শতফুল ফুটতে দাও
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের অবিশ্বাস্য বাসনা!
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মঙ্গলবার ২৩ মে একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল, ‘মানববন্ধনে ঢাবি শিক্ষক জামাল উদ্দিন : নির্বাচন ছাড়াই সংসদ ও সরকারের মেয়াদ ৫ বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব’।
পত্রিকায় এমন একটি শিরোনাম দেখে যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ হয়েছি। দেশে এখন যত কিছু ঘটছে, সেগুলোর বেশির ভাগই হতাশা উদ্রেককারী।
কিন্তু উল্লিখিত শিরোনামের পর মূল সংবাদ পড়তে গিয়ে হতাশা যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। পত্রিকার সংবাদ অংশে লেখা হয়েছে, ‘নির্বাচন ছাড়াই বর্তমান সংসদ ও সরকারের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন। সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির ডাকা মানববন্ধনে দেওয়া বক্তব্যে এ প্রস্তাব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগপন্থি হিসাবে পরিচিত জামাল উদ্দিন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপরাজেয় বাংলার সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়ার প্রতিবাদে।’
পত্রিকাটির বিবরণে আরও লেখা হয়েছে, ‘ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও পরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন জামাল উদ্দিন। শিক্ষক সমিতির মানববন্ধনে আ ক ম জামাল উদ্দিন বলেন, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল-সবার কাছে একটি আকুল আবেদন জানাই। আগামী ছয় মাস পর জাতীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু আমি মনে করি, এই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা দুর্যোগ-এ কারণে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কোনো ধরনের দরকারও নেই। যদি অনুষ্ঠিতও হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা করলে মহাদুর্যোগকে কারণ দেখিয়ে জাতীয় সংসদে এ সংসদ ও সরকারের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য এক্সটেনশন (বর্ধিত) করতে পারেন। কমপক্ষে ২ বছর তো হতেই পারে।’
পত্রিকায় আসা উপর্যুক্ত মানববন্ধনের সংবাদটি পড়তে পড়তে মনে হলো, এ বক্তা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়কার ছাত্র হিসাবে যে রকম বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছি, এ কি সেই বিশ্ববিদ্যালয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার অর্জনের জন্য নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন। ব্যক্তিস্বার্থে তারা কখনো প্রণোদিত হননি। আমার সৌভাগ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসাবে এমন কিছু শিক্ষকের সান্নিধ্যে এসেছিলাম, যারা ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাভাজন এবং আলোর দিশারি। এসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার সাধনাটি সমুন্নত রাখতে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন। তাদের অনেকের নাম এখনো স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। নীতির প্রশ্নে তারা ছিলেন আপসহীন। এ ব্যাপারে যাদের নাম স্মরণ করতে পারি তারা হলেন অধ্যাপক এমএন হুদা, অধ্যাপক আবু মাহমুদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক মোজ্জাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শিদ, অধ্যাপক আব্দুল করিম, অধ্যাপক জিসি দেব, অধ্যাপক নাজমুল করিম, অধ্যাপক আহমদ শরিফ প্রমুখ। সেদিনকার তুলনায় আজকের দিনগুলো উজ্জ্বলতর হয়েছে এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখন শ্রদ্ধা ও সমীহের সঙ্গে বর্তমান সময়ের শিক্ষকদের অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুজ্জ্বল ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। এ ব্যর্থতার জন্য ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিস্বার্থ যেমন দায়ী তেমনই দায়ী বর্তমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ।
১৯৭৫-এ সংবিধান সংশোধন করে দেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। সংসদে সাংবিধানিক এ পবির্তনের বিরোধিতা করেছিলেন খুবই অল্পসংখ্যক সংসদ-সদস্য। বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী, ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন এবং নূরে আলম সিদ্দিকী। আজ যখন ইতিহাসের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা হয়, তখন এ অতি নগণ্যসংখ্যক ব্যক্তিদের পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হয়। যে বিশালসংখ্যক সংসদ-সদস্য উল্লিখিত সংবিধান সংশোধনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তাদের নাম কদাচিৎ উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। এ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে বাকশালে যোগ দেবেন বলে নির্ধারিত ছিল। মর্মান্তিক হলো, সেদিন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এদের একটি অংশ স্বেচ্ছায় বাকশালে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। তবে বাকশালে যোগ দেওয়া অপর অংশটি চাকরি হরানোর ভয়ে অথবা অন্য কোনো ধরনের ভয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। বাকশাল নামক একক জাতীয় দলে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগ দেওয়ার বিধান ছিল। এ কারণে দেখা যায়, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদস্থ অনেকেই যোগদান করেছিলেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অতিক্ষুদ্র একটি অংশ বাকশালে যোগ দিতে চাননি। তারা ১৫-১৬ জনের বেশি হবেন না। শুনেছি বাকশালে যোগদানে অসম্মত শিক্ষকরা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষকরা হলেন ড. আহমদ শরিফ, ড. স্বপন আদনান এবং ড. আহমদ কামাল। ড. আহমদ শরিফ আজ আর বেঁচে নেই। তার সাহসিকতা, নিষ্ঠা এবং গবেষণাচর্চা তাকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। তিনি কখনো পদ-পদবির মোহাবিষ্ট ছিলেন না। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে ড. আহমদ শরিফকে জিয়াউর রহমান সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ড. আহমদ শরিফ এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, সিনেটের নির্বাচনের বাইরে গিয়ে তিনি নীতিগত কারণে উপাচার্য হতে পারেন না। কারণ এটি হবে অগণতান্ত্রিক এবং ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আইনের পরিপন্থি। এখন এ ধরনের একজন নির্লোভ মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সেজন্য দুঃখ করে বলতে হয়, সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। আমরা শুধু হা-হুঁতাশ করতে পারি।
অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানববন্ধন থেকে আকুল আবেদনে বলেছেন, আগামী ৬ মাস পর জাতীয় নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তিনি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পাশ কাটিয়ে ৫ বছরের জন্য সংসদ ও সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়েছেন। তা সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে এ মেয়াদ দুবছর বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি। কেন সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে, তার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং করোনা দুর্যোগের অজুহাত দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের দাবি হলো, সরকার দক্ষতার সঙ্গে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলা করে বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিরল সাফল্য দেখিয়েছে। করোনা মহামারি দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর বেশকিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। তাহলে সরকারের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ ধরনের অদ্ভুত যুক্তি কেন হাজির করা হচ্ছে? বিতর্কিত নির্বাচন করে সরকার অন্তত দুই মেয়াদ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে। সরকারের লোকজন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে দাবি করছেন এবং বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে-তারা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। সরকার বলছে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের বিধান সংবিধানে নেই। সুতরাং এমন একটি ব্যবস্থার সুযোগ নেই। তারা আরও বলছেন, সর্বোচ্চ আদালত বলে দিয়েছেন অনির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ চলতে পারে না।
মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বর্ধিত মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে তাকে কি নীতিগতভাবে নির্বাচিত সরকার হিসাবে বিবেচনা করা যাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের অন্য নাগরিকদের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী হবেন, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। ইদানীংকালে দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার পদের সংখ্যাও অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব পদে নিয়োগ লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে উদগ্র বাসনা লক্ষ করা যায়। সম্ভবত এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে লাভজনক পদে নিযুক্ত হওয়ার বাসনায় অন্ধ হয়ে গেছেন। বাংলাদেশ-উত্তরকালে, বিশেষত স্বাধীনতার প্রথম ২-৩ বছর সাংবাদিকদের মধ্যে একটি শব্দবন্ধ প্রায়ই উচ্চারিত হতো। শব্দবন্ধটি ছিল ‘কদমবুচি সম্পাদক’। এখন ভাবি, দেশটা কি ‘কদমবুচি অধ্যাপকের’ দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে?
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ