স্বদেশ ভাবনা
দুর্নীতি দমনে বাধা রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব
আবদুল লতিফ মণ্ডল
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভার মুলতুবি বৈঠকে দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে-তথ্য দিন, আমি ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, পার্লামেন্টে দাঁড়িয়েই এ কথা বলেছি। দুর্নীতির কথা শুধু মুখে মুখে বললে হবে না’ (যুগান্তর, ১৫ জানুয়ারি)। প্রধানমন্ত্রী যাদের উদ্দেশে কথাগুলো বলেছেন, তারা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। তারা কি নিজ দলের নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির তথ্য দেবেন? এমনকি তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির তথ্য দিতেও আগ্রহী হবেন না।
দেশে দুর্নীতি ও দুর্নীতিমূলক কাজ প্রতিরোধের লক্ষ্যে দুর্নীতি এবং অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা এবং পরবর্তী সময়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিষ্ঠা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দুদকে জমা দেওয়ায় আইনি বিধান রয়েছে। দুর্নীতির তথ্য সরকারপ্রধানকে দিতে হবে কেন?
প্রশ্ন হচ্ছে, দুদকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য সংস্থাটি যথেষ্ট শক্তিশালী কি না? বলা যায়, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুদককে অধিকতর শক্তিশালী করার পরিবর্তে দুর্বল করার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমনে যে তৎপরতা দেখা গিয়েছিল এবং দুর্নীতিবাজরা দুদকের ভয়ে যতটা ভীত ছিল, এখন আর তা দেখা যায় না। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবই এর মূল কারণ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল-টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এর মধ্যে ২০০১ সাল ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছর। অপরদিকে ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময়কাল। বর্তমানে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতে রয়েছে।
টিআই-এর ২০২১ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বের সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম। ২০১২ সালের ১ এপ্রিল দুদক আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা দুর্নীতির যেসব কারণকে চিহ্নিত করেন সেগুলোর মধ্যে ছিল-১. সরকারি প্রভাবের কারণে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়া; ২. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দুর্নীতির চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করা; ৩. নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ না হওয়া; ৪. দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ইতস্ততা।
সেমিনারে চিহ্নিত দুর্নীতির এসব কারণের সঙ্গে একমত পোষণ করার পর যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হলো-দুর্নীতি নাটকে কুশীলব কারা? বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতি নাটকে কুশীলব হলেন-ক. রাজনীতিক, খ. সরকারি কর্মচারী, গ. বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যবসায়ী।
দেশের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বড় দলগুলোর লক্ষ্য হলো যে কোনো উপায়ে, তা অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী দলগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে হোক বা নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি করে হোক, নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন।
ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি ও সরকারপ্রধান একই ব্যক্তি হওয়ায় দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা অতীতেও কষ্টকর ছিল, এখনো কষ্টকর। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের সরকারের অংশ হিসাবে মনে করেন এবং প্রশাসনের ওপর সেভাবে প্রভাব খাটান। ফলে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়।
বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে দুদক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার হলেও সংস্থাটিকে পুরোপুরি কার্যকর করতে তেমন উৎসাহী ছিল না। তাছাড়া দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য এমনসব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা বিএনপির আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করেন। চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দুদকের কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমনে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল-ক. দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালীকরণ; খ. দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন; গ. ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ জমা প্রদান; ঘ. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুস-দুর্নীতি উচ্ছেদ; অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ।
দেখা যাক, এসব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে তার নিজ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে দুদককে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এখন থাবা থেকে নখগুলো কেটে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় বিধান করা হয়, কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।
সরকারি চাকরি আইনের উপর্যুক্ত ধারাটি ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’-সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্ট তা বাতিল করে দেন। যতদূর জানা যায়, সরকার হাইকোর্টের এ বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। দুদককে দুর্বল করার এটি আরেকটি চেষ্টা।
ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ জমা প্রদান সম্পর্কে উল্লেখ্য যে, ২০০৯ সালের ৬ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, নবম সংসদ নির্বাচনি অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে মন্ত্রী ও সংসদ-সদস্যদের সম্পদের বিবরণ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেওয়ার একটি খসড়া মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে।
পরের বছর এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে মন্ত্রীদের আপত্তির মুখে সম্পদের বিবরণী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দাখিলের দায় থেকে মন্ত্রীদের অব্যাহতি দেওয়া হয় বলে সে সময় পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।
অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এখন কতটা বেড়েছে, তা মিডিয়ার খবর থেকে সহজে অনুধাবন করা যায়। ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৮টি দলবর্জিত দশম সংসদ নির্বাচন (জানুয়ারি, ২০১৪) শাসক দল আওয়ামী লীগ ও গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার প্রয়োজন হয়নি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে (ডিসেম্বর ২০১৮) অংশগ্রহণকারী মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলোকে মাঠের প্রচারণা থেকে বিরত রাখতে এবং নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে দিতে কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার কিছুটা দরকার হলেও তা ব্যাপক আকারে ছিল না। তবে এ সময়কালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর যেসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হচ্ছে, সেসব নির্বাচনেও কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার চলছে।
রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় অহরহ প্রকাশিত হচ্ছে। দুদক আইন বলে এসব অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক ক্ষমতাপ্রাপ্ত (ধারা ১৭)। কানাডা ও দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে বাড়ি কেনাসহ সম্পদ গড়ে তোলার খবর মিডিয়ায় গুরুত্বসহ প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে, আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন।
এসব অভিযোগের তদন্ত দুদক করতে পারবে কি? তারা মূলত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। এরা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। দুদকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হলো, সংস্থাটি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় নমনীয়। কিছুদিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক গবেষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, দুদক বিরোধী দলের রাজনীতিকদের হয়রানি এবং ক্ষমতাসীন দল ও জোটের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকের কার্যক্রম ও ক্ষমতার অব্যবহারের কারণে এর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
দেশে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় দুদক। সময়ে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে দলীয় স্বার্থে দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ না করা এবং আইনে নির্ধারিত কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে দুদককে সার্বিক সহায়তা প্রদান করা। দলীয় প্রভাবমুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিদেরই সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে।
দুদককেও দায়িত্ব পালনে ক্ষমতার অপব্যবহার পরিহার করতে হবে এবং পুরোপুরি নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। টিআই-এর দুর্নীতির ধারণা সূচকে বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ জায়গা করে নিক-এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com