Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিশ্বব্যবস্থার জটিল ফাঁদে আমরা অসহায় পতঙ্গ

Icon

জয়া ফারহানা

প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বব্যবস্থার জটিল ফাঁদে আমরা অসহায় পতঙ্গ

দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেন, মানুষ একমাত্র ঘুমন্ত আর মদ্যপ অবস্থায় সুখী। কারণ, এ দুই সময় সে আত্মবিরোধিতায় ভোগে না। বাকি সময় তাকে জেগে অভিনয় করতে হয় ঘুমন্তের। রাসেল আরও বলেছেন, এমনকি চিন্তাও একটা বিশেষ সীমার পর বেদনাদায়ক। তাই উচ্চাঙ্গের বিচারবুদ্ধিতে সক্ষম মানুষ অসুখী। জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক’ নির্ধারিত ছয়টি সূচকের ভিত্তিতে সুখী দেশের যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশের স্থান মাত্র ১৯টি দেশের উপরে।

এতে তো আমাদের আনন্দিতই হওয়ার কথা। বিশ্বের ১১৭টি দেশের চেয়ে আমরা উচ্চাঙ্গের চিন্তা করতে সক্ষম! কারণ রাসেলের সূত্রানুযায়ী উচ্চাঙ্গের বিচারবুদ্ধিমানরাই অসুখী। সুখ নিয়ে রাসেল যে আকরগ্রন্থ লিখেছেন, তাতে অন্তত সুখ বিচারে তাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আসুন, রাসেলের এ মতবাদকে বাঙালি ও বাংলাদেশের পটভূমিতে স্থাপন করে একটু পর্যবেক্ষণ করি।

ধরা যাক, ঈদের ছুটিতে সপরিবারে মেট্রোরেল ভ্রমণ শেষে হাসিমুখে আনন্দিত স্বরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কেউ একজন বললেন, এ ভ্রমণ তাকে আনন্দ দিয়েছে, বাংলাদেশের রেলপথ সর্বাধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে, টিকিট ভেন্ডিং মেশিন, এমআরটি পাশ, রিচার্জ অপশন আর বহুতল টার্মিনাল সব মিলে ‘বিদেশ বিদেশ’ মনে হয়েছে। জাতিসংঘের নেটওয়ার্ক নির্ধারিত ‘সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা’ সূচকে ধরে নিতে পারি সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন সুখী।

সুখী মানুষের সুখ সাধারণের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে তারাও বুঝল, যাক আর পুরোনো চাকায় আটকে নেই দেশের রেল। আবার এ মানুষটিই যখন নিউমিডিয়ায় পোস্ট দেবেন ‘মেট্রোরেলের নির্মাণব্যয় সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত অন্যান্য দেশের ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি’, তখন তিনি ‘দুর্নীতি নিয়ে মনোভাব’ সূচকে অসুখী। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্কের এ সূচকগুলো কি একটি আরেকটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা বিরোধী নয়? দেখা গেল, যে-মানুষ ‘সুস্থ জীবনযাপনের প্রত্যাশা’ সূচকে সুখী সে-ই আবার দুর্নীতি মনোভাব সূচকে অসুখী। সুখের মতো অসুখও সংক্রামক। উদাহরণ দিই।

ওই পোস্টকে ঘিরে হয়তো আরেকজন মন্তব্য করলেন, আমরা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র অধমর্ণ বাংলাদেশি, কী দরকার আমাদের মেট্রোরেল বিলাসিতার? বিশ্বের আধুনিকতম প্রযুক্তি আমাদের জন্য নয়। তৃতীয় আরেকটি মন্তব্য : আমরা কি তাহলে কেবল প্রযুক্তির ক্রীতদাস হয়ে থাকব, প্রযুক্তিকে শাসন করতে পারব না? চতুর্থ পোস্ট : চারজনের একটি পরিবার এক বছর বেঁচে থাকার জন্য যে অর্থ ব্যয় করে, তা যদি একজন বিত্তবানের একটি ঈদের পোশাকের মূল্যের সমান হয়,

তাহলে মেট্রোরেল বিলাসিতা কেন নয়? শুরু হয়ে গেল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার লড়াই। এরা প্রত্যেকেই কিন্তু আবার ‘জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা’ সূচকে অসুখী। বলা দরকার, এ স্বাধীনতা তারা নিজেরাই যেচে এনেছে নিউমিডিয়ার মাধ্যমে। আপনি একে কুযুক্তি বলতে পারেন, কিন্তু উপেক্ষা তো করতে পারেন না। কুযুক্তি যদি হয়ও, ভিন্নমত গ্রহণে আপনি কতটা সহনশীল, এটা তার একটা পরীক্ষাও বটে।

বাঙালির কোনো দর্শন নেই, দর্শনশাস্ত্রের আকরগ্রন্থে বাঙালির দর্শন হিসাবে যা পাই, তা আসলে ভারতীয় দর্শন। ভারতীয় দর্শন আবার দাঁড়িয়ে আছে আধ্যাত্মিকতার ওপর। সেই দর্শন থেকে কি বাঙালি সরে এসেছে? বাঙালি চিরদিন সুখী থেকেছে, কারণ সে ত্যাগের অনুরাগী ভোগ বিরাগী। ইতিহাস বলছে, গৌর সমতট বাংলা মুলুকের মানুষ মোটা ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারলেই খুশি থেকেছে।

এবং সে রাজার ভাগ, সামন্তের ভাগ, মোড়লের ভাগ, মহাজনের ভাগ দিয়ে নিজের অংশে যে উচ্ছিষ্টটুকু পেয়েছে তা নিয়েই খুশি থেকেছে। এ অল্প নিয়ে খুশি বা সন্তুষ্ট থাকার কারণ হলো বাঙালির আধ্যাত্মিকতার দর্শন, যার মূল কথা হচ্ছে পৃথিবী ও জীবনের প্রতি উদাসীনতা, পরলোকমুখিনতা।

ভারতীয় দর্শনে আধ্যাত্মিকতা একটা সাধারণ চরিত্র-লক্ষণ হলেও সামগ্রিকভাবে এতে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই বেশি। বাঙালি এখনো সেখানেই আছে। বাঙালি এখনো একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক ও তর্কপ্রবণ। আপনি বলতে পারেন, যুক্তি আছে বলে বিতর্কও আছে। বিতর্ক-তর্কের মধ্যে কিন্তু একটা সূক্ষ্ম পার্থক্যও আছে। বিতর্ক যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তর্ক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে। তর্ক-বিতর্ক যেটাই হোক না কেন, নিরেট একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে কখনো দুটি পক্ষ, কখনো একাধিক পক্ষ তৈরি হয়ে যায়; একসময় এ উত্তেজনা চূড়ান্ত বৈরিতায় রূপ নেয়।

পক্ষে-বিপক্ষে কী কী যুক্তি আছে সেগুলো যে জানা প্রয়োজন, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ প্রয়োজন-এসব আর কারও মাথায় থাকে না। এখান থেকে কি এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আমরা কেউই বিরুদ্ধ বা ভিন্নমত সহ্য করার জন্য প্রস্তুত নই? জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সূচক আমাদের সুখী করার পরিবর্তে অসুখী করেছে।

গণতন্ত্রের ভিত্তিতে থাকে স্বাধীনতা, বিশেষভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে জরুরিও বটে, কিন্তু মতপ্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অতি অসহিষ্ণু, অতি অসহনশীল হয়ে উঠি কেন? আমরা কি তাহলে মতপ্রকাশ কিংবা বিতর্কের জন্য যথাযথ প্রস্তুত নই? কারণ, অধিকাংশ সময় নিজের মতপ্রকাশ করতে গিয়ে যেভাবে আমরা বিরুদ্ধ মতকে উপেক্ষা করি, যুক্তিবোধ হারাই, তাতে সেখানে শ্রদ্ধার তো আর প্রশ্নই নেই।

বলা যেতেই পারে, নিজের মতপ্রকাশ করা, অন্যের মত শোনা-যাকে সোজা ভাষায় আলোচনা বলে-তাকে শিল্পে পরিণত করতে পারিনি আমরা। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিন দফা বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। উচ্চসম্মানি দিয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয় নির্বাচনি বক্তৃতাগুলো যেন শানিত ধারালো হয়।

সংবাদমাধ্যম ঘোষণা দিয়েই একেকটি বিশেষ দলের পক্ষে মতবাদ প্রকাশ-প্রচার করতে থাকে জনগণকে ওই বিশেষ দলটির পক্ষে টানার জন্য। আমাদের দেশে আমরা যাত্রাপথকে সর্বাধুনিক পর্যায়ে আনতে পারলেও আলোচনার পথকে আনতে পারিনি। পশ্চিমে রাজনীতিকরা পরস্পরের সঙ্গে একটা স্থির ঠান্ডা লড়াই চালিয়ে যান। আমরা মারমুখী হয়ে উঠি। রাজনীতিকদের এ স্বভাব সংক্রমিত হয় জনগণের মধ্যেও।

২.

‘সুরবালার স্বামী রামলোচন রায় উকিল, তাহার বিশেষ করিয়া সুরবালারই স্বামী হইবার কোনো আবশ্যক ছিল না; বিবাহের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাহার পক্ষে সুরবালাও যেমন ভবশঙ্করীও তেমন। সেই কিনা কিছুমাত্র না ভাবিয়া চিন্তিয়া বিবাহ করিয়া সরকারি উকিল হইয়া দিব্যি পাঁচ টাকা রোজগার করিতেছে। যেদিন দুধে ধোঁয়ার গন্ধ হয়, সেদিন সুরবালাকে তিরস্কার করে, যেদিন মন প্রসন্ন থাকে, সেদিন গহনা গড়াইতে দেয়, বেশ মোটাসোটা কোনো অসন্তোষ নাই; পুকুরের ধারে বসিয়া আকাশের তারার দিকে চাহিয়া কোনোদিন হা হুতাশ করিয়া সন্ধ্যা যাপন করে না। সুরবালা আজ তোমার কেউ নয়, কিন্তু কে না হইতে পারিত ভাবিয়া গল্পের নায়কের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে না। সংসারে রামলোচন রায় উকিলের মতো এমন মধ্যম পন্থীরাই সুখী।’ সম্প্রতি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন নেটওয়ার্ক ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে’ কোন দেশ কতটা সুখী এর যে তুলনামূলক তালিকা দিয়েছে, সেখানে সুখ সূচকে বাংলাদেশ যে ২৪ ধাপ পিছিয়ে ১১৮ নম্বরে এসে ঠেকেছে তার কারণ কি এই যে, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপন্থি রামলোচন রায়রা নির্বাসিত হয়েছে? বাংলাদেশি বাঙালিরা সহজিয়া দর্শন, মুক্তি ও মোক্ষের দর্শন আউল, বাউল, বৈষ্ণব, সুফি ও মরমিয়া দর্শন থেকে সরে এসেছে?

৩.

আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছেছি, যেখানে টাকাই সম্মানের মাত্রা নির্ধারণ করে; এ কারণে সুখ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার একটি হলো, যে যত ধনী সে তত সুখী। কিন্তু গবেষণা বলছে, পৃথিবীর সব ধনীর মনে একটি সাধারণ ভয় সব সময় থাকে, তা হচ্ছে আয়ের মোহে কখন সে কর্মক্ষেত্রে মারা যায়। গবেষণা আরও বলছে, যারা দরিদ্র থেকে ধনী হয়, তাদের মনে সব সময় এ উৎকণ্ঠা থাকে যে তাদের সন্তানরাও বোধহয় সেই দারিদ্র্য ভোগ করবে। এ দারিদ্র্য থেকে সন্তানদের মুক্ত করার জন্য তারা টাকার দুর্গ গড়ে তুলতে চায়-যত বিলিয়ন টাকা হলে দারিদ্র্য আর তাদের দুর্গে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু সেটা প্রায় অসম্ভব বলে ধনীরা সবসময় অসুখী। মিথ রয়েছে, সক্রেটিস জ্যানথিপের সঙ্গে একটি অসুখী জীবনযাপন করেছেন; কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে নির্ঝঞ্ঝাট সময় পার করেছেন। স্বাস্থ্য ও জ্ঞানচর্চা করেছেন। শোনা যায়, কান্ট কখনো কোয়েনিস বার্গ থেকে ১০ কিলোমিটারের বেশি কোথাও যাননি। ডারউইন সারা পৃথিবী ভ্রমণ শেষে বাকি জীবন নিজের ঘরে বসে কাটিয়েছেন। মার্কস কয়েকটি বিপ্লবের জন্ম দিয়ে বাকি জীবন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কয়েক শতাব্দীর সুখী মানুষের তালিকায় এ কজনের নাম আছে। গবেষণা বলছে, মানুষ যখন ঈর্ষা করে এবং যুদ্ধ করে-এ দুই সময়ে সবচেয়ে বেশি অসুখী হয়। বলা হয়, যদি খ্যাতি-প্রতিপত্তি চান, তাহলে আপনি নিশ্চিত নেপোলিয়নকে ঈর্ষা করবেন; কারণ জগতে তার চেয়ে যশস্বী আর কে? কিন্তু জানেন কি নেপোলিয়ন ঈর্ষা করতেন সিজারকে? সিজার আবার ঈর্ষা করতেন আলেকজান্ডারকে আর আলেকজান্ডার ঈর্ষা করতেন হারকিউলিসকে। অথচ হারকিউলিসের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। আপনি বুদ্ধিবান হলে ইতোমধ্যে বুঝে গেছেন ঈর্ষা করে অসুখী হবেন কিনা। এবার আসি যুদ্ধকালীন অসুখী হওয়া প্রসঙ্গে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এখনো চীন সম্পর্কে তার সাবেকি ধারণায় আটকে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একজন মুখপাত্র বলেছেন, এ মুহূর্তে অস্ত্র বিরতিতে যাওয়ার অর্থ ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার ছিনিয়ে নেওয়া ভূখণ্ড রাশিয়ার হাতেই ফেলে আসা। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক চেহারা বদলে দিয়েছে। কেউ কখনো ভাবতে পেরেছিল, সৌদি আরব-ইরান এক জায়গায় আসবে? চীন তা সম্ভব করেছে। কেন ভাবছেন না, চীন জেলেনস্কিকেও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে নিয়ে আসতে পারে? অতএব আসুন, যুদ্ধকালীন উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে সুখী হই।

জয়া ফারহানা : প্রাবন্ধিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম