শতফুল ফুটতে দাও
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এ লেখা যখন লিখছি, তখন নতুন বছরের জানুয়ারির ৩ তারিখ। একটি জাতির জীবনে প্রতিটি বছর খুবই মূল্যবান।
একটি বছরে জাতীয় জীবনে অনেক রকম ঘটনা ঘটে। এগুলোর কোনো কোনোটি সুখপ্রদ, আবার কোনো কোনোটি দুঃখ-বিষাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২২ সাল অনেক দিক থেকেই ছিল ঘটনাবহুল। এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
সঠিকভাবে বলতে গেলে, এ নিষেধাজ্ঞা ছিল কতিপয় ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর। সীমিত আকারে এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে এ কথা অবশ্যই মেনে নিতে হবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশ বিশেষ পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশ ওই দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে গিয়ে দেশটি সম্পর্কে বিশ্বময় যে ধারণা প্রচলিত তার আলোকে প্রভাবিত হয়।
বাংলাদেশ সাফল্যজনকভাবে এর প্রথম দিকে এ দেশটি সম্পর্কে যেসব ধারণা তৈরি হয়েছিল সেগুলোকে গত ৫০ বছরের চেষ্টায় অনেকটাই অপনোদন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পরিসরে ইতিবাচক মনোভাব ছিল না। বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এটলাস-১৯৭৪ থেকে জানা যায় একমাত্র আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার মাথাপিছু আয় ওই সময় বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিল। অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ রুয়ান্ডার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। বাংলাদেশ তখনো একটি জনবহুল দেশ। তবে বাংলাদেশের তুলনায় ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা বেশি ছিল। তবে ইন্দোনেশিয়ার মাথাপিছু আয় তেমন আহামরি কিছু ছিল না। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল নাগাদ ইন্দোনেশিয়ার মাথাপিছু আয় ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হ্রাস পাচ্ছিল। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগের রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল অবস্থা বাংলাদেশকে পিছু টানছিল। ইন্দোনেশিয়ার একটি বড় সুবিধা ছিল সে দেশের খনিজ তেল সম্পদ। এ বিবেচনায় বাংলাদেশের উল্লেখ করার মতো প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল না। বাংলাদেশে কোনো কিছুকে যদি প্রকৃতির দান হিসাবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে দেশটির জনসম্পদ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। এই ৫০ বছরে আমরা অনেক পরিবর্তন দেখেছি। এসব পরিবর্তন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অবদান রেখেছে। পাকিস্তানে কারাবন্দি অবস্থা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘কবিগুরু দেখে যাও, তোমার বাঙালি এখন মানুষ হয়েছে।’ কথাটি কোনো ছেলেভোলানো ছড়া নয়। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে বাংলাদেশের জনগণ এক নতুন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছিল। সন্দেহ নেই সবার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। সোনার ছেলেদের অনেকেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই এবং খুন-খারাবিসহ বহুবিধ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিল তরুণদের একটি অংশ। একটি দেশে যখন দারিদ্র্য থাকে এবং সম্পদের ঘাটতি থাকে তখন সম্পদ হস্তগত করার জন্য এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রথম দশকে এ প্রতিযোগিতা সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ওই সময় বাংলাদেশে যেসব নৃ-বিজ্ঞানী ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এসেছিলেন, বাংলাদেশের গণচরিত্র নিরীক্ষণ করতে তখন তাদের প্রায় সবাই এক নিরাশাব্যঞ্জক ছবি এঁকেছেন। আমার এক বন্ধু নরওয়ের নৃ-বিজ্ঞানী এরিক ইয়ানসেন তার গবেষণা গ্রন্থ ‘Rural Bangladesh: Competition for Scarce Resources’-এ বলেছেন, ‘খুবই সীমিত সম্পদ নিয়ে গ্রামবাংলায় তীব্র প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে।’ তিনি তার গবেষণাভুক্ত গ্রামটির নাম দিয়েছিলেন ‘ভাইমারা’। নৃ-বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার গ্রাম বা সমাজকে প্রচলিত নামে লেখেন না। তারা এ কৌশলের আশ্রয় নেন গবেষণা অন্তর্ভুক্ত লোকজন যাতে মনোকষ্ট না পায়। ‘ভাইমারা’ নামটি একটি কল্পিত নাম। তবে এর দ্যোতনা ব্যাপক। যে গ্রামে ভাই ভাইকে মারে সেই গ্রামের নাম ভাইমারা উল্লেখ করলে সত্য কথাই বলা হবে। তবে লোকজন ঠাহর করতে পারবে না এটি কোন গ্রাম। ভাইমারাতে সামান্য সম্পদের জন্য যে প্রতিযোগিতা চলে, তার পরিণাম হিসাবে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের খুন হওয়ার মতো অবস্থা দাঁড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে এখনো যেসব হিংস্র সহিংসতা চলছে তার অধিকাংশের অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে সামান্য সম্পদকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থা। এ প্রতিযোগিতা যতক্ষণ পর্যন্ত সুনীতির সন্ধানে পরিচালিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা সম্পদ সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে। এ পর্যন্ত প্রতিযোগিতাটি সুস্থ। কিন্তু এ সীমা অতিক্রম করা হলে সেটা হয়ে যায় অসুস্থ ও ট্রাজিক।
বাংলাদেশ উন্নয়নের যে গল্প তৈরি করেছে, তা থেকে আমরা প্যারাডক্সের সন্ধান পাই। যে দেশে এত দুর্নীতি, সে দেশ এগোয় কী করে? যে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, সে দেশ এগোয় কী করে? যে দেশে সবকিছু নিয়ে বাণিজ্যের প্রয়াস চলে সে দেশ এগোয় কী করে? যে দেশে মেধা ও প্রতিভা অবহেলিত, সে দেশটি এগোচ্ছে কী করে? খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়, যে দেশে পাবলিক পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বাণিজ্য করা হয় সে দেশের কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে?
আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়তাম, তখন মার্কিন অর্থনীতিবিদদের লেখা বইতে পড়েছি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, একনাগাড়ে এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে তিনি দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছেন। অতএব, তিনি তার ক্ষমতা অব্যাহত থাকুক সেটাই কামনা করেন। আমরা যে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন পৃথিবী ছিল স্নায়ুযুদ্ধকবলিত পৃথিবী। সে সময় পরিবর্তন বলতে বোঝাত আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক অবস্থা থেকে মুক্তি। এ ধরনের সমাজ পরিবর্তন ভোটের মাধ্যমে করা যায় না। প্রয়োজন হয় গণবিপ্লবের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো যে কোনো দেশে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখলে হামলে পড়ত। এ জন্য ভিয়েতনামে মার্কিনিরা শত-সহস্র টন বোমাবর্ষণ করেছে। ভিয়েতনামের অগণিত নারী-পুরুষ রক্তের বিনিময়ে সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন মুক্তিসংগ্রাম দমনে ব্যর্থ হয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সরকার। কার্টার মানবাধিকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি শক্তিশালী খুঁটি হিসাবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনও মানবাধিকারকে পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এ নীতি গ্রহণের ফলে মার্কিনিরা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে নৈতিকতা যোগ করতে পারছে। এর ফলে মার্কিননীতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের চেয়ে আকর্ষণীয় (?) প্রতিভাত হচ্ছে। এ জন্য মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
আইএমএফ বলেছে, এ বছরটিতে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ দেশে অর্থনীতি সংকুচিত হবে। অর্থনৈতিক মন্দার তীব্রতা আরও কঠিনভাবে অনুভূত হবে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনগণ ধাতস্থ হয়ে উঠেছিল নিজেদের জীবনকে কিছু মসৃণ করতে। তাদের প্রয়াস অনেকাংশেই সফল হয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে করতে তারা নতুন চলার পথ খুঁজে নিয়েছে। এর জন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে চূড়ান্ত বাহবা দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের জনগণ স্বকীয় মেধায় অর্জনকে ধরে রেখে পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করতে পেরেছে। একেই বলে Continuity and Change. এখন দেখার বিষয় বিশ্ব অর্থনীতি যখন মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ কীভাবে তা মোকাবিলা করে। আমরা বলব, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ সামনের বছরটির জন্য চাই অগ্নিস্নানের প্রস্তুতি।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ