Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চেতনায় বুদ্বুদ

১০ ডিসেম্বর : কার জয়, কার পরাজয়

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১০ ডিসেম্বর : কার জয়, কার পরাজয়

গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সমাবেশ অনুষ্ঠান নিয়ে ওই তারিখের আগেই একটা লেখা লেখার বড় আগ্রহ ছিল।

কিন্তু ২০২৪-এর জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে বিধায় সংবাদপত্রগুলো বেশ আগেভাগেই তাদের সম্পাদকীয়-নীতিতে বেশ সতর্ক অবস্থানে চলে গেছে মর্মে টের পাচ্ছি। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে নিয়ে কোনো কড়া লেখা, সমালোচনা কতটুকু সম্পাদনা করে প্রকাশ করবেন কিংবা আদৌ প্রকাশ করবেন কিনা, তা দেখছি বেশ মেনে চলেছেন অনেকে।

আমাদের কিছু আঁতেল আবার দলীয় সমর্থনে যার যার অভিরুচি অনুযায়ী পরিপূর্ণভাবে একপেশে হয়ে পড়েছেন এরই মধ্যে। কারও কারও লেখা পড়লে আমার মনে পড়ে যায় টেলিভিশনে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এক সময়ের নির্বাচন-পূর্ববর্তী ক্যানভাসের কথা। ‘মনা’ হয়ে যাওয়া এখন স্বাভাবিক-যার নয়নে যারে লাগছেরে ভালো। সাংবাদিক, কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সমালোচক-যে যেই ঘরানারই হোন না কেন, হালে অনেকের লেখা পড়লেই কেন জানি মনে হয় তাদের অনেকেই ‘মতলবে বৈরাগী নাচে’র পর্যায়ে চলে গিয়েছেন। আমাকে নিয়েও কেউ কিছু ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু আমি অবাক হই, যখন দেখি বঙ্গবন্ধু-বাকশাল, জিয়া, সাত্তার, এরশাদ, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াকে নিয়ে মূল্যায়ন সহকারে সমালোচনামূলক লেখা ছাপাতেও কাউকে-কাউকে এখন আগপাছ কয়েকবার ভাবতে হয়। এতে ভিন্ন চিন্তার অবকাশ নেই; এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। সময়ে সমঝে চলতে হয়। কম-বেশি সবাইকে অস্তিত্বের বিষয়টি এবং ভবিষ্যতের দিকে খেয়াল রাখতেই হয়। সে চিন্তায় আমিও ১০ ডিসেম্বরের আগে ওই তারিখ নিয়ে বিএনপির হম্বিতম্বি এবং আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থান নিয়ে কিছু লিখিনি মূলত দুই কারণে-এক. লেখাটা হয়তো ছাপানো না-ও হতে পারে; নচেৎ দুই. ছাপানো হলেও আমার মতামতে কোনো পক্ষ হয়তো চরম বিরক্তিতে পড়ে যেতে পারে। আমার বিবেচনায়, আমি যে কোদালকে কোদাল বলে ফেলি! কিন্তু গুণীজনরা যে বলেন, সব সত্য কিংবা অপ্রিয় সত্য বলতেই নেই-আমি বোকা কেন সেটা মেনে চলতে পারি না?

১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপি অনেক বাচালের মতো কথাবার্তা বলেছে। ওসব বাচাল-বক্তব্য শুনে এবং পত্রিকায় পড়ে আমার এক ৩০ এপ্রিলের কথা মনে পড়ত। তখনো গর্জনের শেষ ছিল না। আমি আওয়ামী লীগের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের ‘ট্রাম্পকার্ডের’ কথা বলছি। আমরা কি তখনকার সময়ে মান্নান ভূঁইয়া-আব্দুল জলিলের সংলাপ দেখিনি? আমরা ওই সংলাপ নিয়ে কত হাসি-ঠাট্টা-মশকরা হতে দেখলাম। ফল হলো অশ্বডিম্ব। ট্রাম্পকার্ডে কী যে ট্রাম্প হয়েছিল. সেটা বোধকরি আওয়ামী লীগের গুণীজনরাও টের পেয়েছেন। একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বাচালের মতো কথাবার্তার মাধ্যমে সাময়িক স্টান্টবাজি হয়তো দেখানো যেতে পারে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এবার মির্জা ফখরুলের মতো ধীরস্থির-ভদ্রজনও কেন আব্দুল জলিলের ট্রাম্পকার্ডের বিষয়টি বিবেচনায় রাখলেন না, তা আমার মাথায় ধরে না। বিভাগীয় শহরগুলোতে চমৎকার সমাবেশ করেই ‘কী হনুরে’ ভাবে আসা যে সঠিক রাজনৈতিক গভীরতায় মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে হয়নি, তা বিএনপি এখন অবশ্যই বুঝতে পারছে। আমি আগের এক লেখায় ‘দিল্লি দূরাস্ত’ উল্লেখ করেছিলাম। আমাদের ছোটজনদের কথাবার্তা বড় বড় গুণী রাজনীতিক তো আমলেই নেন না। নেবেনই বা কেন, রাজনীতিকদের জ্ঞান যে সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। এখন পাতি-রাজনীতিকও একেকজন মহাজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত যে!

সরকারকে মির্জা ফখরুল যখন বলেন, ‘নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে, সিদ্ধান্ত বদল করুন’ (যুগান্তর ১ ডিসেম্বর, ২০২২), তখন আমার হাসির উদ্রেক হয়েছে। বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধরতে গেলে জিরোতে পৌঁছে গিয়েছিল বলা চলে। অনস্বীকার্য যে, বিএনপির প্রচুর সমর্থক রয়েছে, তাদের একটা ভোটব্যাংকও আছে, কিন্তু নেতৃত্ব দিয়ে সে সমর্থন গোছানো এবং আন্দোলনে তা কাজে লাগানোর সক্ষমতা তো দলটির গড়ে ওঠেনি, যা গড়ে উঠেছিল বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের। ২০০৭-এর জানুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের যে অবস্থান ছিল, তার পর্যায়ে কি এবার বিএনপি সংগঠিত ছিল? অবশ্যই ছিল না। বিএনপি একটা বিষয় ভাবে না যে, বিরোধী দলের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে দক্ষতা দেখাতে পারে, বিএনপি তা কখনো পারে না। আন্দোলন করার জন্য কোনো কোনো সময়ে যে মারদাঙ্গা ভাব দেখাতে হয়, সে ক্ষমতা তো বিএনপির নেই এবং কখনো ছিলও না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিএনপি নেত্রী আপসহীন থেকে যে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, সেটা কি আর তার এখন আছে? আবার ক্ষমতায় থাকতে তারেক রহমান যেভাবে তরুণদের সংগঠিত করতে পারতেন-দীর্ঘকাল বিদেশে থেকে তিনি কি এখন সে ক্ষমতা রাখেন? নিশ্চয়ই নয়। তাই যদি হয় তাহলে কোন সাহসে মির্জা ফখরুল সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিতে পারেন যে, নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে? এতই যদি অনড় থাকেন, তাহলে শেষে পিছিয়ে গেলেন কেন? লাখ লাখ লোক দিয়ে চারদিক থেকে নয়াপল্টনে এসে সমাবেশ করতে পারলেন না কেন? তার চেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কি উত্তম ছিল না? দুর্নীতির মামলায় সাজা পাওয়া খালেদা জিয়াকে যখন জেলে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ, তার আগেই ‘ওইদিন কী হবে’ ধরনের এক প্রশ্নের উত্তরে আমি যুগান্তরকে বলেছিলাম, কিছুই হবে না। আমার বক্তব্য ছাপাও হয়েছিল। হ্যাঁ, বিএনপি সেদিনও কিছুই করতে পারেনি। এই যখন অবস্থা তখন বিএনপির ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক শ্রেয় ছিল। গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে বিএনপি হয়তো এ তৃপ্তি পেতে পারে যে, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যায়নি। কুস্তিতে নিচে পড়ে থেকেও ‘আকাশ দেখছি’ বলে তৃপ্তি পাওয়া দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া যেতে পারে হয়তো, কিন্তু রাজনীতিতে এটা যে একটা বড় মার খাওয়া হয়ে গেল বিএনপির! বিএনপির এটা বড় পরাজয় হলো। বেচারা মির্জা ফখরুল তো জেলেই চলে গেলেন। নয়াপল্টন দূরে থাকুক, গোলাপবাগ মাঠেও তার প্রধান অতিথির বক্তৃতা দেওয়া আর হলো না। যেভাবে ভালোয় ভালোয় বিভাগীয় সমাবেশগুলো সফলভাবে করে আসছিলেন, ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা অবশ্যই বেহেতর ছিল বলা চলে। মোদ্দা কথা, বিএনপি রাজনৈতিকভাবে একটা মার খেল, সরকার তার অবস্থান ঠিক রেখে সফল হলো। বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ তাদের আরেক ভুল সিদ্ধান্ত, এ সিদ্ধান্তটা বরং এখন ক্ষতিকরই হলো।

কিন্তু এ সফলতায় আওয়ামী লীগ কি জয়ী হয়েছে? অবশ্যই না। আওয়ামী লীগ যেহেতু সরকারে, সেহেতু নয়াপল্টনে লাখো মানুষের সমাবেশ করতে দিতে দলটি অবশ্যই ভয় পেয়েছে বলা যায়। আওয়ামী লীগের মনে তখন নিশ্চয়ই ২০১৩-এর হেফাজতে ইসলামের মতিঝিল ‘দখলের’ স্মৃতি ভেসে বেড়িয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে অবশ্যই কৌশলী হতে হয়। রাজনৈতিক সে কৌশলে আওয়ামী লীগ ভেবেছে, রোগে ভুগে সেরে ওঠার চেয়ে রোগে আক্রান্ত না-হওয়া অনেক শ্রেয়; নয়াপল্টনের অনুমতি দিয়ে ‘হেফাজতী-দুশ্চিন্তায়’ যাওয়ার চেয়ে আগেই নয়াপল্টন গুঁড়িয়ে দেওয়া অনেক উত্তম। শেখ হাসিনার অনেক দুঃসাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের মধ্যে হেফাজতকে মোকোবিলা করা অন্যতম। তখন বেগম খালেদা জিয়া, এরশাদ এবং অন্যরাও হেফাজতী অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছিলেন, যাতে আওয়ামী লীগের বারোটা বাজে। এবার নয়াপল্টনে তেমন অবস্থা হলে বিএনপি নিজেদের অফিসের বাড়তি সুবিধা পেয়ে যেত, যেটা মতিঝিলে হেফাজত পায়নি। অতএব, আওয়ামী লীগ বা সরকার অবশ্যই কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। বিএনপিকে তাই নিজেদের ঘরের সামনে থেকে দূরে পাঠিয়েছে। গোলাপবাগ মাঠে রাজি না হলে তো বিএনপির সমাবেশই আর হতো না। তখন তারা আম-ছালা দুটিই হারাত। বিএনপি সমাবেশ না করতে পারলে আওয়ামী লীগের কিছুই যেত-আসত না। বরং বিএনপিই তখন আরও সমালোচনায় পড়ত। তবে জেদাজেদি হওয়ার আগেই নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সুযোগ দিলে আওয়ামী লীগের সার্থকতা বেশি হতো। তখন তাদের ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠত না। কোনো অঘটন ঘটাতে চাইলে বিএনপিকে তখন হেফাজতী কায়দায় একটা শিক্ষা দেওয়া যেত। আওয়ামী লীগের কি তেমন অবস্থা নিতে তৃতীয় কোনো শক্তির উন্মেষের ভয় ছিল? আওয়ামী লীগের ভাষ্য অনুযায়ী ২০০৭-এর এক-এগারো তাদের আন্দোলনের ফসল হলে এবারও তেমন কিছু হওয়ার কোনো ভয় কি ছিল? আমার তো তা মনে হয় না। দুই সময়ের মাঝে অনেক অনেক তফাত যে! আমার কেন জানি মনে হয়, বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ যদি এমন চ্যালেঞ্জ দিত, তাহলে তারা সেটা অবশ্যই বাস্তবায়ন করত। এখানেই আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে বিরাট পার্থক্য, ব্যবধান। অসম শক্তি বিএনপির সঙ্গে জেদাজেদিতে গিয়ে আওয়ামী লীগেরও পরাজয়ই হয়েছে বলা চলে।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলই তো হারল, তাহলে জিতল কে? জিতল পুলিশ। পুলিশ আরেকবার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাল। কারা নাকি পথচারীদের মোবাইলও চেক করেছে। কিন্তু তারা কারা? তারা যদি ছাত্রলীগের কেউ হন, তাহলেও প্রশ্ন জাগে-এমন চেক করার ক্ষমতা তাদের কে দিল? আওয়ামী লীগ তো পাহারা দিয়েছে। আহারে পুলিশ, বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যা করেছে, এখন আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির সঙ্গেও তা-ই করল। পুলিশ তো, তাই দুই বিরোধী দলকেই তারা সমান সম্মানে দেখেছে। ওই আমলে আওয়ামী অফিস যেমন ঘেরাও থাকত, তেমনি এ আমলে বিএনপি অফিস। পাল্লায় ওজন দিয়ে দেখলাম, পুলিশেরই হলো মহাজয়, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েরই পরাজয়। আপনারা কী বলেন?

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম