Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বদেশ ভাবনা

ক্ষুধা সূচকে অবনমন কেন

Icon

আবদুল লতিফ মণ্ডল

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষুধা সূচকে অবনমন কেন

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই)-২০২২’, যা আমাদের কাছে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক নামেও পরিচিত।

বিশ্বের ১২১টি দেশের তথ্য এতে স্থান পেয়েছে। রিপোর্টের উপক্রমিকায় বলা হয়েছে, 'This year's Global Hunger Index (GHI) brings us face to face with a grim reality. The toxic cocktail of conflict, climate change, and the COVID-19 pandemic had already left millions exposed to food price shocks and uvlnerable to further crises. Now the war in Ukraine-with its knock-on effects on global supplies of and prices for food, fertilizer, and fuel is turning a crisis into a catastrophe. The 2022 global GHI score shows that progress in tackling hunger has largely halted.'

সংক্ষেপে এর অর্থ দাঁড়ায়, এ বিশ্ব ক্ষুধা সূচক আমাদের একটি নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। বিভিন্ন ধরনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ইতোমধ্যেই লাখ লাখ মানুষকে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সংকটে পড়তে হয়েছে। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ এবং খাদ্য, সার ও জ্বালানি মূল্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব সংকটকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ থেকে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বে ক্ষুধা মোকাবিলায় অগ্রগতি অনেকাংশে থেমে গেছে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ অনুযায়ী বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। গত বছর এ অবস্থান ছিল ৭৬তম। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়ে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ উঠে আসা তথ্য ও ফাইন্ডিংস এবং এ সূচকে কেন বাংলাদেশের অবনতি হলো, তা পর্যালোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক নির্ধারণে চারটি মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়। এগুলো হলো-এক. অপুষ্টির হার, দুই. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে উচ্চতার তুলনায় কম ওজনের শিশুর হার, তিন. পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে কম উচ্চতার শিশুর হার, এবং চার. পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর হার। ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর নির্ধারণ করা হয়। ক্ষুধার তীব্রতা নির্ধারণে পাঁচটি লেভেল বা স্তর রয়েছে। স্তরগুলো হচ্ছে-নিম্ন (low), মাঝারি (moderate), গুরুতর (serious), ভয়ংকর এবং অতি ভয়ংকর (extremely alarming)। ৯.৯ বা এর নিচের স্কোর অর্থ ক্ষুধার তীব্রতা নিম্নপর্যায়ে। আর ১০-১৯.৯, ২০-৩৪.৯, ৩৫-৪৯.৯, ৫০ বা এর বেশি স্কোর বলতে যথাক্রমে মাঝারি, গুরুতর, ভয়ংকর ও অতি ভয়ংকর ক্ষুধার তীব্রতাকে বোঝায়। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়ার অর্থ হলো, সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো, সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

এবারের সূচকে ৫-এর নিচে স্কোর পেয়ে সবচেয়ে ভালো অর্থাৎ শীর্ষ অবস্থানে থাকা ১৭ দেশ হলো-বেলারুশ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, হাঙ্গেরি, কুয়েত, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মন্টিনিগ্রো, নর্থ মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, স্লোভাকিয়া, তুরস্ক ও উরুগুয়ে। আর সূচকের তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে অর্থাৎ সবচেয়ে নিচে থাকা ৫টি দেশ হচ্ছে-ইয়েমেন, সেন্ট্রাল আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মাদাগাস্কার, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও চাদ।

জিএইচআই-২০২২ যেসব গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-ক. সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বে ক্ষুধা মোকাবিলায় অগ্রগতি অনেকাংশে থেমে গেছে। যথেষ্ট পরিমাণে ক্যালরি গ্রহণ করতে পারছে না এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন ধরনের সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটবে। খ. দারিদ্র্য, বৈষম্য, সুশাসনের অভাব এবং কৃষিতে নিম্ন প্রবৃদ্ধি হার ক্ষুধাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়তা করছে। গ. সাহারার দক্ষিণের আফ্রিকায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চরম ক্ষুধা বিরাজমান। এ দুটি অঞ্চলে ক্ষুধা মোকাবিলায় অগ্রগতি অনেকটা থেমে গেছে। ঘ. অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্ষুধার মাত্রা নিম্নস্তরে আনার যে প্রক্ষেপণ জিএইচআই-২০২২ রয়েছে, এর বাস্তবায়ন হবে না। বিশ্বের ২৪টি দেশে বর্তমানে ক্ষুধার তীব্রতা গুরুতর বা ভয়ংকর স্তরে রয়েছে। জিএইচআই-২০১৪-এর তুলনায় ২০টি দেশে মাঝারি, গুরুতর বা ভয়ংকর স্তরে স্কোর বেড়ে গেছে। ঙ. দেশে দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টি মাত্রায় পার্থক্য বিরাজমান।

এদিকে পাঁচটি আন্তর্জাতিক সংস্থা-জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রধানরা গত বছরের শেষদিকে এক যৌথ সতর্ক বার্তায় বলেছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস, পরিবহণব্যবস্থায় বিঘ্নসহ নানা কারণে আগামী দিনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট আরও তীব্র হবে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে। এতে মানুষের মধ্যে পুষ্টির সংকট আরও প্রকট হবে, যা বিশ্বের একটি অংশকে মহামারির দিকে নিয়ে যাবে। এমন সম্ভাব্য দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা চার দফা সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো-উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়াতে সহায়তা করা, স্বচ্ছতার উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং যৌথ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা এবং খাদ্যব্যবস্থার রূপান্তরে বিনিয়োগ বাড়ানো। এর আগে গত জুলাইয়ের শেষদিকে ডব্লিউএফপি জানিয়েছিল, করোনা মহামারি, সংঘর্ষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০১৯ সালের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে সাড়ে ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, করোনা মহামারি শুরুর আগে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৩ কোটি। এরপর এ সংখ্যা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সংঘর্ষের ফলে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা খাদ্য ঘাটতি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী পুষ্টিহীনতা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম, যা গত বছর ছিল ৭৬তম। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ বাংলাদেশ ৮ ধাপ পিছিয়েছে। সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উপরে আছে শ্রীলংকা ও নেপাল। বাংলাদেশের নিচে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তান। বাংলাদেশ শেষোক্ত ৩টি দেশের উপরে থাকলেও আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ নেই।

আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) আর্থিক সহায়তায় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ উদ্যোগে তৈরি ও প্রকাশিত বাংলাদেশ আন্ডারনিউট্রিশন ম্যাপ বা অপুষ্টি মানচিত্র ২০১৪-এর ফাইন্ডিংসের মধ্যে রয়েছে-ক. গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতিসাধন হলেও, দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলেও, প্রধান খাদ্য চালে স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রায় সক্ষম হলেও, জন্মহার ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও এবং শিক্ষার হার বেড়ে গেলেও পুষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। মূলত ক্রয়ক্ষমতার অভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা প্রয়োজনীয় আমিষজাতীয় খাবার খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে অপুষ্টির হার বাড়ছে। ‘দ্য স্টেট অব ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দি ওয়ার্ল্ড-২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। করোনা মহামারির কারণে আয় হ্রাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি প্রভৃতি কারণে বর্তমানে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের পক্ষেও আমিষজাতীয় খাবার সংগ্রহ কষ্টকর হয়ে পড়ায় অপুষ্টির হার ইতোমধ্যে আরও বেড়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩৯টিতে খর্বাকৃতি শিশুর এবং ৫৫টি জেলায় কম ওজনের শিশুর হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি।

গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০২২-এ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর তালিকায় ৮ ধাপ পিছিয়ে গেলেও ১৯.৬ স্কোর করে ক্ষুধার তীব্রতায় মাঝারি স্তরেই রয়েছে। তবে এতে আমাদের আত্মপ্রসাদ লাভের সুযোগ নেই। আফ্রিকার বেশকিছু দেশসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাদের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম