স্বদেশ ভাবনা
খাটো করে দেখার সুযোগ নেই
আবদুল লতিফ মণ্ডল
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র সম্মেলনে কাকে দাওয়াত দিল আর না দিল, তার পরোয়া শেখ হাসিনার সরকার করে না।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কোস্টারিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস ও জাম্বিয়া কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন আগামী ২৯ ও ৩০ মার্চ ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটি হবে দ্বিতীয় বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবার এ সম্মেলন আয়োজন করেছিল। সে সম্মেলনে ১১০টি দেশের প্রায় সাড়ে সাতশ প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। সে সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রণ পায়নি। তখন ঢাকার তরফ থেকে পরবর্তী সম্মেলন অর্থাৎ দ্বিতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছিল।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপসহ বিশ্বের ১১১টি দেশ আমন্ত্রণ পেয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আয়োজিত বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ তথা পুরো সম্মেলনকে গুরুত্বহীন মনে করছেন। আসলে কি তাই?
যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে গণতন্ত্র যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, যৌথভাবে সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে কী ধরনের প্রতিশ্রুতি, সংস্কার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন।
প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ওই সম্মেলনে মূলত যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় সেগুলো হলো-ক. গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং কর্তৃত্ববাদ প্রতিহত করা; খ. দুর্নীতি চিহ্নিত করা ও প্রতিহত করা; গ. মানবাধিকার নিশ্চিত করতে ইতিবাচক প্রচারণা। মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, কর্তৃত্ববাদী সরকারকে প্রতিহত করা, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা-এ তিন লক্ষ্যে অঙ্গীকার পূরণের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে দ্বিতীয় সম্মেলনে আলোচনা হবে।
এখন দেখা যাক, আসন্ন দ্বিতীয় বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলনে আলোচনার বিষয়-গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ, দুর্নীতি দমন এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান কোন পর্যায়ে। সম্প্রতি দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ‘গণতন্ত্র সূচক ২০২২’ প্রকাশ করেছে। নির্বাচনব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারের সক্রিয়তা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি-এ পাঁচ মানদণ্ডে একটি দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ১০ পয়েন্টভিত্তিক এ সূচক তৈরি করেছে ইআইইউ।
সূচকে প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে ইআইইউ দেশগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে এবং সেগুলো হলো-পূর্ণ গণতন্ত্র (full democracy), ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (flawed democracy), মিশ্র শাসন (hybrid regime) এবং স্বৈরতন্ত্র (authoritarian regime)। যেসব দেশের স্কোর ৮ বা এর বেশি, সেগুলো পূর্ণ গণতন্ত্র; যেসব দেশের স্কোর ৬-এর বেশি এবং ৮-এর কম, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র; যেসব দেশের স্কোর ৪-এর বেশি এবং ৬ বা এর কম, সেগুলো মিশ্র শাসন এবং যেসব দেশের স্কোর ৪ বা এর নিচে, সেগুলোর অবস্থান স্বৈরতন্ত্র ক্যাটাগরিতে।
গণতন্ত্র সূচক ২০২২-এ বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩তম। গত বছরের মতো ৫.৯৯ স্কোর নিয়ে তালিকার ক্রমিকে ৭৬ থেকে ৭৩-এ এগিয়ে এলেও গণতন্ত্রের ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হয়নি। ২০০৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ মিশ্র শাসন ক্যাটাগরিতেই রয়েছে। অথচ ২০০৬ সালে গণতন্ত্রের ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল এক ধাপ উপরে, অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ক্যাটাগরিতে। কেন এ অবস্থা? এর মূল কারণ হলো, গত এক দশকে কোনো নির্বাচন-তা জাতীয় বা স্থানীয় সরকার যে পর্যায়েই হোক-সুষ্ঠু বা অংশগ্রহণমূলক হয়নি। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল ৮টি দল দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-সদস্য হওয়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের ৫০ শতাংশের বেশি আসনে অর্থাৎ ১৫৪টি আসনে আওয়ামী লীগ ও তাদের গুটিকয়েক সহযোগী দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় দশম সংসদ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। তবে অনিয়মের দিক থেকে অতীতের সব সংসদ নির্বাচনের রেকর্ড ভেঙে ফেলে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি হলো-নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত দিনের আগের রাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ব্যালট বাক্সে ভোট প্রদান।
দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচন শুধু যে অংশগ্রহণহীন ও সুষ্ঠু হয়নি তা নয়, এ দুটি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যবর্তী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়নি। ২০২১ সালে বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের নির্বাচনও অনেকটা একদলীয়ভাবে অর্থাৎ মূলত সরকারদলীয় প্রার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি সূচকে এক ধাপ অবনতি হয়ে ২০২১ সালে বিশ্বে ১৩তম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ থেকে ২০২২ সালে নিুক্রম অনুযায়ী ১২তম অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে। পরবর্তী টানা চার বছর (২০০২-২০০৫) খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময়কালে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিল। বাংলাদেশে দুর্নীতি হ্রাস না পাওয়ার জন্য বিশ্লেষকরা যেসব কারণ চিহ্নিত করেছেন, সেগুলোর শীর্ষে রয়েছে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। দেশে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠা করলেও তারা সংস্থাটিকে পুরোপুরি কার্যকর করতে তেমন উৎসাহী ছিল না। তাছাড়া দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য এমন সব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা বিএনপির আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করেন। চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দুদকের কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ছিল-ক. দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালীকরণ, খ. দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন, গ. ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ জমা প্রদান, ঘ. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুস, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতেই রয়ে গেছে।
নবম সংসদ নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ মানবাধিকার লঙ্ঘন কঠোরভাবে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনি ইশতেহারে দলটি প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের রেকর্ড মোটেই সন্তোষজনক নয়। সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। সংবিধান মানুষের জানমাল রক্ষার নিশ্চয়তা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও বিভিন্নভাবে এগুলোর কার্যকারিতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে গণমাধ্যম কর্মী ও মুক্তচিন্তার মানুষ হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। মোট কথা, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার অসন্তোষজনক অবস্থা বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশকে তলানিতে নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক আইনের সূচক-২০২১-এ ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপাল, শ্রীলংকা ও ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের উপরে।
সবশেষে যা বলতে চাই তা হলো, বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগদানে আমন্ত্রণ না পাওয়াকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি কেন, সাংবাদিকরা তা জানতে চাইলে সম্প্রতি ঢাকা সফরকারী মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে বলেছেন, ‘গতবার যেসব দেশকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ও যাদের আমন্ত্রণ জানাইনি, তাদের পরের বছর গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা দিতে বলা হয়েছিল। এটি সম্মেলনে অংশগ্রহণের অন্যতম শর্ত ছিল।’ বাংলাদেশে গণতন্ত্র যে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে তার প্রমাণ সময়ে সময়ে প্রকাশিত বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকগুলো। গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে সরকার কেন কর্মপরিকল্পনা দিল না, তার ব্যাখ্যা সরকারই দিতে পারে। তবে সচেতন মানুষ মনে করেন, গণতন্ত্র সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ না পাওয়া সরকারের জন্য না হলেও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানজনক। বিশেষ করে যখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপ আমন্ত্রণ পাচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশা, সরকার তাদের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com