Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইসরাইলে অশান্তি, আতঙ্কে ফিলিস্তিন

Icon

মারওয়ান বিশারা

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইসরাইলে অশান্তি, আতঙ্কে ফিলিস্তিন

যেদিন থেকে ফ্যাসিবাদী ও উগ্রপন্থি দল ক্ষমতা নিয়েছে, সেদিন থেকে ইসরাইল এমন এক স্বৈরাচারী দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে ধর্মান্ধতাই হচ্ছে শাসননীতি। ফলে ইসরাইলের মূলনীতি, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন শক্তিগুলোর বর্তমান অবস্থান হয়েছে রাস্তায়। মূলত এজন্যই কয়েকদিন আগে তেলআবিবের রাস্তায় দেখা গেল বিক্ষোভ। আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের কারণও যৌক্তিক। ইসরাইলের ক্ষমতাসীন সরকার দ্রুত এমন এক আইন পাশ করতে চায়, যাতে করে কার্যত খর্ব হয় স্বাধীন বিচারব্যবস্থার শক্তি; সুপ্রিমকোর্ট চলে যায় ক্ষমতাসীন দলের ক্ষীণ সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে। বিক্ষোভকারীরা এর বিপক্ষে।

এ প্রতিবাদকারীদের দলে একাধিক সাবেক জেনারেলকে দেখেছি আমরা। অনেক বর্তমান সেনাসদস্যও ছিলেন। তারা সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন, গণতন্ত্র থেকে যেন কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে না হয়ে পড়ে ইসরাইল। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি সম্প্রদায়ের একাংশ, যারা ইসরাইলকে ইহুদি গণতন্ত্র হিসাবে দেখতে চান, তারাও আহ্বান জানিয়েছেন এ বিষয়ে সজাগ থাকতে।

গত কিছুদিন ধরে ইসরাইলের স্থানীয় পত্রপত্রিকা যে ধরনের হেডিং ছাপাচ্ছে তাতে করে মনে হয়, আগামীর ইসরাইল হবে কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র। অন্তত বর্তমান হেডিং সেটাই নির্দেশ করে। ইসরাইলের বিচারমন্ত্রী এ মুহূর্তে কাজ করে যাচ্ছেন-কীভাবে বিচার বিভাগ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া যায়। তথ্যমন্ত্রী সরকারি গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়েছেন, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো খবর প্রচার করা হলে বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ঐতিহ্যমন্ত্রী এরই মধ্যে একাধিক সংগঠনকে শাসিয়েছেন, ‘রিফর্ম জ্যু’ নামক সাংস্কৃতিক আধুনিকীকরণের উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করা হোক; সংস্কারের ফলে নাকি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হারাচ্ছে ইহুদিরা।

এ অবস্থায় চলমান কলহ থেকে যেন অশান্তি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সামনে এগিয়ে এসেছেন প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শক্ত সমর্থন লাভ করেছেন তিনি। তার মূল লক্ষ্য সরকার ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সমঝোতা গড়ে তোলা। বাহ্যিকভাবে হার্জগের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়-জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার শুভেচ্ছা মীমাংসা। তবে কার্যত এর ফল কী দাঁড়ায়, সেটি এখনো দেখার বিষয়। কাক্সিক্ষত ফলাফল বয়ে আনতে নাও পারে কট্টরপন্থিদের সঙ্গে সমঝোতার পরিকল্পনা। ফ্যাসিবাদীরা যদি সমঝোতাকে তোষণনীতি মনে করে, পরিণামে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে ইসরাইল সরকার। কারণ, সমঝোতা যা-ই হোক, তা হতে হবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। অথচ ক্ষমতাসীনরা বলছে, প্রস্তাবিত আইনের ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণের ব্যাপারে তারা অনড়। এ কট্টর অবস্থানের কারণে যে কোনো সমঝোতা প্রকারান্তরে প্রস্তাবিত আইনেরই চুনকাম। ফলে সমঝোতায় শক্তিশালী হবে ইসরাইলের ক্ষমতাসীন সরকারই। জনগণের চোখে তারা হয়ে উঠবে সবচেয়ে দায়িত্বশীল ও বাস্তববাদী পক্ষ। এতে করে সাময়িক ছেদ পড়লেও আবারও ফিরে আসবে কট্টরপন্থি এজেন্ডা। ধীরে ধীরে বিরুদ্ধ প্রতিবাদ গতি হারাবে, জনমানস থেকে বিযুক্ত হবে।

ক’দিন আগে ‘নো প্লান নো কম্প্র্রমাইজ’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছেপেছে প্রভাবশালী ইসরাইলি দৈনিক হারিজ। তারা লিখেছে, ‘সরকার যেসব পরিকল্পনা করেছে, সেগুলোর জন্মই পাপের মধ্যে। এর লক্ষ্য বিচার বিভাগ খর্বকারী প্রস্তাবিত আইন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে একশ্রেণির ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্ত। সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে ইসরাইলের বিচার বিভাগের সব ইতিবাচক পরিবর্তনে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। বস্তুত প্রস্তাবিত আইনটি সংস্কারমূলক হলেও মৌলবাদী।’

সমঝোতার আলোচনার সবচেয়ে খারাপ ও বিপজ্জনক দিক হলো, ওই সমঝোতায় ইসরাইলে উদার গণতন্ত্র রক্ষার প্রতি যতটা মনোযোগ দেওয়া হয়েছে, ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের অত্যাচারের ইস্যুতে আলোকপাত করা হয় ততটাই। ফলে আলোচ্য সমঝোতা উদ্যোগ যদি সফলও হয়, তা হবে ক্ষমতাসীন সরকারকে এমন অবাধ ক্ষমতা দেওয়া, যাতে করে সম্প্রসারিত হবে তার দমননীতি, গভীর হবে দখল-আগ্রাসন এবং বাড়বে অবৈধ বসতিস্থাপন। কেন, সেটা বলছি। কারণ, সরকারের বিচার বিভাগীয় নীতি পরিকল্পনার বিরোধিতাকারী সাবেক জেনারেল অথবা বর্তমান সেনাসদস্যদের কেউই ফিলিস্তিনে ক্ষমতাসীনদের সম্প্রসারণ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা নিয়ে টুঁ শব্দও উচ্চারণ করেননি। ফলে এক্ষেত্রে ইহুদি কর্তৃত্ব ও ফিলিস্তিনে বর্ণবাদের মধ্যকার অন্তঃসম্পর্কটা ঠিক চিহ্নিত নয়।

এটা বিপজ্জনক ও ভন্ডামি। প্রায় এক যুগ আগে ইসরাইলের একাধিক নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্তারা বলেছিলেন, ইসরাইলের কোনো নিরাপত্তা সমাধান নেই ফিলিস্তিনে। দেশটির সাবেক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অ্যামি আয়লন তার আত্মজীবনী ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ারে’ লিখেছেন, অন্যকিছুর দরকার নেই, এক দখলদারিত্বমূলক মনোভাবের কারণেই ইসরাইলের গণতন্ত্র রূপান্তরিত হতে পারে স্বৈরতন্ত্রে।

ইতামার বেনগাভির বর্তমানে ইসরাইলের ‘নৈরাজ্যমন্ত্রী’। তার বিরুদ্ধে চলমান মামলা আটটি। তার মধ্যে আছে বর্ণবাদী প্রচারণা ও এক সন্ত্রাসী সংস্থাকে সমর্থন প্রদানের মতো অভিযোগ। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইহুদ ওলমার্ড তো একবার বলেই ফেলেছিলেন, পরমাণু শক্তিধর ইরানের চেয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তার জন্য বেশি বিপজ্জনক বেনগাভির। তিনি বর্তমানে দেশটির নিরাপত্তামন্ত্রী। তার পূর্বতন অপকর্মের সহযোগী বেজালেল স্মটরিচ বর্তমানে অর্থমন্ত্রী। এ দুজনই বর্ণবাদী প্রচারণা চালিয়ে এবং ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তাদের প্রদত্ত ধর্মান্ধ বিক্ষোভের জন্ম হয়েছে তেলআবিবসংলগ্ন পশ্চিমতীর থেকে। এ দুজনই বিশ্বাস করেন, ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন হচ্ছে ইসরাইলের অংশ এবং ইহুদি জনগণের উচিত যে কোনো মূল্যে এর দখল নেওয়া।

এর মানে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্বচ্ছ নয় ইসরাইলের ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা। উপরন্তু তারা ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দিয়ে চায় তরুণদের মধ্যে। বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো হচ্ছে শুধু উসকানি দেওয়ার স্বার্থে। কয়েক দশকের সামরিক দখলদারত্বের পর বর্তমানে ইসরাইলের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সি ইহুদিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বেড়েছে। এমন মনোভাব ইসরাইলের ভবিষ্যৎ শান্তি বা নিরাপত্তা কোনোটির জন্যই সুসংবাদ নয়।

গত সপ্তাহে সহিংসতার মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন কয়েকশ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী একত্র হয়ে আগুন দেয় দখলকৃত ফিলিস্তিনের ঘরবাড়ি ও গাড়িতে। একজন পদস্থ ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, এ ধরনের কর্মসূচি আরও আসবে। অনেক ইহুদি আবার এ কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন এ যুক্তিতে যে, কয়েকদিন আগেই পশ্চিমতীরে দুজন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীকে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে কেউ কেউ মনে করেন, ইসরাইলের আগ্রাসনের জবাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুক্তিসংগত। কিন্তু কেউ ভাবেন না ওই অঞ্চলে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি যারাই বসবাস করছেন, তাদের নরক গুলজার।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইসরাইলের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয় রয়েছে বটে। তবে সমস্যা হচ্ছে, মাঝেমধ্যে সিনিয়র ফিলিস্তিনি নেতাদের ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করে ইসরাইল। খর্ব করে তাদের কর্তৃত্ব। হেয় করতে চায় তাদের বৈধতা। বল প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড এবং শরণার্থী শিবিরগুলোয়। বুঝতে ভুল হয় না, কয়েক দশকের সামরিক-বেসামরিক দখলই হচ্ছে ইসরাইলি সহিংসতার চালিকাশক্তি। আর এ দখলের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে জাতিবিদ্বেষ, দুই ধরনের পৃথক পৃথক আইন, কাঠামো ও মানদণ্ড। এখন জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত দখল বাড়াতে বর্তমান ইসরাইল সরকার ফিলিস্তিনে বৃদ্ধি করেছে সহিংসতার মাত্রা। এ প্রক্রিয়ায় কার্যত ইসরাইল পরিণত হচ্ছে জঙ্গি রাষ্ট্রে এবং নষ্ট করছে আঞ্চলিক শান্তি।

তাদের থামাতে হবে।

আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর : জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মারওয়ান বিশারা : সাবেক অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম