Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে

Icon

সালাহ্উদ্দিন নাগরী

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সবার আগে নিজেকে ভালোবাসতে হবে

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, এ দিনকে ভ্যালেনটাইনস ডেও বলা হয়। শুধু তরুণ-যুবক নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষ আজকের এ দিনটি পালন করছে। এ দিনটি যেন প্রিয়জনের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করার দিন। তাই আমেরিকা ও পাশ্চাত্যে এ দিন পালনকারীরা দিনটির ব্যাখ্যা করেছে এভাবে : It is a day of love, where candy, flowers and gifts are exchanged. সারা পৃথিবীতে কত মেট্রিক টন কেক, ক্যান্ডি ও ফুল বিক্রি হবে সে হিসাব এ মুহূর্তে নেই। ভালোবাসাপিয়াসীরা প্রিয়জনের মন জয় করার জন্য বিভিন্ন কার্ড, চকলেট, কেক, আংটি, ঘড়ি ও বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি প্রিয়জনকে উপহার দিচ্ছে।

ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্যে রমরমা অবস্থা বিরাজ করে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, মোবাইল ফোন অপারেটরসহ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের অফার ও চমকের মাধ্যমে এ যুগের ‘ভ্যালেনটাইনদের’ আকৃষ্ট করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে এ দিবসকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও অনেক দেশে মোটামুটিভাবে একটা হিসাব পাওয়া যায়। কোনো কোনো দেশ আবার দিনটি উদযাপনে অর্থকড়ি খরচের সম্ভাব্য একটা হিসাব আগেই প্রকাশ করে থাকে। গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, এ বছর দিনটি উদযাপনে প্রায় ১৪ কোটি আমেরিকান অন্তত ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার খরচ করবে। ৫৩ শতাংশ মার্কিনি সব কাজকর্ম বন্ধ রেখে প্রিয়জন নিয়ে দিনটি উদযাপনে মেতে উঠবে। সেদেশে সঙ্গীর জন্য খরচে পুরুষরা এগিয়ে আছে। স্ত্রীর জন্য স্বামীর গড়ে ৩৫৭ ডলার খরচের বিপরীতে স্ত্রী খরচ করে ২০৫ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের ২০২২ সালের সার্ভেমতে, একজন ছেলে তার মেয়ে বন্ধুর জন্য গড়ে ১০৮.৩৮ ডলার এবং একজন মেয়ে তার ছেলে বন্ধুর জন্য গড়ে ৪৯.৪১ ডলার খরচ করেছিল। তারপর শিশু-সন্তান ও নিজের জন্যও তো কিছু অর্থ বরাদ্দ থাকে। মার্কিন মুল্লুকে এ দিবসকে ঘিরে একটি কথা চালু আছে-Roses are red, violets are blue, if you don't spend big on Valentine's day, your partner might end things with you.

এই যে সঙ্গীর প্রতি এত ভালোবাসা, এত অনুরাগ, তারপরও কি কাঙ্ক্ষিত সুখ আসছে? পৃথিবীতে প্রতিদিন কত লক্ষ-কোটি প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরের হাতে হাত রাখছে, ভালোবাসার বাণী আওড়াচ্ছে, ঘর বাঁধছে। তারপরও ‘ভালোবাসা’ কেন জানি ‘নিখাদ ভালোবাসা’ হতে পারছে না। প্রেম-প্রতারণা, বন্ধু-বান্ধবসহ প্রেমিকার শ্লীলতাহানি, আবেগঘন মুহূর্তের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া দিন দিন বেড়েই চলেছে। লজ্জা-অপমানে কত মেয়ে যে জীবন দিয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।

সীমিত অর্থে ভালোবাসাকে যদি প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা কী দেখি? পরস্পরের মধ্যে অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব, সন্দেহপ্রবণতা বাড়ছে। পরস্পরের প্রতি সৎ থাকাটা কেন কঠিন হয়ে যাচ্ছে? ভালোবাসা দিবসের প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারগুলো কেন ভেঙে যাচ্ছে? প্রতিনিয়ত বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখের সামনে এ অপ্রিয় খবরগুলো কেন বারবার ভেসে উঠছে? আমাদের ভালোবাসায় কি ঘাটতি আছে? আমরা কি ভালোবাসাকে ছেলেখেলায় পরিণত করেছি? ক্ষণিকের মোহে জ্ঞানহারা হয়ে যাচ্ছি, নিজের নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, বিশ্বাস জলাঞ্জলি দিচ্ছি; কিন্তু কেন?

আসলে এ দিনে কার প্রতি ভালোবাসা? ভালোবাসা কি শুধু একটি দিনের জন্য? সত্যিকার ভালোবাসা তো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ-উপলক্ষ্য ছাড়াই সবসময় স্ফুরিত হওয়ার কথা। চারদিকে এত ভালোবাসার পরও মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। ভালোবাসা কেমন হলে স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকাকে পরস্পরের দ্বারা নির্যাতিত ও প্রতারিত হতে হবে না? বৃদ্ধ মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না, সন্তানকে নেশায় আসক্ত হতে হবে না? মানুষে-মানুষে হিংসা-দ্বেষ, হানাহানি, মারামারি থাকবে না?

কেন ‘ভালোবাসা’ আমাদের বিবেক, বুদ্ধি ও উপলব্ধিকে পরিশীলিত এবং অন্যকে আপ্লুত করতে পারছে না? কেন অন্যের প্রতি ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা, অসহিষ্ণুতা উগরে দিচ্ছে? এ ভালোবাসায় কি খাদ আছে? ‘আমাদের ভালোবাসা’য় কি প্রতারণা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাসা বেঁধেছে? যার ভেতরে প্রেম-ভালোবাসা আছে, সে তো অন্যকে প্রতারিত করতে পারে না।

এই যে ভালোবাসার এত এত প্রকাশ, তা কি আমাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক-সামাজিক জীবনে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে? এ ভালোবাসাকে আমরা কি মহৎ কোনো কর্মযজ্ঞে প্রভাবক বা উদ্দীপক হিসাবে কাজে লাগাতে পারছি? যদি না পেরে থাকি, তাহলে ঘাটতি কোথায়? তাহলে কাকে, কখন, কীভাবে ভালোবাসলে এ পৃথিবীতে শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস বইবে? আসলে অন্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরির ‘উৎসমুখ’কেই আমরা পরিশুদ্ধ করতে পারিনি। তাই ভালোবাসা পথ হারিয়ে ফেলছে।

যার ভালোবাসা অন্যকে প্রশান্তি দিতে পারে না, সমাজে স্বস্তি ফেরাতে পারে না, মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে না, সে হয়তো নিজেকেই ঠিকভাবে ভালোবাসে না। যে নিজেকে ভালোবাসে, সে নিজ দায়িত্বে অবহেলা, অন্যায় ও পাপ করতে পারে না। নেশায় বুঁদ হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতে পারে না। তার অন্ধকারের ভয় থাকে, আলোর আকুতি থাকে। পৃথিবীর সব প্রেম-ভালোবাসা, শুভ কামনার উৎপত্তি নিজের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থেকে। সব প্রেমই নিজের প্রতি ভালোবাসার উপজাত। নিজেকে ভালোবাসলে, নিজের নীতি, আদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতিও ভালোবাসা জন্মে। তখন এগুলোর প্রতি অবিচল থাকতে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করা যায়, তবে আত্মহত্যা করা যায় না। যে নিজের প্রতি ভালোবাসায় বিশ্বস্ত হতে পারে না, সে অন্যকে ভালোবাসায় সৎ থাকতে পারে না। ফলে অন্যের প্রতি ভালোবাসাটা অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম হয়ে যায়, লোক দেখানো ভালোবাসা থেকে কখনোই সুখকর কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। যারা হটকারী সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না, তাদের দ্বারা এ পৃথিবী কখনোই নিরাপদ হতে পারে না। নিজের প্রতি যার ভালোবাসা থাকে না, তার দ্বারা মহৎ কোনো কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। মহৎ কাজ করার জন্য সুস্থ দেহের পাশাপাশি প্রশান্ত মনও দরকার। যে ভালোবাসায় কেউ নিজেকেই আপ্লুত করতে পারে না, সে ভালোবাসা দিয়ে অন্যকে প্লাবিত করবে কীভাবে? যার অন্তরে নিজের প্রতি ভালোবাসার বারি বর্ষিত হয় না, তার হাতে গোলাপ কুঁড়ি কীভাবে প্রস্ফুটিত হবে? নিজের প্রতি ভালোবাসাহীন রুক্ষ-শুষ্ক মানুষের মধ্যে সুস্থ মন কীভাবে বিরাজ করবে?

দুর্নীতি, সমাজে অগ্রহণযোগ্য কাজে মানসম্মান ক্ষুণ্ন হয়, সমাজে হেয় হতে হয়। তাই যে নিজেকে ভালোবাসে, সে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অপদস্ত হয়ে নিজেকে ছোট করতে চাইবে না। ফলে সে মন্দ কাজ করা থেকে বিরত থাকবে। এভাবে সবাই যদি অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকে, তাহলে পুরো সমাজই পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে।

নিজেকে ভালোবাসার অপর নাম সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। আর শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ কখনোই কারও অনিষ্ট করতে পারে না। কাউকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। আর এ ধরনের মানুষই তো সোনার মানুষ। সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনে এ রকম সোনার মানুষই তো আমরা চাই। তাই সক্রেটিসের ‘নিজেকে জানো’র মতো বলতে ইচ্ছা করছে, নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের শরীর ও মনকে ভালোবাসুন, আর শরীর ও মন নিয়েই তো একেকটি ব্যক্তিসত্তা। নিজের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে দিনক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না, আর্থিক সংগতি-অসংগতি বিবেচনায় আসে না। পরিশুদ্ধ জীবনযাপনই জানান দেবে একজন মানুষ নিজেকে কতটুকু ভালোবাসে। আর নিজের প্রতি এ ভালোবাসা থেকেই তৈরি হতে পারে অন্যের প্রতি নির্ভেজাল ও সতেজ-শুভ্র ভালোবাসা। তাই সুখী পরিবার, সমাজ ও দেশ গঠনের স্বার্থে সবার আগে নিজেকে ভালোবাসুন প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত।

সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী

snagari2012@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম