Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সিন্ডিকেট কারসাজির নিয়ন্ত্রণ জরুরি

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সিন্ডিকেট কারসাজির নিয়ন্ত্রণ জরুরি

দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, গুরুতর অপরাধে লঘু শাস্তি, যৎসামান্য অর্থ জরিমানায় দণ্ড লাঘব, অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে অপরাধীদের আড়াল করার কদর্য আচরণ পুরো সমাজকেই পর্যুদস্ত করে চলছে।

শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা-প্রতিষ্ঠানে ঘুস-দুর্নীতি-অনিয়ম-অপকর্ম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, জনগণ অতিশয় বিপর্যস্ত। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশে ভৌত অবকাঠামো, ডিজিটালাইজেশন, সড়ক-জনপথ-সেতু, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গৌরবোজ্জ্বল অর্জন কতিপয় দুষ্টচক্রের কারসাজিতে ম্লান হতে পারে না।

মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হায়েনা কর্তৃক সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত স্বাধীন মাতৃভূমি পুনরুদ্ধারে সততা-নিষ্ঠা-প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। দুর্নীতি-কালোবাজারি-মুনাফাখোরি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সামরিক-বেসামরিক আমলাসহ দেশের জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বর্তমানে অর্থলিপ্সু ঘৃণ্য এসব সিন্ডিকেট নানা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম শুধু অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে না, দেশে অরাজক-অস্থিতিশীল পরিস্থিতিও সৃষ্টি করছে। এদের কঠোর আইনের আওতায় এনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে আগামী পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাজার পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠবে।

বঙ্গবন্ধু বারবার ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, দেশের সম্পদ পাচারকারী, মজুতদার এবং অর্থ-ক্ষমতার মোহে পাগলপ্রায় মানুষ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করেছেন এবং বাংলার দুঃখী মানুষের সুখ-শান্তি ও দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা সেনানিবাসে অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রাঙ্গণে ব্যাচ পাসিং আউট প্যারেডে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এত রক্ত দেওয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনো ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি।...বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজ, এই ঘুসখোর, এই মুনাফাখোরি, এই চোরাকারবারিদের নির্মূল করতে হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুক।’

দেশে চলমান নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় চলতি মাসের শুরু থেকেই অস্থির ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম। গত ১০ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি কেজি ২০০-২১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগির দাম চাওয়া হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫০-৫২০ টাকা। অন্যদিকে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৪০ টাকা দরে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে আরও ৫-১০ টাকা বেশি দামে। কোথাও কোথাও প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকা দরেও বিক্রির সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, ‘ডিমের বাজারে সিন্ডিকেটের বিষয়টি পরিষ্কার। কারণ যখন আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল, তখন একটি ডিমের দাম পাঁচ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হলো। সে সময় আমরা মাঠে নামলাম। নিলামের নামে একটি সাজানো ঘটনার মধ্য দিয়ে ডিমের দাম বাড়ানোর প্রমাণ মিলল। যে কোম্পানি দাম বাড়াল তার সংবাদ সারা দেশে ছড়িয়ে গেল। এরপর যখন অভিযান চলছে, তখন ডিম আমদানি করার ঘোষণা হলো। তখন আবার তিনদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে গেল বাজার; কিন্তু এর মধ্যে একটি টাকাও বাড়তি দাম পেল না প্রান্তিক খামারিরা। ভোক্তার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল সে সিন্ডিকেট।’

গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরে বাজারে চালের কোনো ধরনের সংকট না থাকা সত্ত্বেও মিল মালিকরা অনেক সময় চালের দাম বাড়িয়েছে। ২০২২ সালের জুনে মিলারদের যোগসাজশে চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। নভেম্বরে চাল তৈরিতে খরচ বাড়ার অজুহাতে ভরা আমন মৌসুমে প্রতি কেজি চালের দাম ৮-১৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। নভেম্বর থেকে বেড়েছে আমদানিনির্ভর পণ্য সব ধরনের ডালের দাম। বিভিন্ন সময় দাম বাড়ানোর জন্য চিনির সরবরাহ বন্ধ রেখে সংকট সৃষ্টি করেছিল কোম্পানিগুলো। সরকার বারবার দাম বেঁধে দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি সরবরাহ সংকটের কারণ দেখিয়ে প্রতি কেজি চিনি ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্তিমিত থাকলেও আদা-রসুনের দাম কেজিতে বড়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। টিসিবির ভাষ্যমতে, বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি আটা ৭০ শতাংশ এবং ময়দা ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে ৭০-৭৫ এবং ৭৫-৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে প্যাকেটজাত আটা ও ময়দা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ১১টি নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য এক বছরের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এবং জ্বালানি তেল-ডলারের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির অভাবে বাজারে পণ্যমূল্যের উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশি। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও ছিল আকাশছোঁয়া। ফলে বিগত বছর থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সাধারণ ক্রেতারা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ সংসার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্লেষকরা আরও বলেন, করপোরেট মাফিয়াদের দাপটে কোণঠাসা সবাই, তাই হয়তো সরকার কঠোর হতে পারছে না। কিছুদিন আগে কারণ ছাড়াই বেড়েছে ডিম-মুরগির দাম। তারও আগে চলেছে ভোজ্যতেল ও চালের কারসাজি। অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বারবার দুর্ভোগে পড়ছে দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ। আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর তারা নিজেদের ইচ্ছামতো পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে ও কমাচ্ছে। কারসাজি চক্রের লাগাম টানতে সরকার মাঝেমধ্যেই অভিযানসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবুও থেমে নেই অসাধু চক্রের দাপট।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি আসন্ন পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে পণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ভোজ্যতেল-চিনির মূল্যবৃদ্ধির পেছনে মিল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা একে অপরকে দায়ী করেছেন। খুচরা বিক্রেতাদের মতে, পণ্যের গায়ে লেখা দামের চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করা হয় না বা করাও যায় না। পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ-মিলগুলো তেল-চিনির রসিদ দিচ্ছে এক দরে আর টাকা নিচ্ছে অন্য দরে। মিল মালিকদের দাবি-রসিদ ছাড়া মিল গেট থেকে পণ্য বিক্রি হয় না। যারা পণ্য কিনছেন তারা রসিদ নিচ্ছেন। সংগঠনটির সভাপতি নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের প্রতি ‘কালো ব্যবসা’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘পণ্য কেনাবেচার সময় রসিদ না দেওয়া কিংবা এক দামের রসিদ দিয়ে অন্য দাম নেওয়া-এগুলো ব্যবসায়ের কালো অধ্যায়। লাভ করবেন আর কাগজ দেবেন না, এটা হবে না। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ব্যবসা করতে হবে। খারাপ কিছু মানুষ থাকতে পারে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। অল্পকিছু ব্যবসায়ীর এমন আচরণে পুরো ব্যবসায়ী সমাজের দুর্নাম হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতবার সবাই প্রতিজ্ঞা করলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হবে না। কিন্তু ঈদের দুই দিন আগে বাজার থেকে তেল হাওয়া হয়ে গেল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে আবার বাসার খাটের নিচ থেকেও তেল উদ্ধার করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব। এবার আমরা ঘোষণা দিতে চাই-রোজা ও ঈদে অযৌক্তিকভাবে তেল-চিনির দাম বাড়াবেন না। ব্যবসায়ীরা শুধু মুনাফাখোর, উৎসব-পার্বণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, এ তকমা থেকে এবার বেরিয়ে আসতে চাই।’ এটিও সত্য, পর্যাপ্ত চাহিদা মোকাবিলায় নিত্যপণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোর আরোপিত বিভিন্ন শর্তের কারণে এলসি খুলতে সঠিক সহায়তা পাচ্ছে না বলে ব্যবসায়ী পক্ষের অভিযোগ রয়েছে।

বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সরকার ইতোমধ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চালের বাজার স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের জুলাইয়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বাজার মনিটরিং জোরদারের সঙ্গে সঙ্গে দু’দফায় আমদানি শুল্ক ৬২ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্পমূল্যে ওএমএস কার্যক্রমও নেওয়া হয়। গত ৪ জানুয়ারি দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির সভায় খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও আমদানিকাররা রমজানে নিত্যপণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি দাম নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার আশঙ্কা এড়াতে নিত্যপণ্য আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে ডলার সরবরাহে বিশেষ কোটা সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। ওই সভায় মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার সুবিধার্থে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার রাখার প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হবে। তবে নিত্যপণ্যের আমদানিতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেইস টু কেইস ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের এলসি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জোরালো পদক্ষেপ নেবে। এর ফলে আমদানিকারকরা ক্ষেত্রবিশেষে এলসি ছাড়াই বিশেষ ব্যবস্থায় সুনির্দিষ্ট পণ্য আমদানি করতে পারবেন।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি’ বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে সিন্ডিকেট কারসাজির বিরুদ্ধে কোনো নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়; দেশ ও জনগণের সার্বিক স্বার্থ নিশ্চিতকরণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি মনে করি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম