চেতনায় বুদ্বুদ
কত বিচিত্র এই রাজনীতি!
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৬ জানুয়ারি ২০২৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নির্মিত মঞ্চ হঠাৎ ভেঙে পড়ে। শোভাযাত্রা উদ্বোধনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তৃতা দেওয়ার সময় বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে ঘটে এ ঘটনা। মঞ্চ ভেঙে পড়াটা একটা দুর্ঘটনা, এমনটি হতেই পারে।
এটা তো সামান্য একটা মঞ্চ মাত্র। ভারী নির্মাণের কত কাঠামোই তো হঠাৎ হঠাৎ ভেঙে পড়ে। কয়েক বছর আগে মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পথচারী সেতুর গার্ডার ভেঙে পড়ল, চট্টগ্রামের বহদ্দার হাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের বিশাল গার্ডার ভেঙে পড়ল, এই সেদিন বিমানবন্দর সড়কে ক্রেন থেকে বড় গার্ডার একটি গাড়ির ওপর পড়ে গেল।
নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই সেতু, কালভার্ট, এমনকি বাড়ির ছাদ ধসে পড়ার ঘটনা তো হরহামেশাই খবর হয়। ওসব ঘটনায় জীবনহানি ঘটে। মর্মান্তিক মৃত্যুর করুণ চিত্র চোখের সামনে জীবন্ত হয়। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে বাঁশ-খুঁটির কিংবা কাঠের ফ্রেমের একটি মঞ্চ ভেঙে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ নিয়ে হাসি-তামাশার কিছু আছে বলে নিশ্চয় বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা মতপ্রকাশ করবেন না।
তবে ছোট হলেও ঘটনাটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এক. আমাদের দক্ষতা নিম্নমানের, তাই নির্মাণে ত্রুটি থেকে যায়। যাবে না-ই বা কেন? আমরা তো একটু সুযোগ পেলেই রডের পরিবর্তে বাঁশের কঞ্চিও ব্যবহার করি, নাকি? আবার পর্দা কেনায়, বই কেনায় কিংবা বালিশ কেনায় আমরা অবিশ্বাস্য মূল্যের মহাঝলকানি দেখাই। বীর উত্তম খেতাবধারী হলেও ঠিকাদারি করার সময় সেতু অসমাপ্ত রেখে আমরা বিল নিয়ে নেই। অতিলোভের চরিত্র নিয়ে আমরা দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে পারি না।
দুই. যদি বলা হয়, মঞ্চ নির্মাণে নির্মাণগত ত্রুটি ছিল না, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ওঠায় এমন বিপত্তি ঘটেছে-তাহলেও তো বলতে হয়, সেটাও অদক্ষতা। ধারণক্ষমতার বেশি মানুষের মঞ্চে ওঠা ঠেকাতে না-পারাও এক চরম অদক্ষতা। নির্মাণকাজের কোনো ত্রুটি আদৌ থেকে থাকলেও তার চেয়ে বেশি অদক্ষতা এ ম্যানেজমেন্ট-ব্যর্থতা। একটি মঞ্চই যদি ম্যানেজ করা না গেল, তাহলে এরা পরে দেশের নেতা হলে দেশ কীভাবে ম্যানেজ করবে, তা বুঝতে কি বেশি ভাবতে হবে?
তিন. ছাত্রলীগের শৃঙ্খলার যে চরম অবনতি ঘটেছে তা কি আর বলতে, গত কয়েক বছর ধরেই তো ছাত্রলীগের শৃঙ্খলা-বহির্ভূত কর্মকাণ্ড হরহামেশাই পত্রিকার রসালো খবর হচ্ছে। তাদের মাস্তানি, নিজেরা-নিজেরা মারামারি, পুলিশের সামনে অস্ত্রবাজি, হলে হলে দখলদারি, গেস্টরুম কেলেঙ্কারি, টেন্ডারবাজি, নিরীহ ছাত্রীকে নেতার ‘খেদমতে’ প্রেরণ, চাঁদাবাজি-কোনটা ফেলে কোনটা বলি!
ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চে নেতার অহেতুক আধিক্য নিয়ে ছাত্রলীগেরই সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের আগেও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। গত ডিসেম্বরেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি তো হয়ইনি বরং বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। এবারের মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনায় দেখা গেল ধারণক্ষমতার অনেক বেশি মানুষ মঞ্চে উঠেছেন। আমাদের প্রশ্ন হলো, ছাত্রলীগ কি তাহলে নেতৃত্বদানে ব্যর্থ হচ্ছে?
ছাত্রলীগ কি তাহলে শৃঙ্খলা বজায় রাখায় ফেল মেরে চলেছে? এটা কিসের লক্ষণ? অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যর্থতার চরম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। বড় ছাত্রসংগঠন হিসাবে নেতা বেড়েছে বলা কোনো গ্রহণযোগ্য বক্তব্য হতে পারে না। সংগঠন বড় হলে নেতা তো বাড়বেই, সেক্ষেত্রে কর্মীও বাড়বে; তাই বলে তো বড় নেতা আর ছোট নেতা সব একাকার হয়ে যেতে পারে না। মঞ্চে কারা থাকবে আর কারা থাকবে না, তার একটা ফর্দ তো আগে থেকেই থাকার কথা।
যদি বলা হয়, তা ছিল কিন্তু মানা হয়নি, তাহলে আবার তো একই জায়গায়-অর্থাৎ নেতৃত্ব ফেল মারছে বলেই কেউ কাউকে মানছে না। আমরা এমনও তো দেখি যে, নেতার উপস্থিতিতেই মারামারি হয়, চেয়ার ছোড়াছুড়ি হয়, মঞ্চেও ধস্তাধস্তি হয়। এটা কি একটানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে সৃষ্ট দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব, নাকি সবাই কেবল নেতা হতে চায়, আরও বড় নেতা, আরও বড় নেতা-এমন ভাব দেখানোর জন্য মঞ্চে ওঠার লড়াই? যেটাই হোক, লক্ষণটা আমাদের হতাশ করে।
আমাদের রাজনীতির হালহকিকত দেখলে দেখতে পাই, ছাত্ররাজনীতি করেই বেশিরভাগ ছাত্রনেতা পরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ব্যবসায়ীরা টাকার জোরে দলীয় পদ-পদবি ভাগানোর জন্য হালে বেশ এগিয়ে এলেও তাদের লক্ষ্য থাকে মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। তাদের অনেকেই মূলত দুদিনের যোগী ভাতকে অন্ন বলার শ্রেণিভুক্ত। তারা কেউ এমপি হতে পারলেই খুশি, কেউবা মেয়র, কেউবা আরেকটু বড় বিনিয়োগ করতে পারলে মন্ত্রী।
কিন্তু ছাত্ররাজনীতি করে আসা নেতার চেয়ে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, তারা বেশি নামিও যেমন হন না, তেমনি বেশি ত্যাগীও হন না। তারা সুযোগসন্ধানী, আন্দোলন-মিছিল-মিটিংয়ে গা-বাঁচিয়ে চলেন, টাকা ব্যয় করে তারা ক্ষমতায় আসন দখলে রাখতে পটু। ছাত্ররাজনীতি করে উঠে আসা নেতারা ‘চোর-ডাকাত’ হলেও তারা দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা পালন করেন, লালন করেন। আমরা আগে তা-ই দেখে এসেছি।
কিন্তু এখন দেখছি, ছাত্ররাজনীতির আগের দিন আর নেই। এখন ছাত্রদের কাছেও রাজনীতি একটি অর্থ উপাজর্নের বড় ও সহজ মাধ্যম। পরে বড় নেতা হতে পারলে ভালো, না হতে পারলেও এখন নগদ-নগদ যা পাওয়া যায় তা-ই যথেষ্ট। এখন তাদেরও ভাবটা হচ্ছে, নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক। তাই আমরা এখন ছাত্রনেতা শুনলে ভয় পাই, অনেক দূরে থাকতে আগ্রহী হই। আগে ছাত্রনেতা শুনলে যে সম্মান দেওয়া হতো, তা এখন যেন রূপকথা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো ছাত্ররাজনীতি এবং শিক্ষক-রাজনীতি পছন্দ করিনি, এখনো করি না। ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের মঙ্গলে হওয়ার কথা, তা আর এখন নেই; এখন লেজুড়বৃত্তিই বড়। শিক্ষক-রাজনীতি শিক্ষক ও শিক্ষার কল্যাণে হওয়ার কথা, তা আর এখন নেই; এখন শিক্ষক-রাজনীতি হচ্ছে কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করে নিজের আখের গোছানো মাত্র।
রাজনীতির হালহকিকতে লীগের রাজনীতি নিয়ে একটা রসালো বয়ান এক বোদ্ধা একবার দিয়েছিলেন। তিনি রসালোভাবে বলেন, যারা লীগ করে তারা জন্মের পর হয় শিশুলীগ, পরে হয় কিশোর লীগ, তারপর ছাত্রলীগ, এরপর যুবলীগ, তারপর আওয়ামী লীগ। শেষ বয়সে যারা আর আওয়ামী লীগেও টিকে থাকতে পারেন না, তাদের বেশিরভাগ তখন হয়ে যান তবলিগ। ভদ্রলোকের রসবোধ উপভোগ করলাম; কিন্তু রাজনীতিতে ছাত্রলীগের অধঃপতন দেখে খুব হতাশ হলাম।
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা নেতাদের অনেকেই আমাদের নমস্য। তাদের কারও কারও পদস্খলন কিংবা দুর্নীতি আমরা কমবেশি জানলেও তাদের ছাত্ররাজনীতিকালীন আদর্শ ও অবদান আমরা এখনো স্বীকার করি। ছাত্রলীগ ছাড়াও ছাত্র ইউনিয়নের (আগের ইপসু) বেশ কজন নেতা পরে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন। তবে বাম রাজনীতির এসব নেতা ক্ষমতার জন্য নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দিতেও সময়-সুযোগে কার্পণ্য যেমন করেননি, তেমনি অন্য বড় দলের মার্কা নিয়ে ভোট করে জোটের নামে তাদের পদতলে লুটিয়ে পড়তেও দ্বিধা করেননি। ক্ষমতার লোভ, নগদ প্রাপ্তির প্রত্যাশা তাদের নীতি থেকে বিচ্যুত হতে মোহাবিষ্ট করেছে তখন।
তখন তারা আর ‘নীতির ক্ষেত্রে আপস নেই’-তে থাকতে পারেননি; তারা তখন ‘আপসের বেলায় নীতি নেই’-তে চলে গিয়েছেন। কিন্তু আমি হতবাক হই, ছাত্রলীগের চার খলিফার দুজন শাজাহান সিরাজ এবং আ স ম আব্দুর রবের বিচ্যুতি দেখে। সিরাজ না হয় মন্ত্রিত্বের জন্য বিএনপিতে নিজেকে সোপর্দ করেছিলেন, কিন্তু পতাকা-উত্তোলনকারী রব কেন যে জাসদ করে বঙ্গবন্ধুকে অস্থির করে তুলেছিলেন, তা আমার মাথায় আসে না। জাসদ গঠনে সিরাজুল আলম খানের হঠকারী সিদ্ধান্তও আজও এক অনুদ্ঘাটিত রহস্যই রয়ে গেল। অথচ তারা না বঙ্গবন্ধুর কত আপনজন ছিলেন!
তারপরও দেখি বিশাল হৃদয়ের অধিকারী বঙ্গবন্ধু তাদের ‘সাইজ’ করেননি। তারপরও দেখি, শেখ হাসিনা পিতার উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে রবকে ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রী করেন। বোধকরি এটাও রাজনীতি! রাজনীতিতে কেউ চির শত্রুও নয়, চির বন্ধুও নয় যেমন উচ্চারিত হয়, তেমনি বহুল উচ্চারিত রয়েছে যে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই তো দেখি, একসময় যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছিল, পরবর্তী সময় তাকেই আবার মিত্র বানানো হয়েছে। আহারে রাজনীতি আমাদের-তোমাকে চেনা বড় দায়; অতএব ম্যাকিয়াভেলি জিন্দাবাদ।
আবার মঞ্চ ভেঙে পড়ায় ফিরে আসি এবং শেষ করি। মঞ্চ ভেঙে পড়ার খবরে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছি। অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে-এটা দুঃসংবাদ অবশ্যই। কিন্তু আমার বড় ভয় ছিল ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে। মাত্র তিনি সিঙ্গাপুর থেকে চেকআপ সেরে এসেছেন। মঞ্চ ভেঙে পড়ার কারণে যদি তার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত, তাহলে কী করুণ পরিণতি হতো!
আল্লাহ তাকে হেফাজত করেছেন-আমরা শোকরিয়া আদায় করি। মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনা নিয়ে অন্য রাজনীতিকদের তেমন উদ্বেগ আমরা দেখলাম না। সহানুভূতি-সহমর্মিতা যেন এখন রাজনৈতিক ভব্যতার বাইরে চলে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে বরং কেন জানি মনে হচ্ছিল, বড় কোনো অঘটন ঘটে গেলেই হয়তো অনেক রাজনীতিক খুশি হতেন! ছাত্রলীগেরই সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব যখন বলেন, ‘ক্ষমতার মঞ্চও ভেঙে পড়বে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ জানুয়ারি ২০২৩), তখন মনে পড়ে যায় অনেকটা যেন-কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস। বর্তমান ছাত্রলীগেরও কি কারও কারও আবার অতীতের ছাত্রলীগের রবের দশা হবে-তা-ই এখন ভাবতে হচ্ছে আমাদের।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান