Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কিছুমিছু

ঝুক্কুর ঝুক্কুর মমিসিং-ঢাকা যাইতে কতদিন?

Icon

মোকাম্মেল হোসেন

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঝুক্কুর ঝুক্কুর মমিসিং-ঢাকা যাইতে কতদিন?

নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা আগেই স্টেশনে চলে এসেছেন ছবদর খান। এর পর তিন ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়েছে; ট্রেনের কোনো খবর নেই।

খবর নেই তো নেই-এ সম্পর্কে কোনো ঘোষণাও নেই। ট্রেন কী জন্য ‘বইট’ মেরেছে-কর্তৃপক্ষ অন্তত একটা ঘোষণা দিয়ে স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের জানাতে পারত! কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো গরজ নেই তাদের।

মাঝখানে একবার অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন ছবদর খান। যে লোকটা সেখানে বসে সিগারেট ফুঁকছিল, ছবদর খান অতি বিনীতভাবে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-

: ভাই সাহেব, বিষয়-বিত্তান্ত কী? ট্রেন লেট হইতেছে কী জন্য?

: ট্রেন কী জন্য লেইট খাইছে, সেইটা আমি কেমনে বলব?

: আপনে তাইলে এইখানে কুন দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন?

: মানে?

: জানতে চাইতেছি, এইখানে আপনের ডিউটিটা কী?

: ডিউটি হইল-কুনু ট্রেনের খবর হইলে সেইটা ঘোষণা করা।

: আর খবর না হওয়া ট্রেন সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন না?

: না।

: এইটা কে বলতে পারবেন?

: এইটা বলতে পারবে কন্ট্রোল রুম আর ইস্টিশন মাস্টার। আপনে তাদের কাছে যান।

ছবদর খান এ দুই জায়গার কোনোখানেই যাওয়ার সাহস পাননি এই ভয়ে যে, সেখানে আবার কী ছবক শুনতে হয়। তার বদলে তিনি ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশনের এক মাথা থেকে আরেক মাথার সিন-সিনারি দেখতে লাগলেন। স্টেশনে হরেক কিসিমের পাগলের দেখা পেলেন ছবদর খান। এদের একেকজনের একেক ভাব। কেউ কল্কি-পাগল; কেউ ভেল্কি-পাগল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার চোখে পড়ল স্টেশনের নোংরা পূঁতিগন্ধময় পরিবেশ। ছবদর খান আপন মনে বললেন-এইটারে রেলওয়ে জংশন না বইলা পাগল আর আবর্জনার জংশন বলাই উত্তম। ছবদর খানের কথা শুনে পাশে দাঁড়ানো এক যুবক জানতে চাইল-

: মুরুব্বি কিছু বললেন?

: বললাম।

: কুন বিষয়ে?

: ইস্টিশনের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিষয়ে! চারদিকে নোংরার ছড়াছড়ি।

: এর জন্য তো আপনে-আমি দায়ী।

: কেমনে?

: ট্রেনের প্রতিটি টয়লেটে দেখবেন লেখা আছে-স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ানো অবস্থায় টয়লেট ব্যবহার করবেন না। কিন্তু পাবলিক তো সেই কথা মানে না। ট্রেন ইস্টিশনে দাঁড়ানের পরপরই তারা হাগা-মুতার কমপিটিশনে নামে।

: ইমার্জেন্সি কেইস হিসাবে পাবলিক এই ধরনের ঘটনা ঘটাইতেই পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এইসব পরিষ্কার করবে না?

: পরিষ্কার না করার পিছনে যুক্তিসংগত কারণ আছে।

: যেমন?

: লক্ষ কইরা দেখেন-ইস্টিশনের কুনু একটা রেললাইনে পাথর নাই বললেই চলে। এই অবস্থায় মানুষের ত্যাগ করা কঠিন বর্জ্য শুকাইতে শুকাইতে শক্ত হইয়া যাতে পাথরের অভাব পূরণ করতে পারে, সেই জন্য এইগুলারে টাচ করা হয় না।

হঠাৎ মাইকের চিঁ চিঁ শব্দ শুনে সচকিত হলেন ছবদর খান। কান পেতে শুনলেন-ঢাকাগামী ট্রেনের বার্তা ঘোষণা করা হচ্ছে। তিনি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে তাকলেন। প্রায় বিশ মিনিট পর প্ল্যাটফমে ট্রেন প্রবেশ করার পর টিকিটের গায়ে লেখা নির্ধারিত কামরায় উঠতে গিয়ে হোঁচট খেলেন ছবদর খান। কোনটা ‘চ’ বগি আর কোনটা ‘খ’ বগি তা বোঝার কোনো উপায় নেই। তাকে ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা ছোটাছুটি করতে দেখে একজন উপদেশ দিলেন-গাড়ির মধ্যে উইঠা বগি খোঁজেন চাচা মিয়া। তা না হইলে গাড়ি আপনেরে রাইখাই হাঁটা দিবে। ছবদর উঠে পড়লেন। নিজস্ব বগির অনুসন্ধানে জনসমুদ্রে সাঁতার কেটে সামনে অগ্রসর সময় ছবদর খান একজন অ্যাটেনটেন্ডের দেখা পেলেন। মোলায়েম স্বরে তার উদ্দেশে বললেন-

: ভাই, এইটা কী কারবার?

: কী হইছে?

: একটা বগির গায়েও লেবেল নাই।

: এই কথা! বগির পরিচয়পত্র চক দিয়া লেইখা রাখা হইছিল। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি আইসা তা হজম কইরা ফেলছে।

: আগে তা বগিতে বগিতে বোর্ড টাঙাইয়া দেওয়ার সিস্টেম ছিল।

: আগে তো কত সিস্টেমই ছিল। পরিস্থিতির কারণে সবকিছু পরিবর্তন ঘটছে। প্রতিটা স্টপেজের আগে বোর্ড একবার ঝুলাইয়া দেওয়া, আবার খুইলা নেওয়া-এত টাইম কই আমাদের? এই যে দেখতেছেন-ট্রেনের মধ্যে মাছের পোনার মতন ভিক্ষুক-হকার কিলবিল করতেছে, তাদের কাছ থেইকা ‘তোলা’ তুলতে যাইয়া অন্য সাইডে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। এই জন্যই চক মাইরা দিছিলাম। বৃষ্টি গেঞ্জাম না করলে লেখা ঠিকই দেখবার পারতেন।

ছবদর খান যখন নিজের সিট খুঁজে পেলেন, তখন তার পাঞ্জাবির সামনে-পেছনে অর্ধেকটা ঘামে ভিজে গেছে। পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মোছার পর সিটে বসে থাকা দু’জনের একজনকে লক্ষ করে তিনি বললেন-

: ভাই উঠেন; এই সিট আমার।

ছবদর খানের কথায় টাইট জিন্স আর টি-শার্ট পরিহিত যুবক দু’জনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর পরিলক্ষিত হলো না। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ছবদর খান পুনরায় একই কথা উচ্চারণ করলে আড়মোড়া ভেঙে একজন বলল-

: আপনের সিট নম্বর কত?

অন্যজন বলল-

: টিকিট দেখান।

ছবদর খান সুবোধ বালকের মতো পকেট থেকে টিকিট বের করে যুবকের হাতে দিলেন। সেটা নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ দেখার পর যুবক বলল-

: বসেন, সাইডে বসেন।

: সাইডে বসব কেন? আমার সিট জানালার পাশে।

যুবক জানতে চাইল-

: কেমনে বুঝলেন, আপনের সিট জানালার পাশে?

: টিকিটের গায়ে লেখা আছে ডব্লিউ-আটত্রিশ। ডব্লিউ মানে উইন্ডো।

যুবক হাসতে হাসতে বলল-

: আরে না, চাচামিয়া আপনে ভুল বুঝতেছেন। ডব্লিউ মানে হইল উইথড্র; অর্থাৎ প্রত্যাহার করা। ফুটবল খেলার মাঠে দেখেন নাই- কোচ তার দলের কোনো কোনো খেলোয়াড়কে মাঠ থেইকা প্রত্যাহার কইরা নেয়? তেমনি রেল ডিপার্টমেন্ট আপনেরে টিকিট দিছে ঠিকই; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার প্রত্যাহার কইরা নিছে।

যুবকের কথা শুনে কঠিন গলায় ছবদার খান বললেন-

: উইন্ডো মানে জানালা। আমি জানালার পাশেই বসব।

খানের কণ্ঠস্বর শুনে যুবক বামপাশে একটু সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। বসতে গিয়ে ছবদর খান প্রশ্ন রাখলেন-

: দুইজনের সিটে তিনজন কেমন কইরা বসব?

: বসতে সমস্যা হইলে দাঁড়াইয়া থাকেন।

ছবদর খান আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে জ্যামিতি শাস্ত্রের বক্ররেখা সেজে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে চেকার এসে টিকিট চেক করার সময় ছবদর খান তাকে বললেন-

: আমার একটা বক্তব্য আছে।

: বলেন।

: ওই যে ট্রেনের গায়ে আপনেরা লেইখা রাখছেন-৬৮ জন বসিবেন। এইটা মুইছা দিয়া সেইখানে লেখবেন-ধারণ ক্ষমতা আনলিমিটেড।

: কী করবেন ভাই; গরিব দেশ-যে পরিমাণ টিকিট বিক্রি হয়, সেই অনুপাতে বগির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না।

: বগির ব্যবস্থা না করতে পারলে সিটের অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করবেন না।

: সর্বনাশ। টিকিট বেইচ্যাই তো রেল টিইক্যা রইছে। অন্যসব সাইড খাইতে খাইতে ঝাঁজরা বানাইয়া ফেলছে।

: খাওয়া রোধ করা যায় না?

: কে রোধ করবে? ছোট মিয়া-বড় মিয়া মিইলা-মিইশা খায়।

: এই ক্ষেত্রে একটা উপায় অবশ্য আছে।

: কী?

: দুই-চারটা কমিউটার ট্রেন প্রাইভেট সেক্টরে না দিয়া পুরা রেল সেক্টরটারেই প্রাইভেট সেক্টরের হাতে ন্যস্ত করেন।

: ভাই! আপনে তো জাতীয় শত্রুরূপে গণ্য হওয়ার মতো ডায়ালগ দিলেন। বলেন, এই রেল কারা বানাইছে?

: কারা বানাইছে!

: ছোটবেলায় ছড়া পড়েন নাই-ইংরাজের বুদ্ধি ভারী; শিকের উপর চালায় গাড়ি। হাঃ হাঃ হাঃ। এই রেল বানাইছে মহামান্য ব্রিটিশ। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের গড়া এই সেক্টর ব্যক্তিমালিকানায় ছাইড়া দিলে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের আত্মার সঙ্গে বেঈমানি করা হবে। রেলের একটা লোক জিন্দা থাকা পর্যন্ত এই ধরনের বেঈমানি বাংলার মাটিতে বরদাশত করা হবে না।

টিকিট চেকার চলে যাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন ছবদর খান। ট্রেন জয়দেবপুর স্টেশনে আসার পর তিনি হিসাব করে দেখলেন-যাত্রাপথে মোট ছয়বার আউটার সিগন্যালে থেমেছে বিরতিহীন আন্তঃনগর এই ট্রেন। এছাড়া খুচরা স্টেশনে জাতভাইকে সাইড লাইনে চলার জন্য থেমেছে তিনবার। জয়দেবপুর থেকে টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত ভালোই চলল ট্রেন। এর পর আবার শুয়ে পড়ল। টঙ্গী জট থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিমানবন্দর ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন অতিক্রম করতেই পুরোনো রোগে আক্রান্ত হলো ছবদর খানকে বহনকারী ট্রেন। বিরক্ত হয়ে ছবদর খান বললেন-

: ছাতার মাথার ট্রেন, এতবার থামে ক্যান?

ছবদর খানের কথার উত্তরে পাশ থেকে এক সহযাত্রী বললেন-

: শোনা কথা; সত্য-মিথ্যা জানি না। প্রথম দুইবার দুই বস্তির পাশে ট্রেন থামছে-কারণ, এইখানে নাকি ট্রেনে আসা ফেনসিডিলের চালান খালাস করা হয়। আর শেষে যেইখানে থামছে-সেইখানে নাকি ঘুস খাওয়া অ্যাটেনডেন্টরা বিনা টিকিটের যাত্রীদের খালাস দিয়া যায়।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন ভ্রমণের আদি-অন্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অন্তহীন ভাবনায় আত্মমগ্ন হলেন ছবদর খান-বিশ্বে দুইশ-তিনশ কিলোমিটার গতির ট্রেন চলাচল করছে। আর আমাদের দেশে ট্রেনের স্পিড চল্লিশের উপরে তুলতে গেলেই কাত হয়ে পড়তে চায়! তারপরও কী আচানক কারবার-আমাদের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা কথায় কথায় জাতিকে বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখান; দেখাতেই থাকেন। হায় রে কপাল! কিসের মধ্যে কী-পান্তার মধ্যে ঘি!

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

mokamia@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম