Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণাম ভালো হয় না

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণাম ভালো হয় না

কয়েক দিন পরপরই খবরের কাগজে সরকারের সুদ ব্যয়ের ওপর নানা আতঙ্কজনক খবর প্রকাশিত হয়। এসব খবর পড়ে অনেক সময় মনে হয় সরকারের সব খরচ বোধহয় সুদ পরিশোধেই। এভাবে চললে সরকার চালানো ভীষণ কষ্টকর হবে। এ ধরনের খবরে কার না চিত্ত বিচলিত হয়। সত্যিই তো সুদ ব্যয়, প্রশাসনিক ব্যয়, ভর্তুকি ইত্যাদিতেই যদি সব টাকা শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?

বিশেষ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কপালে কী থাকবে? ইত্যাকার চিন্তাভাবনা সত্যি সত্যি বিচলিত হওয়ার মতো। এমনিতেই সুদ (ইন্টারেস্ট) বিষয়টি সমাজে সেভাবে আদৃত নয়। ধর্মীয়ভাবে তো ‘সুদ’ নিষিদ্ধই। এ কারণে দেশে ‘সুদ’ দেয় না, ‘সুদ’ শব্দ ব্যবহার করে না এমন ধরনের অনেক ব্যাংকের জন্ম হয়েছে। বস্তুত ব্যাংক খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তারাই নিয়ন্ত্রণ করে।

সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত তারা ভালোই করছিল। এখন পড়েছে সমস্যায়। এদিকে সামাজিকভাবেও ‘সুদ’ বিষয়টি অনাদৃত। এক সময় তো মহাজন ও সুদী ব্যবসা একটা বড় রাজনৈতিক ইস্যু ছিল। বস্তুত ভারত বিভাগের (১৯৪৭) অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এ মহাজনি-সুদী ব্যবসা, যার মাধ্যমে হাজার হাজার কৃষক হচ্ছিল ভূমিহীন, নিঃস্ব ও আজীবনের জন্য ঋণী। সে এক ভিন্ন ইতিহাস। সেদিকে না গেলেও সুদ এবং সুদবিষয়ক খবর শুনলে এখনো আমরা আঁতকে উঠি। বিশেষ করে সরকারের সুদ ব্যয়ের খবর পাঠ করলে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হই।

আবার দেখা যায়, এরই মধ্যে সঞ্চয়পত্রে প্রদত্ত সুদের পরিমাণের কথা শুনলে মিডিয়ার একাংশ সেই খবর খুবই বড় করে ছাপায়। শুধু সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদ নয়, সুদ খরচ সরকারের অন্যান্য ঋণেও। সরকার বিদেশ থেকে ঋণ করলে তার ওপর সুদ দিতে হয়। দেশের ভেতর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার অল্প সুদে ঋণ নিয়ে শেষ বিচারে আমানতকারীদের ঠকায়। আবার ঋণ নেয় সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও, যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অন্যায্য-এটা মূল্যস্ফীতির জন্ম দেয়। সব ক্ষেত্রেই সরকারকে সুদ দিতে হয়। বিনা সুদে সরকার কোনো ঋণ পায় না।

হ্যাঁ, ঋণের বদলে সরকার বিদেশিদের কাছ থেকে অনুদান/‘এইড’ পেতে পারে, যার পরিমাণ এখন সামান্য। অতএব সরকার তার নানাবিধ প্রয়োজন মেটানোর জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণগ্রহণ করে। এ নিয়ে কথা উঠছে, কারণ দেখা যাচ্ছে সরকারের সুদ ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। এর অর্থ ঋণও বাড়ছে। ঋণ বাড়লে সুদ ব্যয়ও বাড়বে। আবার সুদের হার বৃদ্ধি পেলেও সুদ ব্যয় বাড়বে। এ দুটি ঘটনাই এখন ঘটছে। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের সুদ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের সুদ ব্যয় ছিল ৪২ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে অবশ্য সুদ ব্যয় ছিল মাত্র ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এই হিসাব বাজেটের সঙ্গে তুলনা করেও করা যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় হবে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মাত্র ১১ দশমিক ৯ শতাংশ হচ্ছে সুদ ব্যয়। এর আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ সামান্য কম ছিল।

পরিমাণে এবং শতকরা হিসাবে যাই হোক না কেন, সুদ ব্যয় খুব ভালো খবর নয়। সুদ ব্যয় বললেই বুঝতে হবে ঋণের ওপর ব্যয়। আবার ঋণের মূলও শোধ করতে হয়। মূল ও সুদের টাকা পরিশোধ দুই-ই জাতির ওপর বোঝা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বোঝা। এখানেই সমস্যা। নিজেরা ঋণ করলাম, শোধ করে গেলাম-ভালো কথা; কিন্তু ঋণ করে সুদসহ সব বোঝা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেলাম-এটা কোনোভাবেই ভালো খবর নয়। অথচ এ কাজটি আমরা নিয়মিত করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে-কেন; দ্বিতীয় প্রশ্ন-এর কি কোনো বিকল্প নেই এবং তৃতীয় প্রশ্ন-বিকল্প থাকলে কেন আমরা সেই পথে যাচ্ছি না? আরও প্রশ্ন আছে।

ঋণ করে মানুষ বিপদে পড়লে, জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য। আবার কখনো কখনো স্থায়ী সম্পদের জন্য-অর্থাৎ স্থায়ী সম্পদ আহরণে সম্পদের ঘাটতি মেটানোর জন্য। বলা বাহুল্য, সরকারও প্রায় একই কারণে ঋণ করে। অবশ্য বলতেই হয়, সরকার দৈনন্দিন খরচ বহনের জন্য সাধারণত ঋণ করে না। স্বাধীনতার পর থেকে দেখা যাচ্ছে আমাদের বাজেট হচ্ছে ঘটতি বাজেট। অর্থাৎ যে টাকা দরকার তা আমরা সংগ্রহ করতে পারছি না। তাই প্রতিবছর সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে। পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, রাজস্ব আয় দিয়ে রাজস্ব ব্যয় মোটামুটি আমরা বহন করতে পারি।

উন্নয়নের জন্য আমাদের টাকা নেই। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির জন্য আমাদের টাকা নেই। এটা প্রতিবছরের ঘটনা এবং ৫০-৫২ বছরের ঘটনা। আমরা এ বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছি না। কোনোভাবেই আমাদের রাজস্ব আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। বলা যায় স্থবির অবস্থা। জিডিপির সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিই পাচ্ছে না। যাকে বলা হয় ‘কর-জিডিপি’ অনুপাত, তা খুবই কম। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও। এটা লজ্জাজনক বিষয়, আত্মসমালোচনার বিষয়।

আমরা ঋণ করছি উন্নয়নের জন্য। ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। অতএব সুদের পরিমাণও বাড়ছে। বাজেটের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই যে খবর, তা কি আনন্দের কথা? ঋণ করে অবকাঠামো করা কেমন ঘটনা, তা ব্যক্তির একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি। ঋণ করে যারা ফ্ল্যাট/বাড়ি/জমি ক্রয় করেন, তাদের কী অবস্থা হয় তা সবারই জানা। সারা জীবন লেজে-গোবরে অবস্থায় থাকতে হয়। অন্ধকার থাকে ভবিষ্যৎ। ঋণ করে উন্নয়ন করে সুদ পরিশোধ করে, আসল পরিশোধ করে ভালো থাকা যায়, যদি ওই অবকাঠামো থেকে ‘রিটার্ন’ ভালো আসে।

এখানেই আমাদের সমস্যা। আমাদের অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। অনেক প্রকল্পের খরচ অতিরিক্ত। এক টাকার কাজ দুই টাকা, তিন টাকায় করা হয়। প্রকল্প শেষ না করেই টাকা নিয়ে নেওয়া হয়। তিন-চার-পাঁচ বছরে স্কুল বিল্ডিং ধসে পড়ে। একবার রাস্তা মেরামত করলে পরের বছরই তা অকেজো হয়ে পড়ে। বাঁশ দিয়ে রডের কাজ করা হয়। বালু-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয় কম। পরামর্শদাতা, ঠিকাদার, নকশা তৈরিকারীরা সব টাকা নিয়ে যায়। যারা ঋণ দেয়-বিদেশি সংস্থা, তারা নানাভাবে দেশীয়দের যোগসাজশে প্রকল্পের দাম স্ফীত করে দেখায়।

অনেক ক্ষেত্রে সুদের হারের থেকেও বেশি। বাজে বাজে শর্ত থাকে যাতে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়। এসবের ফল কী? ফল একটাই-অনেক প্রকল্প, অবকাঠামো থেকে আমরা আশানুরূপ ফল পাই না। অথচ ঋণের বোঝা, সুদের বোঝা বহন করতে হচ্ছে। বহন করতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। এখানেই আমাদের সমস্যা। এবং সমস্যা সরকার কর্তৃক চিহ্নিত। বহুল আলোচিত। মন্ত্রী মহোদয়রা এসব বলছেন। কাগজে প্রতিদিন এসব খবর ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অনেকের মতে, তা-ও সই। হোক উন্নয়ন, চলুক উন্নয়নের কাজ। বাড়ুক জিডিপি, বাড়ুক মাথাপিছু আয়।

মাথার উপর দিয়ে চলুক মেট্রোরেল। শহর হোক তিনতলা। নিচতলায় মেট্রোরেল, উপরে রাস্তা-সড়ক, এর উপরে ওভার পাস। হোক, বাড়ুক বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা-ব্যবহার করতে পারি আর না পারি। বলা বাহুল্য, এসব যুক্তির যে কোনো মূল্য নেই তা বলা যাবে না। এটা আমিও মানতে রাজি। তবে একটা কথা আছে। এসব হোক নিজের টাকায়, ঋণের টাকায় নয়। এসব উন্নয়নের কাজ, অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলুক রাজস্ব উদ্বৃত্তের টাকা দিয়ে। হতে পারে ঋণ, যা হবে নামমাত্র। মুহূর্তে যা শোধ করে দেওয়া যায়। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নয়। জাতীয় শক্তি এখানেই, বাজেটের শক্তিও এখানেই, যদি আমরা রাজস্ব উদ্বৃত্তের টাকা দিয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) করতে পারি।

ঋণের টাকায় সব উন্নয়ন-এ নীতি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। অবশ্যই দরকার। তাহলে উন্নয়নের টাকা আসবে কোত্থেকে? কে জোগাবে অধিকতর ট্যাক্স বা কর? দেশবাসী কি রাজি হবে বেশি বেশি ট্যাক্স দিতে? তারা কি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন দ্বারা নির্মিতব্য অবকাঠামো নির্মাণের টাকা জোগাতে রাজি হবে? অনেক প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে বলতে পারি, রাজস্ব বৃদ্ধি করা দরকার। আর এখন তা করতেই হবে। কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত আছে। ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে হলে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি করতে হবে। এখানেই আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ।

এমনিতেই মানুষ চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে। সংসার চালাতে পারছে না। রোজা সামনে। পবিত্র এ উৎসবকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের ‘নর্তন-কুর্দন’ শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। সব ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। ১ মার্চ থেকে আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১১ বার। ফলে সব জিনিসের দাম বাড়বে। সামনে বাজেট। আশঙ্কা, আরেক ধাক্কা আসছে তখন। ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কোন পর্যায়ে যাবে তা বলা যায় না।

অথচ আমাদের বিকল্প আছে। সেই বিকল্পে সরকার কেন পা বাড়াবে না? কেন গরিব-মধ্যবিত্তকেই সব করের বোঝা টানতে হবে? এটা এখন ধনীদের সংস্থা স্বয়ং আইএমএফই চায় না। একটি খবরে দেখলাম, আইএমএফ চটেছে পাকিস্তানের ওপর। সেই দেশ ধনীরা লুট করছে। এসব খবর কাগজে আসছে। আইএমএফ বলেছে, ধনীদের ওপর করারোপ করতে হবে। ধনীদের থেকে কর গ্রহণ ও গরিবদের ভর্তুকি দিতে হবে।

ভাবা যায়, পুঁজিবাদীদের সংস্থা আইএমএফ বলছে এসব কথা! শুধু পাকিস্তানে নয়, একই খবর পাচ্ছি মালয়েশিয়া থেকে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি ‘ধীর’ অর্থনীতি সমর্থন করছেন। বাজেট ঘাটতি কমাতে ব্যয়-হ্রাস ও ধনীদের ওপর করারোপের পরিকল্পনা নিচ্ছেন তিনি। দেখা যাচ্ছে, তার দেশে আয় ও সম্পদ ধনী ও অভিজাতদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তিনি এতে উদ্বিগ্ন। অতএব ‘বুঝহ সুজন’। ধনী, অতিধনী, ধনাঢ্য, বিত্তশালীদের ওপর করারোপ করা হোক। কর রেয়াতের ঢালাও ব্যবস্থা বন্ধ হোক।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম