল ভুয়া। প্রথমে তাকে নেওয়া হলো মসজিদের জানাজার নির্ধারিত স্থানের পূর্ব পাশে। পরে বলা হলো জানাজা ওখানেই হবে। আবার নিয়ে আসা হলো জানাজার নির্ধারিত স্থানে, আমরা লাইনে দাঁড়ালাম, আবার ঘোষণা হলো এখানে স্থান সংকুলান হবে না। অতএব, পূর্ব পাশের খোলা জায়গায়।
বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণের এ চত্বরে রাজনৈতিক সভাও হতো, মোশতাকের এক সভায় সাপও ছাড়া হয়েছিল, সেই পুরো জায়গা এখন আবার ছাদ হয়ে গেল। কেন, খোলা থাকলে কি গুনাহ হতো? পুরো পল্টন, স্টেডিয়াম মসজিদ করে দিলেও তো জুমার নামাজে মুসল্লিতে ভরে যাবে, তাই বলে কি খোলামেলা দক্ষিণ-চত্বরটিকে এভাবে ছাদ দিয়ে দিতে হবে? জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মাটি দিতে গিয়ে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানেও নেতৃত্বের বড় এক বিশৃঙ্খলা দেখেছিলাম।
সিরাজুল আলম খানকে প্রথম দেখি আমাদের এসএম হলের ওয়েস্ট হাউজের ১৬৫ নম্বর কক্ষে। আমি তখন এ কক্ষের চারজনের একজন, অপর তিনজনের একজন হাবিবুল্লাহ ভাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, একজন সুমন মাহমুদ ভাই (করোনায় মৃত) বাংলার এবং একজন ইকবাল ভাই নাট্যাভিনেতা আমীরুল সাহেবের ছোট ভাই, বর্তমানে কানাডায় থাকেন মর্মে জেনেছি। তারা তিনজনই আমার এক বছরের সিনিয়র। সিরাজুল আলম খান প্রায়ই এ ১৬৫ নম্বর কক্ষে আসতেন, মাঝে মাঝে সুমন ভাইয়ের সঙ্গে রাতও যাপন করতেন। কখনো কখনো তিনি এলে সুমন ভাই নিচে বিছানা করতেন। সিরাজুল আলম খানকে তারা ‘দাদা’ ডাকতেন, কেন এ দাদা ডাক-আমি বুঝতাম না। এখনো এ দাদা সম্বোধন আমার কাছে অজানা এক রহস্য। তবে সম্প্রতি এক লেখায় জানতে পারলাম, পরিবারের ছোট ভাইবোনেরা তাকে দাদা ডাকত। সেই থেকে নাকি অন্যেরাও দাদা ডাকা শুরু করেছেন।
তারেক রহমানকে তার অনুসারীরা ‘ভাইয়া’ ডাকা শুরু করেছিলেন। আমাদের দেশীয় জয়নাল হাজারীকে (মরহুম) ‘ভাইছা’ ডাকা হতো। দেশবন্ধু, বঙ্গবন্ধু, পল্লীবন্ধু, বঙ্গমাতা, বঙ্গভ্রাতা, বঙ্গভগ্নি, বঙ্গবীর ধরনের হরেকরকম সম্মানজনক পরিচিতি তো আর সবার কপালে জোটে না-তাই তো তারা দাদা, ভাইছা, ভাইয়া ইত্যাদি হয়ে যান। আমি তখনও বুঝতাম না, এখনো বুঝি না, সুমন ভাইয়ের সঙ্গে এই দাদার কেমন যেন একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
সিরাজুল আলম খান কখনো কখনো অধিক রাতেও আসতেন। তার প্রবেশের সুবিধার জন্য ১৬৫ নম্বর কক্ষের পূর্বপাশের কলাপসিবল গেটের একটা চাবিও তার কাছে ছিল, যাতে মূল গেট বন্ধ থাকলে তিনি এটা দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। আমরাও এ সুযোগ নিয়েছি, তবে এটার সীমিত ব্যবহার হতো। অনেক রাতে আমাদের দিয়ে নীলক্ষেতের আনোয়ার হোটেল থেকে খাবারও আনাতেন, এ হোটেল সারারাত খোলা থাকত। দাদার এক ভাইয়ের টিটি কলেজের পূর্বপাশে লীনা জেনারেল স্টোর নামে একটা গার্মেন্টের দোকান ছিল, আমি সেখানে যেতাম। এক ছোট ভাই পরে ব্যাংকে চাকরি করেছেন, তার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছিল। দাদাকে কেউ কেউ কেন যে কাপালিকও বলতেন! মুখভর্তি দাড়ি তার তখনো ছিল। ঘুমানো শুরু করলে একাধারে দুদিনও ঘুমাতে দেখেছি, কখন যে খেতেন বুঝতাম না, বাথরুমে গিয়ে এসে আবার ঘুম। আবার লেখাপড়ার কাজে দেখতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাত-দিন একসঙ্গে কাজ করছেন। তার সুবাদে রব-সিরাজসহ অনেককে এই ১৬৫ নম্বর কক্ষে আসতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু সরকারের শেষের দিকে কাকতালীয়ভাবে একবার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর এক জনসভায় আমার দাদার সঙ্গে একসঙ্গে বসা হয়ে গিয়েছিল। তখন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ছাত্রলীগ আলাদা হয়েছে।
সভার শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ওপর আপনাদের আস্থা আছে? আমরা হাত উঠালাম, দাদাও ওঠালেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরের প্রশ্ন-আওয়ামী লীগের ওপর আপনাদের আস্থা আছে? আমরা হাত উঠালাম, কিন্তু দাদা ওঠাননি। কেন যে সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধু থেকে আলাদা হয়ে গেলেন, তার কূলকিনারা আজও করতে পারলাম না। চার খলিফাও দুভাগে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর শেষের দিকের জনসভাতে বাস্তুহারা কাসেমও লোক জোগান দিতেন।
সিরাজুল আলম খানকে অযথা রহস্যপুরুষ বলা হয়। আমি তার মধ্যে রহস্যের কিছুই দেখিনি কখনো। জাসদ সৃষ্টি করলেও তিনি সামনে আসেননি, তাকে তাত্ত্বিক গুরু বলা হয়। কিন্তু আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, তিনি জাসদ করে তখনকার তরুণদের মোহগ্রস্ত করেছিলেন। ভারতীয় হাইকমিশনে অভিযান (ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডে) এক কুখ্যাত অধ্যায়। অবশ্য এই অভিযানের নির্দেশদাতা হতে পারেন অন্য কেউ। বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ সাময়িক জনপ্রিয়তা পেলেও এ জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র দেশে রাজনৈতিক ভিত্তি পায়নি।
স্বাধীনতার পরপর সিরাজুল আলম খানের বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতা তার তেমন কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল কি না, তা ইতিহাস বিবেচনা করবে। তবে আমার মূল্যায়নে সিরাজুল আলম খান কাজটি ভালো করেননি, বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থির করা এবং তার হত্যায়ও জাসদের ভূমিকা ইতিহাসে সর্বদা নিন্দিত হয়েই থাকবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সিরাজুল আলম খানও একই দোষে দুষ্ট হিসাবে স্বীকৃত হয়ে থাকবেন। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান