Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

দুর্নীতি ও অদক্ষতার ব্যয় গ্রাহক কেন বইবেন?

Icon

আবু তাহের খান

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্নীতি ও অদক্ষতার ব্যয় গ্রাহক কেন বইবেন?

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের (বিআইডিএ) অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেওয়া যাবে যদি সবাই ক্রয়মূল্য যা হবে সেটা দিতে রাজি থাকে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য খুবই যথার্থ। কারণ যাদের উদ্দেশে বা বিআইডিএ-সংশ্লিষ্ট যে শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি এ বক্তব্য রাখছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই বিত্তবান শ্রেণির মানুষ এবং তাদের মালিকানাধীন শিল্প-কারখানাগুলো বৃহৎ শিল্প বিধায় তাদের সবারই ভর্তুকিবিহীন যৌক্তিক মূল্য দিয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য রয়েছে।

অতএব প্রধানমন্ত্রী তার এ আহ্বানের মধ্য দিয়ে বস্তুত বিত্তবান শ্রেণিকে জনগণের করের পয়সায় অহেতুক ভর্তুকি গ্রহণের চলমান সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনের কথাই তুলে ধরলেন, যা বিদ্যমান শিল্পনীতিতে ঘোষিত অঙ্গীকারের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিল্পনীতির একাধিক অধ্যায়ে স্পষ্টতই বৃহৎ শিল্পের তুলনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বাড়তি প্রণোদনা দানের কথা বলা হয়েছে (শিল্পনীতি ২০১৬ : অধ্যায়-১, ২, ৪, ৫, ১০ ও ১১)।

অতএব শিল্পনীতির ঘোষণা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুৎ বা অন্যবিধ জ্বালানিতে যদি ভর্তুকি দিতেই হয়, তাহলে তা দিতে হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে (এসএমই), বৃহৎ শিল্পকে নয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত শিল্পের সংজ্ঞা এবং শিল্পসংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি, অসংগতি ও অসম্পূর্ণতার সুযোগ ও ফাঁকফোকর গলিয়ে প্রকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধার একটি বড় অংশই বর্তমানে ভোগ করে চলেছেন দেশের বৃহৎ শিল্পের মালিকরা।

ফলে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন খাতে বর্তমানে যেসব ভর্তুকি, নগদ প্রণোদনা, কর ও শুল্ক রেয়াত, নিম্ন সুদহার ইত্যাদি সুবিধা রয়েছে, সে বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও তার সুফল প্রকৃত এসএমইগুলো প্রায় পাচ্ছে না বললেই চলে। উল্লেখ্য, শিল্পনীতি ২০১৬-তে প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৫-৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগসীমার আওতাধীন সব শিল্পই হচ্ছে মাঝারি শিল্প। কিন্তু প্রকৃত সত্য তো এটা যে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ৫০ কোটি টাকার শিল্প মানে অনেক বড় শিল্প-কোনো অবস্থাতেই সাধারণ ধারণা অনুযায়ী মাঝারি শিল্প বলতে যা বোঝায়, এটি তা নয়।

কিন্তু বিত্তবান সুবিধাবাদী শ্রেণির স্বার্থে তাদের প্রতিনিধিরা শিল্পনীতিতে সেভাবেই শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং সে সংজ্ঞার ফাঁক গলিয়ে প্রকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঘোষিত সুবিধা ও প্রণোদনাগুলোর অধিকাংশই এখন ভোগ করে চলেছেন বৃহৎ শিল্পের মালিকরা, যেমনটি একটু আগেই উল্লেখ করা হলো।

যা হোক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগ্রহমূল্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনতে বলে একইসঙ্গে দুটি ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ করে দিলেন। এর প্রথমটি হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সম্পূর্ণ অন্যায্য পন্থায় যে বিপুল অঙ্কের অর্থ বড় উদ্যোক্তাদের হাতে চলে যাচ্ছিল, এ আহ্বান বা প্রস্তাবনার ফলে এখন তার সে অপচয় থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ তৈরি হলো।

তবে বাস্তবে শেষ পর্যন্ত এটি ঘটবে কিনা, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। অন্যদিকে সাশ্রয়কৃত (যদি হয়) শেষোক্ত ওই অর্থ যদি ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বণ্টন করা সম্ভব হয়, তাহলে দেশের সামগ্রিক শিল্প খাতও ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু আশঙ্কা হয়, প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের সূত্র ধরে ওই ভর্তুকি প্রত্যাহার না করে ছোট-বড় সব শিল্পের ওপরই না আবার তা সমহারে বসিয়ে দেওয়া হয়!

নির্বাহী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা ঊর্ধ্বতন স্তর থেকে প্রদত্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত আমলাতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের কথা ভেবে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, উল্লেখিত ভর্তুকি ছোট-বড় সবার ওপর থেকেই তুলে নেওয়া হবে, তাহলেও ভর্তুকিবিহীন মূল্যের ক্ষেত্রে তা নির্ধারিত হওয়া উচিত ব্যবহারের ধরন, ব্যবহারকারীর আয়শ্রেণি, ব্যবহারজনিত উপযোগের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নির্ণায়কের ভিত্তিতে।

অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, নিম্ন আয়শ্রেণির মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রমুখের জন্য মূল্যহার যেমন কম হওয়া উচিত, তেমনি তা বেশি হওয়া উচিত বড় শিল্পোদ্যোক্তা, পরিমাণে অধিক ব্যবহারকারী ও অনুরূপ অন্যান্য ভোক্তাগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের কাজটি বাস্তবে কি সেভাবে হয় বা হবে বলে আশা করা যায়?

এবারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূল কথায় ফেরা যাক; যেখানে তিনি বলেছেন, ‘ক্রয়মূল্যে’ নিতে রাজি থাকলে বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) যদি কারও কাছ থেকে সাধারণ বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনে কিংবা পেট্রোবাংলা যদি আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ অধিক হারে গ্যাস আমদানি করে, তাহলে সে বাড়তি মূল্যের খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা বৃহৎ শিল্পের উদ্যোক্তারাই বা কেন দেবেন?

একইভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃশ্যমান অদক্ষতার কারণে যদি গ্যাস, বিদ্যুৎ বা অনুরূপ পণ্যাদির উৎপাদন বা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেই বর্ধিত ব্যয় জনগণ বা সাধারণ ভোক্তারা বহন করবেন কেন? কেন দীর্ঘমেয়াদি কুফলের কথা না ভেবে পিডিবি যদি গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় জড়িত হয়ে থাকে, তাহলে সেই বাড়তি ব্যয়ের বোঝা জনগণের ঘাড়ে কেন চাপবে? গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের সব সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পেট্রোবাংলা যে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ হাতে না নিয়ে গ্যাস আমদানিকারকদের সুযোগ করে দিল এবং তাতে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেল, সেই বর্ধিত মূল্য পরিশোধের দায়িত্ব কি জনগণের ওপর বর্তায়?

এ অবস্থায় যুক্তি ও জবাবদিহিতার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উচিত হবে জনগণ, সাধারণ ভোক্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, বৃহৎ শিল্পের মালিক, সেচপাম্প ব্যবহারকারী গ্রামীণ কৃষক ইত্যাদি সবার স্বার্থকে সমন্বয় করে একটি যৌক্তিক সমঝোতায় পৌঁছা। আর সেক্ষেত্রে প্রস্তাব হচ্ছে, ভর্তুকি যদি প্রত্যাহার করতেই হয় অর্থাৎ উৎপাদন বা ক্রয়মূল্যে যদি গ্যাস-বিদ্যুৎ কিনতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে ওইসব খাত থেকে দুর্নীতি, অপচয় ও অদক্ষতাজনিত ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে, যাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের পরও তা ভোক্তার ক্রয়সামর্থ্যরে মধ্যে থাকে।

আর ক্রয়সামর্থ্য থাকলেই (অধিকাংশের যা নেই) যে গ্রাহককে দুর্নীতি, অপচয় ও অদক্ষতাজনিত ব্যয়বৃদ্ধির আরোপিত হিস্যা নিঃশব্দে মেনে নিতে হবে-এটাও কোনো যুক্তির কথা হতে পারে না! কিন্তু জনগণের সামর্থ্য ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেই যুক্তিহীন আরোপণের কাজটিই এখন নিয়মিত বিরতিতে ঘটে চলেছে।

এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য আরও বৃদ্ধি করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উল্লেখিত দুর্নীতি, অনিয়ম ও অদক্ষতা কীভাবে হ্রাস করা যায়, তা নিয়ে ভাবা দরকার বলে মনে করি। কিন্তু তা না করে উৎপাদন ও আমদানি উভয় ক্ষেত্রের উপরোক্ত কারণজনিত অযৌক্তিক ব্যয় ভোক্তার ওপর অন্যায়ভাবে চাপানোর ধারা অব্যাহত থাকলে তা শুধু জনগণের কষ্ট, ভোগান্তি ও অসন্তোষই বাড়াবে না, অর্জিত উন্নয়ন টেকসই হওয়ার পরিবর্তে ভঙ্গুর হওয়ার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে।

এর চেয়েও বড় কথা-দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণভিত্তিক একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের জন্ম, সে রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষকে কষ্ট ও অসন্তুষ্টির মধ্যে রেখে শাসক বা শাসিত কারও পক্ষেই পরিতৃপ্ত হওয়া সম্ভব নয়।

আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

atkhan56@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম