Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চেতনায় বুদ্বুদ

রাজধানীতেই সবকিছু থাকতে হবে কেন?

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীতেই সবকিছু থাকতে হবে কেন?

দেশের উন্নয়ন নিয়ে উন্নয়নবিশারদদের নানারকম জ্ঞানগর্ভ ধ্যানধারণা থাকতে পারে। থাকাটা স্বাভাবিকও বটে। যে কোনো বিষয়ে বিশারদ আর বিশেষজ্ঞের আঁতেল মার্কা থিসিস ও পরামর্শ আমাদের শুধু প্রলুব্ধ করে না, মাঝেমধ্যে অবাক ও হতবাক দুটিই করে দেয়। কিন্তু কোনটা কতটা বাস্তবভিত্তিক, তা যাচাই করে দেখলে আমরা আমজনতা অনেক সময়েই খেই হারিয়ে ফেলি। হালে আবার গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব দেন এমন নেতারাও উন্নয়ন নিয়ে নিজস্ব চিন্তাচেতনা শুধু প্রকাশই করেন না, তা অনেকটা গোঁ নিয়ে বাস্তবায়নের পথেও হাঁটেন। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সত্যি জ্ঞানবান ব্যক্তিরা তখন ওই নেতাদের দোহারি সেজে অনিচ্ছায় হলেও সায় দেন।

ঢাকাকে তিলোত্তমা করার মানসে একেক সময়ে একেক চিন্তা বাস্তবায়নের কসরত কম করা হয় না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এসব চিন্তার ফলপ্রসূতা নিয়ে প্রায়ই ভাবা হয় না। এই যেমন বক্স-কালভার্ট করা নিয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তেমনই ঢাকার অনেক খাল ও পুকুর ভরাট করে ফেলা নিয়েও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কেবল মাঠ আর দালান করার জন্য, রাস্তাঘাট বাড়ানোর জন্য, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য পানির আধার এসব পুকুর ও খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। ফলে শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশই নষ্ট হয়নি, ঢাকার সৌন্দর্যও নষ্ট হয়েছে। অথচ এগুলো থাকলে বর্ষায় জলাবদ্ধতা যেমন কিছুটা হলেও কমত, তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বহাল থাকত। ছোট একটি উদাহরণ দিলে দেখা যাবে, জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের বড় পুকুরটি ভরাটের কোনো প্রয়োজন ছিল না, ওটা থাকলেই বরং সৌন্দর্য বজায় থাকত; মৎস্য ভবনের বড় ডোবাটাও থাকতে পারত, রাসেল স্কয়ার থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত নির্মিত পান্থপথের বিলটি সংরক্ষণ করা যেত। ঢাকার যানজট নিরসনের জন্য নতুন নতুন রাস্তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ভবন সম্প্রসারণের তাগিদে এসব করা হলেও ঢাকামুখী জনজটের চাপে যানজট তো কমেইনি, বরং অযথা ঢাকাকে একটা গিজগিজে বস্তিতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এ অসহনীয় অবস্থা থেকে ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য ঢাকা ভাঙার (বিকেন্দ্রীকরণ) প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা বিশেষ প্রয়োজন।

নগর উন্নয়ন বিশারদরা কয়েক দশক ধরে যত ওয়াজ-নসিহতই করে থাকুন না কেন, একটা নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট করতেও এখনো সফল হতে পারেননি। এই যে হরেক সংস্থা-রাজউক, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, টিএন্ডটি বা বিটিসিএল, বিদ্যুৎ, গ্যাস কোম্পানি-এরা যার যখন দরকার রাস্তা খুঁড়ছে, কাটছে-সমন্বয় নেই। এক সংস্থা কাজ শেষ করে রাস্তা মেরামত করে দেওয়ার পরই আরেক সংস্থা আবার কাটছে। সারা বছর এমনতরো কাটাকাটি চলছে তো চলছেই। জনগণের কষ্টের কথা আর কে ভাবে! ছয় মাসের কাজ হয়তো বছরেও শেষ হলো না, একটু হলো তো সামান্য ফিনিশিংয়ের অভাবে পুরো কাজের সুফল আটকে থাকল, কার কথা কে শোনে! এমনতরো দুর্গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার উন্নয়ন। তবে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, উন্নয়ন কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক বেশি হবে, নাকি সারা দেশের বিভাগ এবং জেলাওয়ারি, উপজেলাওয়ারি, ইউনিয়নওয়ারি সুষম হবে। যে কোনো সরকার রাজনৈতিক কারণে ঢাকা দখলে রাখতে চায়, ঢাকাকে প্রশাসন ও রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে চায়। ঢাকা হাতছাড়া হলেই যেন তাদের পতন হয়ে যায়-এমনভাবে আন্দোলনও দমাতে চায়, রাজপথ দখলে রাখাটা তো যেন ফরজ কাজ। কেন রাজধানী ঢাকা নিয়ে এমন অহেতুক চিন্তা থাকতে হবে?

জীবনভোগের জন্য, সুস্থ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার জন্য মূল যে কয়টি বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, সেগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে দিলেই তো ঢাকার ওপর চাপ পড়ে না। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচার-প্রথমেই এ তিনটি সুযোগ বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হোক। ঢাকায় ছোট ছোট কোটরা-ভাটরায় আর গিজগিজ করে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, স্কুল গড়ে তোলা বন্ধ করে দেওয়া হোক। প্রশ্ন উঠবে, এত এত ঢাকাবাসীর তাহলে কী হবে? জনপ্রশাসন বিভাগ, জেলা, উপজেলায় স্থানান্তরিত হয়ে যাক, স্বাভাবিকভাবেই অধিবাসী কমে যাবে রাতারাতি। এরশাদের আমলে করা উপজেলাকেন্দ্রিক বিচারব্যবস্থা আবার চালু করা হোক। উচ্চ আদালত অন্তত বিভাগগুলোয় আবার নেওয়া হোক। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা হোক। প্রেসার গ্রুপের স্বার্থের কাছে তো আর দেশবাসীকে জিম্মি করে সব ঢাকাকেন্দ্রিক করা মেনে নেওয়া যায় না। আমি এরশাদের প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের মূল উদ্দেশ্যের প্রশংসা করি। কেউ কেউ তাকে স্বৈরাচার বলুক আর যাই বলুক, তার বেশকিছু কাজ তো জনকল্যাণে ছিল। জনপ্রশাসন সংস্কারে তার গৃহীত ব্যবস্থা, ঢাকার কিছু রাস্তাঘাট নির্মাণে তার সাহসী ভূমিকা, বন্যা নিয়ন্ত্রণে ঢাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ-এগুলো কি অস্বীকার করা যাবে? মেট্রোরেলের চমক দিয়ে তো আর ঢাকার যানজট কমানো যাবে না। ঢাকামুখী জনস্রোত কমানোর ব্যবস্থা না নিলে, উন্নয়নের গতি বিভাগ-জেলা-উপজেলায় সার্বিকভাবে সমন্বিত না করা হলে মেট্রোরেল ধরনের টোটকা-সুযোগে কিছু আরাম হয়তো পাওয়া যাবে; কিন্তু জনদুর্ভোগ তো আর কমবে না। বড় বড় সংস্থার প্রধান কার্যালয় সব কেবল ঢাকায় থাকতে হবে কেন? কার্যভিত্তিক বিবেচনায় এগুলো বিভাগওয়ারি সরানো হোক। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতেই পারে, যে কোনো সংস্কারে পরিবর্তনে এমন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ডিজিটাল যুগে তো এখন আর স্থান বড় বিবেচ্য হতে পারে না। ঢাকা দখলে রাখার মানসিকতা রাজনৈতিকভাবে পরিহার করতে পারলে অবশ্যই স্থানান্তর কোনো কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজনে কিছু মন্ত্রণালয়ও বিভাগীয় পর্যায়ে স্থানান্তরিত হতে পারে। এককেন্দ্রিক সচিবালয় ভাঙা হলে, জনপ্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ফলে জনপ্রশাসন সুষমভাবে দেশে বণ্টন তো হবেই, সঙ্গে বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণে আর ঢাকায় চাপ থাকবে না। শিক্ষার সুবিধার বিভাগ ও জেলা-উপজেলাওয়ারি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যের সুবিধা সম্প্রসারিত হলে কে আর ঢাকায় মরতে আসবে? স্বাভাবিকভাবেই আবাসন চাহিদাও আর ঢাকার জন্য প্রকট হবে না। নতুন নতুন আবাসিক প্রকল্প তখন বিভাগ ও জেলা-উপজেলায় সম্প্রসারিত হবে। প্রতিহিংসামূলকভাবে উপজেলা সিস্টেমকে অকার্যকর করে দিয়ে প্রথমে যে ক্ষতি করে ফেলা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে আবার উপজেলাকে প্রশাসনের মনোযোগে না নিয়ে যেভাবে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়, তাতেই জনপ্রশাসন ও উন্নয়ন আর স্থায়ী হতে পারছে না। বিভাগ-জেলা-উপজেলার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলেই তো উন্নয়নের সে ধাক্কা যাবে ইউনিয়নে এবং তখনই সত্যিকারভাবে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ হবে সারা দেশ।

বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ-এ তিনটি দূষণই তো প্রথমে বড়। এগুলো তো বড় হয়ে আছে ঢাকাতেই। খাদ্যদূষণ তো সারা দেশের বিষয়। তবে জনচাপে এর প্রভাব বেশি তো ঢাকাতেই। যানজট তো একা ঢাকার মুরসি তালুক। ঢাকা ভাঙা হলে এ দূষণগুলোও ভেঙে যাবে। ঢাকাকে তখন আর বারবার বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রথম হতে হবে না। শেখ হাসিনা উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছেন, যদি ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়নে আর মনোযোগ না দেওয়াই বেহেতর মনে করি। ঢাকা থাকুক রাজধানী, অবশ্যই ঢাকা তিলোত্তমা হোক; কিন্তু সবকিছু ঢাকায় হবে ভাবলে তো ঢাকা বস্তিতে পরিণত হবে। বস্তিবাসীর জন্য ঢাকায় এত এত আলিশান ভবন না করে এসব ভবন উপজেলায়-ইউনিয়নে করা হোক। কর্মচাঞ্চল্য ছড়িয়ে যাক উপজেলায়, ইউনিয়নে; অফিস-আদালত যেখানে যাবে, শিল্পকারখানা যেখানে যাবে, রিকশা-অটোরিকশা তো সেখানেই যাবে। সব তো মানুষ ও আয়কেন্দ্রিক। শিক্ষা-স্বাস্থ্য যদি ঢাকার বাইরে যায়, তাহলে আমরাই বা আর ঢাকায় থাকব কী প্রয়োজনে? আপাতদৃষ্টিতে যেহেতু মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতা আগামী দিনেও বজায় থাকবে, সেক্ষেত্রে নেতৃত্বে যেহেতু শেখ হাসিনাই থাকবেন, সেহেতু ঢাকা ভাঙার একটা সাহসী পদক্ষেপ তো একমাত্র তিনিই নিতে পারেন। একটা ভালো চমক আমরা তার কাছে আশা করি, কোনো খুচরা-খুচরা চমক কিন্তু চমক নয়। জাতীয় সংসদ সচিবালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু ঢাকায় থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয় অবশ্যই ঢাকায় থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও ঢাকায় রাখা যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও না হয় থাকল। অবশিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলো ছড়িয়ে যাক সারা দেশে, সাহস করে ভাবুন, ভালো হবে।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম