Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বই পড়ার অভ্যাস

Icon

ড. মো. মাহমুদুল হাছান

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বই পড়ার অভ্যাস

প্রায় দেড় দশক আগেও স্কুল-কলেজে আবশ্যিকভাবে বাংলা ও ইংরেজি বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়েও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বই পড়তে বলতেন শিক্ষকরা, যাকে ‘রিডিং পড়া’ বলা হতো। আজ আর এটা তেমন লক্ষ করা যায় না। মনে আছে, আমাকে আমার প্রিয় একজন শিক্ষক চতুর্থ শ্রেণিতে বাংলা রিডিং পড়তে দিয়ে মাথার উপর বেত উঁচু করে ধরে রেখেছিলেন। একটি উচ্চারণে ভুল করেছি তো বেতের এক ঘা থেকে রেহাই পাইনি। আমার বিশ্বাস, তখনকার শহর-গ্রামের প্রায় সব শিক্ষার্থীই এমন অবস্থার শিকার হয়েছে। আর এ কারণেই আমাদের বই পড়ার প্রতি বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।

আজকাল এমনটি আর দেখা যায় না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলি, কিংবা এসডিজি-২০৩০-এর শিক্ষণ-শিখন ফলের কথা বলি, সেগুলো কার্যকরভাবে সফল করতে শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশি বেশি বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সাদা কাগজে কালো অক্ষরে লেখা বই স্বচক্ষে পড়ে যে জ্ঞানের গভীরতা উপভোগ করা যায়, তা ইন্টারনেটনির্ভর ঝাপসা আলোকচ্ছটার লেখা পড়ে কতটুকু অর্জন করা যায়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ইন্টারভিত্তিক পড়াশোনায় জ্ঞানার্জন থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রভাব বেশি লক্ষণীয়। এতে পাঠককে ভিন্নদিকে পরিচালিত করার আশঙ্কা থাকে। ডিজিটাল টেকনোলজির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শিক্ষার্থীদের পড়ার ইচ্ছা কমিয়ে দেয়। ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার বিষয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিঃসঙ্গতা-একাকিত্বের অনুভূতিও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড লার্নিং জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফিল রিড বলেছেন, যেসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের অতিরিক্ত নেশা আছে, তারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন। ইন্টারনেট আসক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সও খুবই দুর্বল। একাডেমিক ফলাফল বিবেচনায় দেখা যায়, ইন্টারনেট আসক্তরা শিক্ষাগত যোগ্যতার মানে পিছিয়ে থাকছে।

সম্প্রতি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দিনে যারা অতিরিক্ত সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে। গবেষকরা কলেজ শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে মানসিক সমস্যার সম্পর্ক বুঝতে দুটি স্কেল ব্যবহার করেন। প্রথমটি ইন্টারনেট অ্যাডিকশন টেস্ট (আইএটি)। ১৯৯৮ সাল থেকে এ স্কেলের ব্যবহার চলে আসছে। দ্বিতীয়টি নতুন স্কেল, যা ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন বুঝতে তৈরি করা হয়েছিল। ওই গবেষণার প্রধান মাইকেল ভ্যান আমেরিনজেন বলেন, গত দুই দশকে ইন্টারনেটে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ অনলাইনে কাজ করছেন, মিডিয়া স্ট্রিমিং করছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাচ্ছেন। তাদের পরামর্শ হলো, ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে।

গবেষণায় ২৮৫ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, অধ্যয়নের দক্ষতা, পড়াশোনার আগ্রহ, উদ্বেগ ও একাকিত্বসহ আরও কিছু বিষয় মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পরিশেষে দেখা যায়, অতিরিক্ত ইন্টারনেটের আসক্তি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাবিমুখ করে তুলছে। পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও দক্ষতা দুটিই কমিয়ে দিচ্ছে। গবেষণার ফলাফলে আরও দেখা যায়, ইন্টারনেট আসক্তরা তাদের পড়াশোনার কাজ গুছিয়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি কাজ করার কথা না থাকলেও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষাকে বেশ ভয় পাচ্ছে এবং বিষয়টি নিয়ে তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন থাকছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাকিত্ব বাড়ছে, যা পড়াশোনাকে আরও কঠিন করে তুলছে।

গবেষণাটিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ৪ ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। বাকিরা ১ থেকে ৩ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করত। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ জানায়, তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্যবহার করত। এছাড়া ৩০ শতাংশ জানায়, তারা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে ইন্টারনেট ব্যবহার করত।

বিশ্বব্যাপী পড়াশোনার অবস্থা এমন খারাপ হওয়ার জন্য গবেষকরা শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তিকে দায়ী করেছেন। তাদের দাবি, ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনীহার প্রধান কারণ। এর ফলে বাড়ছে একাকিত্ব, যা হতাশাগ্রস্ত করছে শিক্ষার্থীদের। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক শিক্ষার ওপর। গবেষকরা বলছেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ইন্টারনেট আসক্তির কারণে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষার জন্য পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা, ইতিবাচক চিন্তাভাবনা তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ গুণাবলি না থাকায় তা তেমন ভালো ফল বয়ে আনবে না।

এভাবে আমাদের শিশুরা ইন্টারনেটের দিকে যেভাবে ঝুঁকে পড়ছে এবং তাদের আসক্তিও দিন দিন যেভাবে বেড়ে চলছে, তাতে তাদেরকে ইন্টারনেট ব্যবহারের মধ্য দিয়েই বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এজন্য অনেক উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি জাগো ফাউন্ডেশন নামক একটি সংস্থা দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে শিশুদের মধ্যে নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহার প্রচার করেছে এবং তাদের পিতামাতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল এবং মিশ্র শিক্ষার (ব্লেন্ডেড লার্নিং) বিষয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা দিচ্ছে। এটি একটি ভার্চুয়াল লার্নিং অ্যাপ্লিকেশনে ২৫০০ শিক্ষার্থী এবং ২৫০০ অভিভাবকের কাছে সরাসরি অ্যাক্সেস তৈরি করেছে, যা শেখার প্রক্রিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইসিটি টুল হিসাবে সমর্থিত ছিল। প্রকল্পটি রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও বরিশাল জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলগুলোতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে অপেক্ষাকৃত ভালো অ্যাক্সেস ছিল, যা এ উদ্যোগের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে পাঁচটি বিভিন্ন জেলার মোট ২৫০ জন তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সরাসরি ২৫টি স্কুলে কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছেন।

প্রকল্প কার্যক্রম একটি নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ তৈরি করেছে এবং গল্প বলার পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গ্রেডভিত্তিক পড়ার দক্ষতা উন্নত করেছে। এজন্য তারা ‘লেটস রিড’ নামে একটি অ্যাপ তাদের স্মার্ট বা এন্ড্রয়েড ফোনে আপলোড করে সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে এর প্র্যাকটিকাল ব্যবহার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা ও তথ্যের সঙ্গে পরিচিত করে তাদেরকে এটির ব্যবহারের সংবেদনশীলতা সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছিল। যুব স্বেচ্ছাসেবকরা প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা সংবলিত লিফলেটসহ অভিভাবকদের ফোনে অ্যাপটি ডাউনলোড করার জন্য শিক্ষার্থীদের গাইড করেছিলেন। অবশেষে প্রতি চার সপ্তাহান্তে ফলোআপ করে দেখা গেছে, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে বারবার পড়া এবং গল্প বলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ছিল মূলত লার্নিং অ্যাপ ‘লেটস রিড’-এর কার্যকর ফলাফল।

গবেষণা শেষে তথ্য জরিপে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা ‘লেটস রিড’ অ্যাপটির ব্যবহার শুরু করার পর থেকে তাদের পড়ার দক্ষতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি কমে পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এভাবে শিশুদের চরিত্র, থিম ও সেটিংসসহ এমন অ্যাপ তৈরি করা দরকার, যা তাদের জীবনকে প্রতিফলিত করবে এবং বিশ্বকে অন্বেষণ করার সুযোগ করে দেবে। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য কৌতূহলী ও শিক্ষিত পাঠকসমাজ তৈরি করতে শিশুদের মানসম্পন্ন ই-বইয়ের অ্যাপে অ্যাক্সেস থাকতে হবে। আমাদের সন্তানদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার এবং উৎপাদনশীল স্ক্রিন টাইম সম্পর্কে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি করা উচিত, যার মাধ্যমে তারা গল্প, রঙিন ছবি, আকর্ষণীয় চরিত্র এবং তাদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত থিম দিয়ে ভরা ই-বুকের একটি বিস্তৃত বৈচিত্র্য খুঁজে পেতে পারে।

উন্নত বিশ্বে এ ধরনের অ্যাপসের আবিষ্কার অনেক আগে থেকেই লক্ষ করা যায়। যেমন- https://www.getepic.com-এটি ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য একটি পুরস্কার বিজয়ী ডিজিটাল লাইব্রেরি, যেখানে ৩৫ হাজারেরও বেশি বইয়ের শিরোনাম, অডিও বই এবং সাহিত্য শেখার ভিডিও রয়েছে? https://www.readingiq.com-12 বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য এ অনলাইন লাইব্রেরিতে কল্পকাহিনি এবং নন-ফিকশন গল্প, গ্রাফিক উপন্যাস, শব্দহীন বই, ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য, জীবনী, বই, ছড়া এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে। https://bookful.app-এটি বর্ধিত বাস্তবতাকে জীবন্ত করে তোলার প্রথম অ্যাপ, যা যে কোনো ডিভাইসে পড়ার একটি মজার ও সহজ উপায়। https://www.monkeyjunior.com-এটিতে ছবির গল্পগুলো বাচ্চাদের অডিও-ভিজ্যুয়ালের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে এবং প্রতিটি নতুন শব্দকে স্ক্রিনে হাইলাইট করে দেখিয়ে দেয়। https://play-এই অ্যাপটি ‘দৃষ্টিবদ্ধ শব্দকে’ পরিচয় করিয়ে দেয়, যা স্কুলে এবং শিশুদের বইয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। এ ছাড়াও স্টারফল, রিডার, রিডিং র‌্যাভেন, রিডিং আইজি, রিডিং আই ইত্যাদি অনেক অ্যাপ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে শিশুদের ইন্টারনেট আসক্তিকে পড়ার অভ্যাসে দিকে রূপান্তরিত করা যায়।

কাজেই ইন্টারনেটের মহাবিশ্ব থেকে শিক্ষার্থীদের বিমুখী করার যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু এটির প্রতি যেন তারা আসক্ত না হয়ে বরং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি নিবেদিত হয়, সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে। ইউনিসেফের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি বা প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু প্রথমবারের মতো অনলাইন জগতে প্রবেশ করছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থাটি সতর্ক করে জানিয়েছে, সুফলের পাশাপাশি তাদের ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখেও ফেলে ভার্চুয়াল জগৎ, যার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর আধেয় (কনটেন্ট), যৌন হয়রানি, মস্তিষ্কের শোষণ, সাইবার উৎপীড়ন এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার। এখনই আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার শিখিয়ে, তাদেরকে পড়ালেখাবিষয়ক বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে বেশি করে বই পড়ার প্রতি অভ্যস্ত করতে হবে।

ড. মো. মাহমুদুল হাছান : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ স্মার্ট এডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিসেন)

 

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম