নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আরও বাড়বে
ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘মুদ্রা’ নেই। এর অর্থ টাকা নেই, ডলার নেই। অর্থের অভাব, ডলারের অভাব। অবশ্য অভাব নেই মূল্যস্ফীতির। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা করেছে মুদ্রানীতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুনের জন্য। এটা ষাণ্মাসিক ‘মানিটারি পলিসি’-মুদ্রানীতি। এখন দেশে বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়। এক কথায় জানুয়ারি-জুনের মুদ্রানীতির আলোচনা শেষ করে দেওয়া যায়। বলা যায়-‘যথা পূর্বং তথা পরং’।
অর্থাৎ এ মুদ্রানীতিতে নতুন কিছু নেই। উদ্ভাবনীমূলক কোনো ধারণা নেই। বরাবরের মতো এবারও মুদ্রানীতি দেওয়া হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ঘোষণা আশা করা হয়েছিল, তার কিছুই নেই এতে। যেমন, মনে করা হয়েছিল ডলারের মূল্য নির্ধারণে বাজারকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। তা হয়নি। যথারীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ বহাল আছে। বাজারের নীতি হয়েছে উপেক্ষিত। আমানতের ওপর থেকে ‘ক্যাপ’ তুলে নেওয়া হবে আশা করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, এর বিপরীতে ঋণের সুদের ওপর থেকেও ‘ক্যাপ’ তুলে নেওয়া হবে। না, তা হয়নি। আমানতের ওপর ‘ক্যাপ’ ছিল সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ‘ক্যাপ’ তুলে নিয়েছে।
বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলো তাদের সাধ্যমতো আমানতের ওপর সুদ দিতে পারবে। কিন্তু এর সঙ্গে সম্পর্কিত ঋণের ওপর সুদ? ঋণের ওপর সুদ না বাড়লে ব্যাংকগুলো কীভাবে আমানতের ওপর সুদের হার বাড়াবে-এ মৌলিক প্রশ্নের জবাব নেই। অবশ্য বর্তমানে বিপদে পড়ে কিছু ব্যাংক আমানতের ওপর ৬ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। এটা অবশ্যই তাদের জন্য লাভজনক কোনো ব্যবসা নয়। যারা সংকটে পড়ে, ফান্ডের অভাব মেটাতে বেশি দামে আমানত নিচ্ছে, তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে কীভাবে পোষাবে? কঠিন এক প্রশ্ন।
এতে ওইসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার ওপর ভীষণ চাপ পড়বে সন্দেহ নেই। এই বোঝা তাদের লাভপ্রদতার ওপর পড়বে। পুঁজি সংরক্ষণ, প্রভিশন সংরক্ষণ ইত্যাদির ওপর পড়বে, যদি না তারা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে তা পোষাতে পারে। কিন্তু দক্ষতা বৃদ্ধির জায়গা কোথায়? জনশক্তির খরচ কমিয়ে, প্রশাসনিক খরচ কমিয়ে? বলাই বাহুল্য, এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ খুবই কম। খেলাপি ঋণের চাপ কমিয়ে? তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
ব্যবসায়ীদের ওজর-আপত্তির শেষ নেই। করোনা ছিল একটা অজুহাত, এখন যুদ্ধ। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের ঝুঁকি কমানো কঠিন একটি বিষয়। তাহলে থাকে কী? এর উত্তরে ‘স্প্রেডে’র (আমানতের ওপর সুদ এবং ঋণের ওপর সুদের পার্থক্য) কথা বলা যায়। সবকিছু বিবেচনা করেই মুদ্রনীতি-‘নয়-ছয়’ করা হয়। অর্থাৎ ‘স্প্রেড’ হবে তিন শতাংশ। ৩ শতাংশ ‘স্প্রেড’ ধরে ৭ শতাংশ আমানতের সুদ হলে ১০ শতাংশ হতে হয় ঋণের ওপর সুদ। ৮ শতাংশ হলে ঋণের ওপর সুদের হার হতে হয় ১১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর কোনো কোনোটি ৭-৮ শতাংশ হারে আমানত নিচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন, ৯ শতাংশ ঋণের ওপর সুদে তারা লোকসানের মুখ দেখবে কিনা?
দেখা যাচ্ছে, ঋণের ওপর সুদ বাড়ানো হয়েছে ভোক্তাঋণে। ব্যাংকগুলো ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করতে পারবে এক্ষেত্রে। কিন্তু বাকি ঋণে সুদের হার ৯ শতাংশ। এটা যেমন যুক্তি? ভোক্তাঋণ নেয় নিুমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত। তাদের ওপর বোঝা চাপানো গেলে বড় বড় ঋণগ্রহীতার ঋণের সুদ বাড়ানো যাবে না কেন? মধ্যবিত্ত ভোক্তাঋণের সুদের চাপে পড়বে বর্তমান মুদ্রানীতিতে। এটা তাদের প্রতি অবিচার ছাড়া কিছুই নয়। বলা হয়েছে, এতে নাকি ঋণের চাহিদা কমবে। অথচ বড় প্রশ্ন, মোট ঋণের কত শতাংশ ভোক্তাঋণে যায়? বড়জোর ১০ শতাংশ।
১০ শতাংশে সংকোচন নীতি অনুসরণ করে ৯০ শতাংশকে ছেড়ে দিলে কী লাভ হবে? ইতোমধ্যেই আলোচনায় আছে ৯ শতাংশীয় ঋণ সস্তায় পেয়ে অনেক গ্রাহক টাকা অন্যত্র খাটাচ্ছে। ফান্ড ডাইভার্ট করছে। ফান্ডের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। সস্তার তিন অবস্থা! যেখানে ঋণের ওপর সংকোচন নীতি করা দরকার, সেখানে দেখা যাচ্ছে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বেশি। সস্তায় বেশি ঋণের পরিণতি কী হবে?
বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। পূর্ববর্তী ছয় মাসে তা বেড়েছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। আবার সরকারের ঋণের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, সরকারকে ঋণ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। স্বাভাবিকভাবেই এই ঋণ ‘হাই পাওয়ার্ড মানি’। এতে ‘রিজার্ভ মানি’ বাড়ছে/বাড়বে। এতে তো মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আরও বাড়বে। অথচ মূল্যস্ফীতি ঠেকানো হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব এবং মুদ্রানীতির লক্ষ্য।
মুদ্রানীতি পাঠে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫। রপ্তানি বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ ও আমদানি বাড়বে ১০ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স বাড়বে ৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে হবে ৩৬ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। ছয় মাসের মুদ্রানীতিতে ‘রেপো’ হার এবং ‘রিভার্স রেপো’ হার দশমিক ২৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ডলারের বিনিময় হার এ বছরের শেষদিকে মোটামুটি বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।
তবে চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তিনটি : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের পলিসি রেইট এবং করোনার নতুন ঝুঁকি। মুদ্রানীতির শিরোনাম করা হয়েছে ‘সতর্কমূলক মুদ্রানীতি’। বলা বাহুল্য, এসব বর্ণনা, লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন কম। মূল প্রশ্ন অন্যত্র। এ মুহূর্তে দেশের অর্থনীতিতে তিনটি বড় সংকট উপস্থিত-ডলারের সংকট, টাকার সংকট এবং মূল্যস্ফীতির সংকট। ডলার সংকট মোচনের কথা মুদ্রানীতিতে কিছুই নেই। যথারীতি এর দাম পূর্বনির্ধারিত। বলা হয়েছে, রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রাপ্তি সমান সমান করার চেষ্টা করা হবে, যাতে আমদানির ফলে ডলারের চাহিদা না বাড়ে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বর্তমান মূল্যস্ফীতি আমদানিজনিত। আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়াতেই এই মূল্যস্ফীতি। কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু সর্বাংশে সত্য বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে অস্ত্র হলো : নীতি সুদহার, স্টেটুটরি লিক্যুইডিটির রেশিও (এসএলআর), ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর), রিজার্ভ মানি, ব্রড মানি, ঋণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। মূল কথা, বাজারে টাকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। প্রশ্ন, ‘রিজার্ভ মানি’ বৃদ্ধি পেলে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়লে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ালে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হবে কীভাবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক এসবে মৌলিক কিছু না করে আমদানি ঋণপত্রের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রত্যাশা, এতে ডলারের ওপর চাপ কমবে। কিন্তু পণ্যের সরবরাহ হ্রাস পেয়ে মূল্য তো বৃদ্ধি পেতে পারে। এই যেমন এ মুহূর্তে পবিত্র রমজান মাসকে উপলক্ষ্য করে প্রচুর আমদানির দরকার। কিন্তু ডলারের অভাবে ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। এর প্রভাব কি মূল্যস্ফীতিতে পড়বে না? বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি, সরকারি ঋণ (বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে) বৃদ্ধি পেলে বাজারে অর্থ সরবরাহ তো বাড়বেই। অবশ্য কথা আছে। মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে শুধু মুদ্রানীতি যথেষ্ট নয়।
মূল্যস্ফীতির যাতনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে রাজস্বনীতিও কাজে লাগাতে হবে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে নয়। এটি নির্ভর করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর। কর হ্রাস করে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে একটা ব্রেক কষা যেতে পারে। আরও কথা আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ইতোমধ্যে অনেক নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। খবরে দেখা যাচ্ছে, সরকার চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন ও আদাজাতীয় ১০টি পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে ভারতের সঙ্গে একটা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। এসবের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি যদি আগামী ৩-৪-৬ মাসে কিছুটা কমে, তাহলে এতে তো বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কৃতিত্ব থাকবে না। এটা হবে বর্তমান মুদ্রানীতির বাইরের ফল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কারিগরি হতে পারত ঋণকে সহজলভ্য না করা। ঋণের ওপর সুদের হার বাড়ানো। তা তারা করেনি। কারণ এতে ব্যবসায়ীদের ‘কষ্ট’ বাড়বে। এটা ব্যবসায়ীবান্ধব সরকার কী করে করবে? সরকারের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল-ব্যবসায় সুদের খরচ মোট খরচের কত শতাংশ। এ কথাটা আলোচনায় নেই। কেন ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণে নির্ভরশীল না হয়ে শেয়ারবাজারে যাচ্ছে না-এ কথা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ব্যাংকে ঋণের ওপর সুদের হার বেশ উঁচুতেই ছিল অনেকদিন। প্রশ্ন করা দরকার ছিল-উচ্চ সুদে ব্যবসা করে তাদের রপ্তানি কমেছিল কিনা। নিশ্চিতভাবে এ প্রশ্নের উত্তর-না। রপ্তানি তখনো বাড়ছিল। তখন সম্ভব হলে এখন সম্ভব নয় কেন? এ ছাড়া সস্তা ঋণের আরও কুফল নিয়ে বাজারে কানাঘুষা আছে। সস্তা ঋণের টাকার একটা অংশ একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশে পাচার করছে বলে অভিযোগ আছে।
এ অবস্থায় ঋণের ওপর সুদের ‘ক্যাপ’ তোলাই ছিল মুদ্রানীতির কাজ। তা করা হয়নি। যদি হতো তাহলে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো স্বস্তিতে ব্যবসা করতে পারত। স্বস্তি পেত আমানতকারীরাও। ব্যাংকগুলো আমানত ও ঋণের সুদের হার সমন্বয় করে নিজেদের মুনাফাও বাড়াতে পারত, আমানতকারীদেরও ভালো সুদ দিতে পারত। এতে ব্যাংকে আমানতের প্রবাহও বাড়ত। আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হতে উৎসাহিত হতো, যা এ মুহূর্তে ভীষণ দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ব্যাংকের ‘ক্যাশ’ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। নতুন আমানত নেই। অথচ ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে যথারীতি। এর ফল দুটো : বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংক খাতে প্রচুর ‘ক্যাশ’ সরবরাহ করতে হচ্ছে। আমি ইসলামী ব্যাংকগুলোর কথা বলছি না। তাদের সংকট আরও তীব্র অনিয়মের ফল।
সাধারণভাবেই দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেকেই এসএলআর/সিআরআর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে কি ‘লিক্যুইডিটির’ ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তৈরি হচ্ছে না? ব্যাংকগুলো উপায়ান্তর না দেখে যাচ্ছে আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেটে (কলমানি মার্কেট)। সেখানে সুদের হার চড়তে চড়তে ৭-৮-৯ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ দুদিন আগেও কলমানি মার্কেটে কোনো গ্রাহক ছিল না। এই যে সংকট তা অবশ্যই আমানতের সংকট। মানুষ ‘ক্যাশ’ জমা দিলে তার নাম হয় আমানত বা ডিপোজিট। মানুষের সঞ্চয় কম। যাদের সঞ্চয় আছে, তারা ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহী নয়। কারণ ব্যাংকে টাকা রাখলে টাকা হ্রাস পায়।
মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ, আমানতে সুদ সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। ৩ শতাংশ লোকসান। এ অবস্থা থেকে ব্যাংকগুলো ও আমানতকারীদের রক্ষা করার দরকার ছিল। এটি বর্তমান মুদ্রানীতিতে হয়নি। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ঋণের ওপর সুদের ‘ক্যাপ’ তোলা হলো না। বড় বড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হলে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমানতকারীরা, চাপে থাকবে ব্যাংকগুলো, কারণ তাদের উচ্চ সুদে আমানত নিতে হবে বাঁচার জন্য। এখন তারা উচ্চ সুদে আমানত নিতে পারবে, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে আর বাধা নয়। অবশ্য বাজারে উচ্চ সুদ আগে থেকেই চালু হয়েছিল। অনেক ব্যাংক ৭-৮ শতাংশে আমানত নিচ্ছিল।
এখন এমন অবস্থাও হতে পারে যে, আমানতের সুদের বোঝার চাপ কমাতে গিয়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাইয়ে যেতে পারে প্রশাসনিক খরচ কমানোর জন্য। এমনিতেই ব্যাংকে পদোন্নতি প্রায় বন্ধ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও কোনো ব্যাংক তা মানছে না। এখন আমানতের ‘ক্যাপ’ তুলে নেওয়া এবং ঋণের ‘ক্যাপ’ বহাল রাখার ফলে ব্যাংকগুলো ছাঁটাইয়ের দিকে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এর একটা বিহিত হতে পারে। অবশ্য তা মুদ্রানীতির বিষয় নয়। বিষয়টি হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের। বর্তমানে আমানতের সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর ধার্য হয়। কর রিটার্ন জমা দেওয়ার রসিদ না দিলে ব্যাংক চার্জ করবে ১৫ শতাংশ ট্যাক্স। এটা ‘অ্যাডভান্স ট্যাক্স’ হলেও তা ফাইনাল সেটেলমেন্ট হিসাবে বিবেচিত। অর্থাৎ সুদের ওপর উৎসে কর কাটার ফলে কারও যদি বেশি ট্যাক্স কাটা হয় তবু তা হবে চূড়ান্ত। টাকা ফেরতের কোনো নিয়ম নেই।
এক্ষেত্রে সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর না কেটে তা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়। ১৫ শতাংশকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়। এ ছাড়া নানা ধরনের কর ও সুদের হার ধার্য আছে। সেসবও হ্রাস করা যায়। এতে আমানতকারীরা ব্যাংকমুখী হতে উৎসাহবোধ করবে। যদি তা হয় তাহলে টাকা ছাপিয়ে ‘টাকার সংকট’ মেটানোর প্রয়োজন হবে না।
পরিশেষে বলা দরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা সম্পর্কে। সরকারকে টাকা ধার দেওয়ার বিষয়টি হওয়া উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতার মধ্যে। এটা সরকার নির্ধারণ করতে পারে না। সরকার যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের মালিক, বোর্ড যেহেতু সরকার করে, তাই দেখা যাচ্ছে সরকার যথেচ্ছভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়