Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে

৯ জানুয়ারি সোমবার ২০২৩ দৈনিক পত্রিকায় একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল-‘একবারই কেঁদেছেন হ্যারি’। এ সংবাদের উৎস বিবিসি।

১৯৯৭ সালে মা ডায়ানা প্রিন্সেস অব ওয়েলসের মৃত্যুর পর মাত্র একবার কাঁদতে পেরেছিলেন প্রিন্স হ্যারি। আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’-এর প্রকাশ উপলক্ষ্যে দেওয়া নতুন এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন তিনি।

ওই সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ সম্প্রচার মাধ্যম আইটিভির সাংবাদিক টম ব্র্যাডবিকে হ্যারি বলেন, জনসমক্ষে শোক প্রকাশের সুযোগ তাদের ছিল না। যখন তার মাকে সমাহিত করা হয়, তখন তিনি একবারই কাঁদতে পেরেছিলেন।

ডিউক অব সাসেক্স আরও বলেন, কেনসিংটন প্যালেসে ফুল ছড়ানো রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে হাঁটার সময় তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবছিলেন। আত্মজীবনী ‘স্পেয়ার’জুড়ে প্রিন্স হ্যারি তার জীবনে মা ডায়ানা না থাকার কষ্টের কথা বলেছেন।

‘স্পেয়ার’-এর কোনো কিছু ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল না। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পেনে বইটির কিছু কপি আগেই বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর বইয়ের মূল বিষয় ফাঁস হয়ে যায়। বিবিসি নিউজ এ বইয়ের একটি কপি পেয়েছে এবং অনুবাদ করেছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম আইটিভিকে দেওয়া হ্যারির সাক্ষাৎকার রোববার সম্প্রচারিত হওয়ার কথা। প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মায়ের মৃত্যুর কয়েক দিন পর ভাইয়ের সঙ্গে তিনি শেষকৃত্যের ফুটেজটি দেখেছিলেন। হ্যারি বলেন, ‘আমি সমাহিত করার স্থানে মাত্র একবার কেঁদেছিলাম।’ ‘স্পেয়ার’ বইয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত আছে বলে জানান তিনি। কেনসিংটন প্যালেসের বাইরে হাঁটার সময় অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল এবং অপরাধবোধ হচ্ছিল, বলেন হ্যারি। তার ধারণা, উইলিয়ামেরও সে সময় একই অনুভূতি হচ্ছিল।

প্রিন্স হ্যারি আরও বলেন, ‘আমাদের মায়ের কাছে ৫০ হাজার ফুলের তোড়া ছিল। আমরা সেখানে মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম। যাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলাম, তাদের হাত ভেজা ছিল।’

আমরা অনেকেই ভাবতে পছন্দ করি, একটি দেশের রাজপরিবার এবং রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের জীবনে কোনো দুঃখ নেই, নেই কোনো কষ্ট, আছে অনেক সুখ। এমন কথা যে সঠিক নয়, আমরা তা জেনেছি প্রিন্স হ্যারির সাক্ষাৎকার থেকে। প্রিন্স হ্যারির মা ডায়ানা প্রিন্সেস অব ওয়েলসের মৃত্যুর পর একবারই কাঁদতে পেরেছিলেন প্রিন্স হ্যারি। তার সাক্ষাৎকার থেকে আমরা আরও জানতে পেরেছি, জনসমক্ষে শোক প্রকাশের সুযোগ তাদের ছিল না। যখন তার মাকে সমাহিত করা হয়, তখন তিনি একবারই কাঁদতে পেরেছিলেন। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করা অথবা রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হওয়া একজন মানুষকে সর্বতোভাবে সুখী করে না। বাহ্যিকভাবে আমরা যখন তাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতে দেখি, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না, তারা কি সর্বতোভাবে সুখী? আসল কথা হলো, তারাও রক্ত-মাংসের মানুষ। তাদেরও মন আছে, মস্তিষ্ক আছে। তাদের জীবনেও দুঃখ আছে, বেদনা আছে, শোক আছে, আছে ভালোবাসা। জীবনের সুকুমার বৃত্তি যেমন আছে, তেমনি আছে সমাজের চোখ থেকে তাদের দুঃখ ও শোকানুভূতিকে আড়াল করার প্রয়াস। প্রিন্স হ্যারি যখন বলেন, জনসমক্ষে শোক প্রকাশের সুযোগ তাদের ছিল না। এমন রীতি, এমন আচার রাজার সন্তানেরা করতে পারে না। রাজপরিবারের সদস্যদের খুব সাবধানে চলতে হয়। তারা ভালো করেই জানেন কী পালনীয় এবং কী বর্জনীয়। এ রীতি বা আচারগুলো কালে কালে দানা বেঁধে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এভাবে আচার-আচরণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কারণ বা হেতু কী হতে পারে? এর একটা কারণ অবশ্যই এই যে, রাজা বা রানি কিংবা রাজকুমার-রাজকুমারীরা সাধারণ মানুষ নয়। তারা যে সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন এক ধরনের মানুষ, তা প্রতিভাত করতে রাজপরিবারের নানারকম অনুষ্ঠান ও আচার পালিত হয়। এই আচার পালনে কোনোরকম বিচ্যুতির সুযোগ নেই। রাজা এমনভাবে জীবনযাপন করবেন, যাতে সাধারণ মানুষ তাদের ভিন্ন এক ধরনের মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করে।

ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড একজন সাধারণ নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। তার নাম ছিল মিস স্যামসন। এই স্যামসনকে পাওয়ার জন্য রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ডকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয়। এ থেকে আমরা কী ইঙ্গিত পাই? যিনি রাজধর্ম পালন করবেন, তাকে তার আভিজাত্য বজায় রাখতে হবে। এ কারণেই একটা সময় পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজা, রানি এবং রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা সাধারণ কারও সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতেন না। এ কারণে ইউরোপে যখন ব্যাপকভাবে রাজতন্ত্র ছিল, তখন এক রাজার মেয়েকে অন্য রাজার ছেলে বিয়ে করত। কালের প্রবাহে রাজতন্ত্রকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিথ ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করেছে। আমরা লক্ষ করছি, ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ সাধারণ নারী বা পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। প্রিন্সেস ডায়ানা এবং প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান রাজপরিবারের সদস্য নন। তারা উভয়ে সাধারণ মানুষের কাতার থেকে উঠে এসেছেন। রাজশক্তির বাহ্যিক গৌরব ও ঔজ্জ্বল্য প্রিন্স হ্যারিকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই রাজতন্ত্রের সব মোহ ছেড়ে ২০২০ সালে স্ত্রী মেগান মার্কেলকে নিয়ে রাজপরিবারের দায়িত্ব ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে গেছেন প্রিন্স হ্যারি। এরপর থেকে রাজপরিবার ও ভাইবোনদের সঙ্গে হ্যারির সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে।

ব্রিটিশ রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ অথবা বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা এ ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলাকে আপত্তিকর বিবেচনা করতেন। এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন রাজপরিবারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে বলেই তারা মনে করতেন। এখন তারা অনিচ্ছুকভাবে এমন ধরনের সম্পর্ক স্থাপনকে মেনে নিচ্ছেন। পুরোনো দিনের রীতি অনুযায়ী চলতে হলে অবশ্যই রাজপরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। তবে ইদানীংকালে এ রীতি থেকে অনিচ্ছুকভাবে রাজপরিবারকে বের হয়ে আসতে আমরা দেখছি।

ব্রিটেনের রাজা অথবা রানি এক ধরনের নামমাত্র বা খেতাবি রাজা বা রানি। অতীতে রাজা-রানিরা ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। রাজতন্ত্র সম্পর্কে একটা তত্ত্ব আছে। এ তত্ত্বটি অতীত শতাব্দীতে বেশ জোরদার ছিল। তখন মনে করা হতো, রাজা বা রানি ঈশ্বরের ছায়াতুল্য। যে যুগে মানুষ ঈশ্বরকে ক্ষমতার উৎস বলে মনে করত, সে যুগে এমন ধারণা মজ্জাগত হয়ে পড়েছিল। রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতে এবং মানুষের চিন্তা-চেতনার রাজ্যে নতুন আলো প্রবেশ করার ফলে এখন আর মনে হয় না, রাজা কিংবা রানি ঈশ্বরের ছায়া হিসাবে এ মর্ত্যলোকে অবস্থান করছেন। এ রকম অবস্থায় একদিকে শাসন ও বিচারব্যবস্থায় রাজা বা রানির কথাই ছিল শেষ কথা। রাজরক্তের সঙ্গে রাজরক্ত মেশাতে না পারলে রাজতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, এমন একটি ধারণায় মানুষকে তথা প্রজা সাধারণকে অভ্যস্ত করানো হয়েছিল। এখন মানুষের অধিকারের বিষয়টি ব্যাপক এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে বিশ্লেষণ করা হয়। তার ফলে রাজা বা রানির ক্ষমতা ঈশ্বরের ছায়া দিয়ে পোক্ত করতে হয় না। রাজা বা রানির প্রতি প্রজাসাধারণের আনুগত্য ভিন্ন এক ধরনের বন্দোবস্ত অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। প্রজারা এখন নাগরিকে পরিণত হয়েছেন। নাগরিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব এখন রাজা বা রানির। এদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব ক্ষমতা পরিত্যাগ করেই রাজা বা রানি সিংহাসনে আসীন থাকেন নির্ভার রূপে।

একটি রাষ্ট্রের ভেতর ক্ষমতার প্রাধান্য বজায় রাখতে গিয়ে ভিন্ন এক ধরনের আচার বা রীতির প্রচলন করা হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় বা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো ঝলমলে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়। স্বাধীনতা বা জাতীয় দিবসে যে প্যারেড অনুষ্ঠান করা হয়, তা শুধু বর্র্ণাঢ্যই নয়, গভীর তাৎপর্যমণ্ডিতও বটে। এ ধরনের প্যারেডে শুধু সাধারণ সৈনিকরা অংশগ্রহণ করে না, এসব প্যারেডে সমরাস্ত্রের শক্তিবহ প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্র কত শক্তিশালী ও ভয়াবহ। এ দৃশ্য দেখে সাধারণের মনে একটি ধারণার ভিত্তি সৃষ্টি হয়। ধারণাটি হলো, রাষ্ট্র ভয়াবহ শক্তি ও সামর্থ্যরে অধিকারী। একে অবজ্ঞা করা যাবে না। রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হবে এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সফল হবে না। রাষ্ট্র জানান দেয়, এটি অমিত শক্তির অধিকারী।

এমন ক্ষমতা যাদের হাত দিয়ে প্রদর্শন করা হয়, তারাও মানুষ। তাদেরও প্রেম আছে, আছে ঘৃণা। তাদের আছে কোমল অনুভূতি। প্রিন্স হ্যারির মাকে যখন সমাহিত করা হয়, সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন শতসহস্র মানুষ। তারা এসেছিলেন খুব দুঃখ-ভারাক্রান্ত চিত্তে তাদের হৃদয়ের রানিকে বেদনাবিধুরভাবে শেষ বিদায় জানাতে। প্রিন্স হ্যারি তাদের সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন। এসব সাধারণ মানুষ প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি শেষ বিদায় জানাতে নিয়ে এসেছিলেন ৫০ হাজার ফুলের তোড়া, যা তাদের ভালোবাসার প্রতীক। প্রিন্স হ্যারি জনগণের সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে তাদের হাত ভেজা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু কেন? এ ভেজা হাত কি অশ্রু মোছার ফল? নাকি অন্য কিছু? আমি ভাবতে চাইব, অশ্রুভেজা হাতেই তারা প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। সবকিছুর মধ্যে এই একটিমাত্র অনুষ্ঠানে হ্যারি প্রকাশ্যে কেঁদেছিলেন। কী দুঃখের কথা, শোণিতে রাজরক্ত থাকলে কান্না করতে হবে হিসাব-নিকাশ করে! এটা যে কত দুঃখের, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন-

রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও যে শিশুরে

পরাও যারে মণিরতন হার-

খেলাধুলা আনন্দ তার সকলি যায় ঘুরে,

বসন-ভূষণ হয় যে বিষম ভার।

ছেড়ে পাছে আঘাত লাগি,

পাছে ধুলায় হয় সে দাগি,

আপনাকে তাই সরিয়ে রাখে সবার হতে দূরে,

চলতে গেলে ভাবনা ধরে তার-

রাজার মতো বেশে তুমি সাজাও শিশুরে,

পরাও যারে মণিরতন-হার।

ড. মাহ্বুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম