ডোনাল্ড লু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে যেভাবে সহায়তা করতে পারেন
মেহজাবিন বানু
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জ্বালানি, বাণিজ্য, নিরাপত্তা সহযোগিতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শ্রম অধিকার, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে আগামী শনিবার বাংলাদেশে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
এ সফরকালে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করবেন। এছাড়া মানবাধিকার ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে আলোচনা হবে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যেই তার সফর নিয়ে কানাঘুষা চলছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যখন কিছুটা অস্বস্তি বিরাজ করছে, সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা যায়। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দাবি করেছেন, ডোনাল্ড লু অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের একজন। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসাদ মাজিদের মাধ্যমে ডোনাল্ড লু তাকে ‘হুমকিমূলক চিঠি’ পাঠিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন ইমরান খান।
পরে ডোনাল্ড লুকে পাকিস্তানে শাসন পরিবর্তনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। এখন তিনি বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি এ অঞ্চলে শাসন পরিবর্তনের মাস্টারমাইন্ড নন। তিনি প্রমাণ করতে পারেন, তিনি এ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে কাজ করে যাচ্ছেন, তার লক্ষ্য শাসন পরিবর্তন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদারে ডোনাল্ড লুর ভূমিকা বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে এই ধারণা দূর করতে পারে যে, তিনি এ অঞ্চলে শাসন পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো ভূমিকা পালন করেন না।
ডোনাল্ড লু ১৫ জানুয়ারি পৃথকভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করবেন। একই দিনে তিনি আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তবে তিনি দূতাবাসের অনুষ্ঠানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলবেন। এসব বৈঠকে মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, গুম, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, শ্রম অধিকারসহ কয়েকটি এজেন্ডাকে গুরুত্ব দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার, জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধার, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু, রোহিঙ্গাসহ নানা বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবে বাংলাদেশ।
ডোনাল্ড লু গত ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসাবে লুর এটি প্রথম ঢাকা সফর হলেও বাংলাদেশে এটি তার প্রথম সফর নয়। গত বছর মার্চে তিনি পার্টনারশিপ ডায়ালগ উপলক্ষ্যে আসা মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের সঙ্গে নীরবে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
বাংলাদেশে ডোনাল্ড লুর আগমনের খবরে আমরা খুশি। তিনি আসছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। আশা করি, পারস্পরিক সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে এবং অনেকাংশে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।
মার্কিন নীতিনির্ধারক ও কূটনীতিকরা ঐতিহ্যগতভাবে এ বন্ধনকে একটি দৃঢ় ভিত্তি প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। একই ভূমিকা এখন ডোনাল্ড লু পালন করবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। ডোনাল্ড লু আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন বলে আশা করি। আরও আশা করি, এ সফর বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আমাদের বিদ্যমান সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করা হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস দমন ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার অন্যতম প্রধান অংশীদার। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ এ অঞ্চলে মার্কিন সাহায্যের তৃতীয় বৃহত্তম সুবিধাভোগী। দুই দেশের মধ্যে দ্বিমুখী বাণিজ্য ২০১৯ সালে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তৈরি পোশাকের (আরএমজি) একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশ।
২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) শীর্ষ উৎস ছিল। কোভিড-১৯ সংকটের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ প্রায় ৬১ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে, এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন ভ্যাকসিন অনুদানের সর্বোচ্চ।
এ পরিসংখ্যান দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বন্ধনের গভীরতার সাক্ষ্য বহন করে। আমরা আশা করব, ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার ওপর জোর দেবেন এবং বাকি মুক্ত বিশ্বকেও এ ব্যাপারে তাগিদ দেবেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এ বিশাল আর্থিক বোঝা বহন করা অসম্ভব। এক্ষেত্রে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে নিয়মিত আর্থিক প্রবাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কথা রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ অনেক অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা আর পাবে না অথবা তা সীমিত হবে, যেমন-শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজারের সুবিধা। এ পরিস্থিতি আমাদের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে। ডোনাল্ড লু এলডিসি-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মার্কিন সরকারের ওইসব সুবিধার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারেন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে, কার অধীনে হবে ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কবার্তায় কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না। কারণ, বাংলাদেশ এখন আগের অবস্থানে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা এখন অনেক কমে গেছে। বরং ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশ একটি বিশাল বাজার।
বাংলাদেশ এ অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে টার্গেট করবে না, কারণ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আছে। বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলেও বিশ্বাস করে। সুতরাং, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি নিশ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ উভয়েরই প্রয়োজন বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন এবং জলবায়ু পরিবর্তনে দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতা রয়েছে।
বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক আরও জোরদার করার দিকেই ডোনাল্ড লুর নজর দেওয়া উচিত। তিনি এ অঞ্চলে মার্কিন প্রশাসনের বিশিষ্ট নীতিনির্ধারকদের একজন হওয়ায় দুদেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভুল ধারণা দূর হয়। সম্প্রতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে, তা কীভাবে আরও ভালোভাবে নিরসন করা যায়, সে বিষয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অব্যাহত রাখতে হবে।
মেহজাবিন বানু : প্রাবন্ধিক, উন্নয়ন ও স্থানীয় সমাজকর্মী