ব্যক্তি খাতে দেওয়া ঋণের অর্থও পাচার হচ্ছে
এম এ খালেক
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টির পরিবর্তে ২৬টি পণ্যকে স্থান দেওয়া এবং ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কোনো কোনো পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো শতভাগ মার্জিন আরোপ করায় পণ্য আমদানি বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সবচেয়ে সমস্যা দেখা দেয় আমদানি পণ্যের ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিতে পারছিল না। এখনো যে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দূর হয়েছে তা নয়। এসব নানা কারণে পণ্য আমদানি এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এরই প্রভাব আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে। পণ্য আমদানির আড়ালে একশ্রেণির ব্যবসায়ী দেশ থেকে ব্যাপক হারে অর্থ পাচার করছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপনকালে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছিলেন, কোনো কোনো পণ্যের আমদানি ব্যয় প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে ২০-২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। এ ধরনের বেশকিছু ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমের কাছে ধরা পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর উপস্থাপিত এ তথ্যের মাধ্যমে একটি ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি (জিএফআই) কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাপী মুদ্রা পাচারের ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। চিত্রটি কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের একশ্রেণির রাজনীতিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নানা উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকেন। অর্থ পাচারকারীরা সবসময়ই সরকারি ছত্রছায়ায় থাকেন বলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তবে একটি দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর পাচার হয়, এর কোনো সঠিক হিসাব কেউই দিতে পারবেন না। কারণ যারা অর্থ পাচার করেন, তারা কখনোই তাদের উপার্জিত অর্থের সূত্র ও পরিমাণ কারও কাছ প্রকাশ করেন না। কাজেই কেউ যদি পাচারকৃত অর্থের পরিসংখ্যান প্রদান করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি অনুমাননির্ভর তথ্য দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে। রাজনৈতিক সংকটময় দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়ে থাকে। কারণ যারা অবৈধ অর্থের মালিক এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন তারা মনে করেন, সরকার পরিবর্তন হলেই তাদের নানা ধরনের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে। তাই তারা উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা বিধানের জন্য তা বিদেশে পাচার করে দেন। কোনো কোনো দেশ আবার বিদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত অর্থকে তাদের দেশে স্বাগত জানায়।
যেমন, মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোম প্রকল্পের নামে বিদেশিদের পাচার করে আনা একটি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে তাদের দেশের নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে। এ ধরনের কার্যক্রম তাদের দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হলেও তা নৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। সম্প্রতি তুরস্ক সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। সেখানে অন্তত ২০০ বাংলাদেশি এ প্রকল্পের আওতায় তুরস্কে বসবাসের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে যারা মালয়েশিয়া বা তুরস্কে সেকেন্ড হোমের জন্য আবেদন করেছেন, তাদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর পণ্য আমদানিকালে অতিমূল্যায়ন এবং রপ্তানিকালে অবমূল্যায়নের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। কাজেই দেশে প্রতিবছর আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের যে চিত্র আমরা দেখতে পাই, তা প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলক নয়। কিছুদিন আগে অনেকটা হঠাৎ করেই আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত এসব পদক্ষেপের কারণেই আমদানি ব্যয় কমেছে-এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমদানি ব্যয় কমার পেছনে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট বা প্রাপ্যতার অভাবই বড় কারণ হিসাবে কাজ করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশ সাধারণত প্রতি মাসে ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে ৮১৪ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।
নভেম্বরে আমদানি ব্যয় হয়েছিল ৭৬১ কোটি মার্কিন ডলার। জানুয়ারিতে ৮০৫ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য। এমনকি ফেব্রুয়ারিতে পণ্য আমদানি হয়েছিল ৮১৮ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের নভেম্বরে ৭৭৩ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে পণ্য আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৬৩২ কোটি মার্কিন ডলার এবং ৬৩৫ কোটি মার্কিন ডলার। গত ফেব্রুয়ারিতে পণ্য আমদানি হয় ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলারের। আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মাসে ৫০৩ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক মনে করা যেতে পারে।
আমদানি সবসময় খারাপ নয়। তবে সেই আমদানি যদি বিলাসজাত পণ্য এবং যেসব পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা যায় তেমন পণ্য হয়, তাহলে তাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর উলটোটিই প্রত্যক্ষ করা যায়। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব তেমন পণ্যও বিপুল পরিমাণে আমদানি করা হয়। অনেকে তাদের আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার না করে বিদেশি পণ্য ব্যবহার করে থাকেন। বিদেশি পণ্যের প্রতি কিছু মানুষের এ অতি আগ্রহ স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদন সম্ভাবনাকে ব্যাহত করছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে সংকট প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তার পেছনে অর্থ পাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশ থেকে কীভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে তার একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। চলতি মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আগের মুদ্রানীতিতেও ব্যক্তি খাতে ব্যাংক প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।
এর আগের মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু সেই সময় ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ শতাংশের কিছু বেশি। তাই চলতি এবং গত মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কিছুটা কমানো হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ অতিক্রম করে গিয়েছিল। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ যদি সঠিকভাবে প্রদান করা হয়, তাহলে সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক।
কারণ ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পেলে এবং সেই ঋণের অর্থ যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়। তাই সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রদানের হার বৃদ্ধি পাওয়াটা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে প্রতীয়মান হতে পারত। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা নয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি হ্রাস পেয়েছে ৭৬ শতাংশ। কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশেরও বেশি। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, ব্যাংক থেকে ব্যক্তি খাতের জন্য যে ঋণ প্রদান করা হলো, তা কোথায় গেল? এটা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে, ব্যক্তি খাতে যে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হচ্ছে তার বেশিরভাগই অন্য খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে, বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।
আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। এবারও হয়তো এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। ব্যক্তি খাতে দেওয়া ব্যাংক ঋণ যদি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতো, তাহলে দেশে শিল্প-কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হতো। একইসঙ্গে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এতটা সংকটে পড়তে হতো না।
আমদানি ব্যয় সব ক্ষেত্রে খারাপ নয়। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কোনো অসুবিধা নেই, যদি তা হয় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি অথবা শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও কাঁচামাল। এ মুহূর্তে আমদানি বাড়ল না কমল সেটা যত না বিবেচ্য বিষয়, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোন্ পণ্য আমদানি হচ্ছে এবং আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্য প্রদর্শন করা হচ্ছে কিনা।
এমএ খালেক : অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড; অর্থনীতিবিষয়ক লেখক