বাইফোকাল লেন্স
এতদিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে প্রমাণ পায়নি দুদক, এখন পেয়েছে!
একেএম শামসুদ্দিন
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শেষ পর্যন্ত অর্থ লুটপাট ও পাচারের মামলায় বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করে অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর পর দুদক বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎসংক্রান্ত ৫৯টি মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করে। এর মধ্যে ৫৮টিতে আসামি করা হয় শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতা হিসাবে বারবার শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম এলেও এতদিন তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। বাচ্চু ছাড়াও মালয়েশিয়ায় পলাতক ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামসহ ১৪৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেছে দুদক। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ৪৬ কর্মকর্তা ও ১০১ গ্রাহককে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাচ্চুকে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাচ্চু চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই এ ব্যাংকে লুটপাট শুরু হয়। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এ ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। দুদক ২০১৫ সালে ১৫৬ জনকে আসামি করে ৫৬টি মামলা করলেও বাচ্চুকে কোনো মামলাতেই অভিযুক্ত করেনি। সরকারের উপর মহলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার কারণে বাচ্চুকে আসামি করার বিষয়টি এতদিন ঝুলে ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। যদিও দুদক বরাবরই বলে গেছে, তদন্তে এ অর্থ কেলেঙ্কারিতে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে তাকে আসামি করা যাচ্ছিল না।
এক সময় ভালো ব্যাংক হিসাবে বেসিক ব্যাংকের সুনাম ছিল। খেলাপি ঋণ, মূলধন পর্যাপ্ততা, মুনাফা অর্জনসহ সার্বিক বিবেচনায় বেসিক ব্যাংক ছিল ঈর্ষণীয় কাতারে। ২০০৯ সালে বাচ্চু ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। ২০১৪ সালে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বেসিক ব্যাংকের ২০১০-২০১৩ সাল সময়ের ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ নিরীক্ষা করেছিল। নিরীক্ষায় ব্যাংকটিতে ১১১টি নজিরবিহীন অরাজকতার ঘটনার কথা উঠে আসে। দুদক অবশ্য ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলে।
বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালীন আর্থিক ব্যবস্থাপনা এমনভাবে ভেঙে পড়ে যে, এখনো ব্যাংকটি আর্থিক সংকটে ধুঁকছে। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির লোকসান হয় ৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। এক হিসাবে দেখা গেছে, ব্যাংকটি গত ১০ বছরে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সময়ে সংঘটিত দুর্নীতির প্রায় সমপরিমাণ অর্থ লোকসান দিয়েছে। মার্চে ১২ হাজার ৮০৬ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫৮ শতাংশ অর্থাৎ ৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকাই খেলাপি ছিল। এ ৭ হাজার ৪২৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকাই রয়েছে মাত্র ২৫ জন গ্রাহকের কাছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ব্যাংকের ঋণের টাকা লোপাটে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে এলেও তাকে সম্মানের সঙ্গে পদত্যাগ করার সুযোগ করে দিয়েছিল সরকার। পরের ৮ বছর, আত্মসাৎ করা অর্থে বাড়ি ও জাহাজ ক্রয় করে বেশ স্বচ্ছন্দেই জীবন কাটান বাচ্চু। এর মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসের ভেতর ১১০ কোটি টাকায় দেড় বিঘার একটি বাড়ি কিনেছিলেন। নামে-বেনামে বিভিন্নজনকে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেসব ঋণের একটা অংশ তিনি ও তার ভাই শেখ শাহরিয়ার ঘুস হিসাবে নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই উঠে আসে। অথচ এত আলোচনা-সমালোচনার পরও এতদিন কোনো তদন্তেই অর্থ লোপাটে বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি দুদক। তবে এখন পেয়েছে! ১২ জুন তাকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্রের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।
দুদকের এ দীর্ঘ সময় নেওয়া নিয়েও নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, বাচ্চু এতদিন তাহলে ছিলেন কোথায়? তার খোঁজ কেউ বলতে পারে না। তিনি এখন কোথায় আছেন? দেশে না বিদেশে? বাচ্চুর দেশত্যাগে আদালতের নিষেধ আছে। তা সত্ত্বেও বাচ্চু বেশ কয়েকবার বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন বলে শোনা যায়। তিনি নাকি নিয়মিত সিঙ্গাপুর যাতায়াত করতেন। এক সময় শোনা গিয়েছিল তিনি নাকি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে খামারবাড়ি করে ওখানেই বসবাস করছেন। আবার অনেকে বলেন, তিনি কানাডাতে পাড়ি জমিয়েছেন। অথচ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, দুদকেরই দায়িত্ব ছিল তাকে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখা। তারা তাদের কাজটি সঠিকভাবে পালন করেননি বলেই বাচ্চুর অবস্থান সম্পর্কে এমন ভিন্ন তথ্য বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকার একটি পত্রিকার সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, ‘এক বছর আগেও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাইয়ের তথ্য আমাদের কাছে ছিল। তবে এখন তিনি কোথায় আছেন, তা বলা যাচ্ছে না।’ অনেকেই বলছেন, শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বিদেশে চলে গেছেন নিশ্চিত হওয়ার পরই দুদক তার নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘মোটেও তা নয়। তবে এটি যদি সত্যও হয়, তাকে আসামি করার কারণে দুদক ধন্যবাদ পেতে পারে। কারণ, বিদেশে চলে গেলেও তিনি আর ফিরতে পারবেন না।’ বাহ্, দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক কত সহজেই কথাগুলো বলে ফেললেন। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, বাচ্চুকে দেশত্যাগে বাধা দেওয়া দুদক’র যেন কোনো দায়িত্বই ছিল না। মো. মোজাম্মেল হকের কথাতেই বোঝা যায়, দুদক বাচ্চুর বিষয়ে কতখানি রিলাকট্যান্ট ছিল। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বাচ্চু যদি দেশত্যাগ করে থাকেন, তাহলে দুদক তাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার দোষ এড়াতে পারবে না।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দেশত্যাগের বিষয়ে এক চমকপ্রদ খবর প্রকাশ করেছে যুগান্তর। ১৫ জুন যুগান্তরের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত শিরোনাম ছিল, ‘চার্জশিটের খবরেই দেশত্যাগ বাচ্চুর।’ খবরে বলা হয়, দুদকের করা ৫৮ মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হতে যাচ্ছেন-আগেভাগে এ খবর পেয়ে বাচ্চু দেশ থেকে পালিয়ে যান। আদালত কর্তৃক তার দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দুদক নিয়মিত ফলোআপ না করায় তিনি সেই সুযোগ নিয়ে, মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করার ৫ দিন আগে ৭ জুন দেশত্যাগ করেন। তবে তিনি দেশত্যাগের আগে বেশকিছু সম্পদ বিক্রি করে দেন। এর মধ্যে কিছু সম্পদ দুদক ক্রোক করে রাখলেও সেখানে রিসিভার নিয়োগ না করায় বাচ্চু গোপনে অনেক সম্পদ বিক্রি করার সুযোগ পান। এর মধ্যে বনানীর বাড়ির সব ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দেন। তার গ্রামের বাড়িরও কিছু সম্পদ তিনি বিক্রি করে গেছেন বলে জানা যায়। খবরে আরও বলা হয়েছে, গোয়েন্দা সূত্রে দুদক জানতে পারে, চার্জশিটের আগাম খবর পেয়ে তিনি কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন। দেশত্যাগের পর বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেয়ে কী লাভ? পালিয়ে যাওয়ার আগে খবর পেয়ে যদি তাকে আইনের আওতায় আনা যেত, তাহলে কাজের কাজ হতো। প্রশ্ন হচ্ছে, বাচ্চু তার সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে, এ খবর আগেভাগে কেউ পেল না কেন? সংশ্লিষ্ট সবাই কি চোখ-কান বন্ধ করে ছিল? এ কথাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে! এতগুলো ফ্ল্যাট বিক্রি করা তো এক মুহূর্তের ব্যাপার নয়। তাছাড়া অন্যান্য সম্পদ বিক্রয়ের বিষয় তো আছেই। এর জন্য চাই প্রচুর সময়। আমাদের দেশের এতগুলো কর্মদক্ষ সংস্থা থাকতে বাচ্চু তার ঢাকা ও গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের সম্পদ বিক্রি করে এত সহজেই দেশত্যাগ করে চলে যেতে পারল, সে কথা ভেবে অবাকই হতে হয়। এখন যদি কেউ বলে, এতদিন উপর মহলের আশীর্বাদে বাচ্চু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, এখন হয়তো আশীর্বাদের হাতটি সরে গেছে, তাই তার নামটি চার্জশিটভুক্ত হয়েছে, তাহলে খুব ভুল বলা হবে কি? বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের করা ব্যাংকের ঋণ অব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অর্থ লোপাটে সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ থাকলেও বাচ্চুকে দোষী সাব্যস্ত করতে দুদক’র ৮ বছর লেগে গেল? দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোন্ খুঁটির জোরে এতদিন অবাধে দেশ-বিদেশ করার সুযোগ পেলেন? শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার ঠিক আগে আগে, তিনি বাড়ি-গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি দিলেন কোন্ মন্ত্রবলে? এসব বিষয় নিয়ে মানুষ যদি প্রশ্ন করে, তাহলে খুব বেশি দোষের হবে কি?
দুদক কমিশনার জহুরুল হক যুগান্তরকে বলেছেন, ‘৮ বছর চলে গেছে, তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাকে যেন স্পর্শই করা যাচ্ছিল না। সবাই বলে দুদক চুনোপুঁটি ধরে। কিন্তু আমরা এবার রুই-কাতলা ধরেছি।’ প্রশ্ন হচ্ছে, চার্জশিট দিতেই আপনারা ৮ বছর নিয়ে নিলেন। আবার চার্জশিট দেওয়ার ঠিক আগেই বাচ্চু বিদেশে পালিয়ে গেলেন, তাহলে রুই-কাতলা ধরলেন কোথায়? এ প্রসঙ্গে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশের উচ্চ আদালতের একটি মন্তব্য উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। ‘হাজী মো. সেলিম বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য’ আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এক মন্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছি যে, হাজার হাজার দৃশ্যমান দুর্নীতিবাজ সম্পদ ও অর্থ দখলে রাখা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে দুদক কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা ও সাহস দেখাতে পারছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে, দুদক আইনের ২৬ ও ২৭ ধারায় ব্যবস্থা নিতে কমিশনের এখনো নিজস্ব কোনো উদ্যোগ নেই।’ আদালত যথার্থই বলেছেন। দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান এমন অনেক রুই-কাতলা এখনো সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা অপেক্ষায় রইলাম; এবার দেখতে চাই, দুদক তাদের ব্যাপারে কী করে।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, কলাম লেখক