শতফুল ফুটতে দাও
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নির্ভুল তালিকা জরুরি
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গতকাল ছিল শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। প্রতিবছর আমরা এ দিবসটি পালন করি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ও শোকে।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুঃসংবাদ আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী যখন তার হোলস্টারে রাখা পিস্তলটি মাটিতে রাখলেন, সেই মুহূর্তটি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ছিল অতুলনীয় আনন্দ ও গর্বের। আত্মসমর্পণের এ প্রতীকী দৃশ্যটি দেখে বাংলাদেশের মানুষ অল্পক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিল আগের নয় মাসের খুনখারাবি ও নারীর সম্ভ্রমহানির বেদনার কথা। কিন্তু ততক্ষণে সংবাদ আসতে থাকল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত উপায়ে হত্যার। সেজন্যই যুদ্ধজয়ের আনন্দ হারিয়ে গিয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যার শোকাশ্রুতে।
পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তারা ভীষণভাবে অপছন্দ করত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের। তবে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ পাকিস্তানিদের সঙ্গে কোলাবোরেট করেছিল। তারা চিন্তা ও মননের দিক থেকে ছিল ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের বন্দিদশায়। ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ড. হাসান জামান ও ড. মোহর আলীর মতো ব্যক্তিরা চিন্তার রাজ্যে থমকে গিয়েছিলেন ১৯৪৭-এ। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের ধীরে ধীরে মোহমুক্তি ঘটছিল। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেক বুদ্ধিজীবী তাদের জ্ঞানসম্পদ ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০-এই ২৩ বছর সময়ে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রচিন্তার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। এ ক্রমবিকাশের পথ ধরে তারা নিজেদের আবিষ্কার করেন নতুন এক রাষ্ট্রের যোদ্ধা হিসাবে।
পাকিস্তানিরা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কত তীব্রভাবে অপছন্দ করত, তা বোঝা যায় কিছু ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, বাংলা ভাষাভাষী জনগণকেও ঘৃণা করত পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তগোষ্ঠী। এক্ষেত্রে বাঙালিদের সম্পর্কে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার আত্মজীবনী ‘Friends Not Masters' গ্রন্থে লিখেছেন, 'East Bengalis, who constitute the bulk of the population, probably belong to the very original Indian races. It would be no exaggeration to say that up to the creation of Pakistan, they had not known any real freedom or sovereignty. They have been in turn ruled either by the caste Hindus, Moghuls, Pathans or the British. In addition, they have been in still are under considerable Hindu cultural and linguistic influence. As such they have all the inhibitions of down trodden races and have not yet found it possible to adjust psychologically to the requirements of the new born freedom. Their popular complexes, exclusiveness, suspicion and sort of defensive aggressiveness probably emerge from this historical background.’
এ তো গেল বাঙালিদের সম্পর্কে পাকিস্তানের এক সাবেক প্রেসিডেন্টের মন্তব্য। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারতের বিমানবাহিনী গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) স্ট্র্যাফিং করার পর গভর্নর হাউজের বেশ ক্ষতি হয়। এ ভবনেই বসতেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তিনি ছিলেন অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের উপদেষ্টা। ১৬ ডিসেম্বরের পর রাও ফরমান আলীর রুমে একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। ডায়েরিটি রাও ফরমান আলীর ব্যবহৃত টেবিলের ওপর পড়ে ছিল। ডায়েরিটি পেয়েছিলেন ভুইয়া ইকবাল। ভুইয়া ইকবাল পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। ওই সময় তিনি দৈনিক বাংলায় সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন। ভুইয়া ইকবাল ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য। ডায়েরিটি তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন। ওই ডায়েরিতে প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর ওপর লেখা নোট ছিল। আমি ভুইয়া ইকবালকে এই ডায়েরির ওপর একটি প্রতিবেদন লেখার পরামর্শ দিই। আমি তাকে বলেছিলাম, ইতিহাসের বিচারে এ প্রতিবেদনটি খুবই সময়োপযোগী ও মূল্যবান হবে। দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদনটি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে আমাদের সমাজে দুরকমের তত্ত্ব আছে। প্রথম তত্ত্বটি হলো, পাকিস্তানি সেনারা তাদের দালালদের দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নতুন দেশ বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা চালিয়েছিল। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হলো, এটা ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাজ। ভারত নাকি চেয়েছিল বাংলাদেশ মেধাশূন্য হয়ে গেলে ভারত থেকে আনা বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসকদের দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের অফিস-আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম চালানো হবে। যা হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জেনারেল বিএন সরকার সার্বিকভাবে বাংলাদেশের প্রশাসনকে সহায়তা করার ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। কিন্তু ভারতের এ ধরনের সহায়তার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অগ্রাহ্য করেন।
দেখা যাচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। এ বিভ্রম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য জ্ঞানী-গুণী বোদ্ধা মানুষকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এ কমিশনের দায়িত্ব হবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা এবং এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য আহরণ করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ওপর আলোকপাত করা। এ কাজটি না করা হলে জাতি হিসাবে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর অবিচার করব। এ অবিচার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিও সমভাবে করা হবে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার একটি প্রামাণ্যদলিল প্রকাশ করা অপরিহার্য। বাংলাদেশের ঊষালগ্নে দেশের সাংবাদিকরা বেশকিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এসব প্রতিবেদন দেশের গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলোয় প্রকাশিত হয়েছিল। এসব প্রতিবেদনে ২০-২৫ জন শহিদ বুদ্ধিজীবী কীভাবে নিজ বাসভবন থেকে ধৃত হলেন, কীভাবে একটি কাদামাখা বাসে তাদের চোখ বেঁধে তুলে নেওয়া হয়েছিল এবং বধ্যভূমিতে তাদের লাশ কীভাবে শনাক্ত হয়েছিল, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তবে কিছু বুদ্ধিজীবীর লাশ পাওয়া যায়নি। বুদ্ধিজীবীদের যখন হত্যা করা হয়, তখন তাদের ওপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছিল তার আভাস পাওয়া গেছে লাশগুলোর সুরতহালে।
বুদ্ধিজীবী দিবস এলে দেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোয় একঝাঁক বুদ্ধিজীবীর ছবি দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেবল তাদেরই কি হত্যা করা হয়েছে? আমার ধারণা, বাংলাদেশের জেলা-উপজেলায় অবস্থানরত অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীকেও হত্যা করা হয়েছে। তারা মফস্বলের বুদ্ধিজীবী। তাদের কেউ কলেজ বা স্কুলের শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী এবং কেউ লেখক কিংবা কবি। তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা হওয়া উচিত। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে যেভাবে ছেলেখেলা হয়েছে, এমনকি দুর্নীতিও হয়েছে, সে রকম কিছু শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার ক্ষেত্রে যদি ঘটে, তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। আমি বুদ্ধিজীবী হিসাবে যেসব পেশাদারের কথা বলেছি, তারা অপরিচিত মানুষ নন। এখনো তারা যে যেখানে ছিলেন সেখানকার মানুষ তাদের কথা স্মরণ করতে পারে। তবে আরও কিছুদিন গেলে স্মরণকারী মানুষদের পাওয়া যাবে না। ফলে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের বৃহত্তর তালিকাও ত্রুটিমুক্ত থাকবে না। সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই তো করা দরকার। শুধু তালিকা করার জন্য তালিকা নয়। তালিকাটি সঠিক হলে একখণ্ড সঠিক ইতিহাসও পাওয়া যাবে। দেশে একাত্তরের শহিদদের তালিকা করার দাবি আছে। এটি বাস্তবায়ন করতে হলে খুব ভেবেচিন্তে এবং আন্তরিকভাবে এগোতে হবে। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার আগে পদ্ধতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। তালিকা করার পদ্ধতিতে যদি ভুল থেকে যায়, তাহলে তালিকাটিও নির্ভুল হবে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কোনো কাজের উদ্যোগ নিলে আমরা অনেক আওয়াজ-আয়োজন করি, কিন্তু ফল কী হবে তা ভেবে দেখি না। এরকম হলে পুরো ব্যাপারটি হয়ে যাবে পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল মোটামুটিভাবে দুই পর্বে। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে যখন পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইট শুরু করল, তখন সে রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কজন স্বনামধন্য শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন দার্শনিক গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মনিরুজ্জামান প্রমুখ। শোনা যায়, পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করতে চেয়েছিল বাংলার অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে। কিন্তু ভুল বুঝে তারা হত্যা করে পরিসংখ্যানের অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান আমাদের পরিসংখ্যানের ক্লাস নিতেন। অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমানও পাকিস্তানি সেনাদের টার্গেটে ছিলেন। তিনি বেঁচে যান তার ফ্ল্যাটের দরজায় তালা মেরে রাখার ফলে। পাকিস্তানি সেনারা মনে করেছিল তিনি বাসায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যেসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, অনুদৈয়পায়ন ভট্টাচার্য, ডাক্তার মর্তুজা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ডাক্তার আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যাদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদের খুনিরা আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিল বলে মানুষের বিশ্বাস। ঢাকার বাইরে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে কুমিল্লার কংগ্রেস নেতা ধীরেন দত্তসহ অনেককে।
আমি মনে করি, বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আরও মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। আমরা যে উদাসীন ও দায়িত্বহীন, তার প্রমাণ মেলে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের দেওয়ালটি সারা বছর অবহেলায় থাকার পর কেবল ১৪ ডিসেম্বর এলে তার ধোয়ামোছার আয়োজনে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ