Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্বাধীনতার পর কতটা এগিয়েছে উচ্চশিক্ষা

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতার পর কতটা এগিয়েছে উচ্চশিক্ষা

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার অনেক বছর আগে থেকেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বনাশের বীজটি রোপণ করা হয়। অঙ্কুরের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, সময় পরিক্রমায় ওই অনাকাক্সিক্ষত বীজটি দীর্ঘদিনে এখন অনেকটাই পত্র-পুষ্প-ফল ও শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে। যাদের ওপর শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও দেখভাল করার দায়িত্ব, তাদের দায়িত্বহীনতা-উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনা এবং উলটো যাত্রা বিগত তিন দশকে সর্বনাশের প্রক্রিয়াটিতে জলসিঞ্চন করায় দিনে দিনে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। হয়তো ইচ্ছা করে কেউ করেননি; কিন্তু কেউ স্বীকার করুন আর না করুন-বাস্তবে সবার সামনেই এমন বীজ বোনার কাজটি হয়ে গেছে।

ব্রিটিশ আমলে আমি যাব না। পাকিস্তান আমল, এমনকি আমাদের স্বাধীনতার পর সত্তর কিংবা আশির দশকে যাদের জন্ম, তাদেরও বলে সহজে বোঝানো যাবে না যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চশিক্ষার ফাঁদে পড়ে লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর বর্তমানে কী ত্রাহি অবস্থা! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাশ কোর্সে এখন সব শাখাতেই (কলা, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান) শিক্ষার্থীদের তিন বছরে মোট ২১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয় (প্রথমবর্ষে ৭০০, দ্বিতীয়বর্ষে ৭০০ ও তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষে ৭০০ নম্বর)। অর্থাৎ আশি কিংবা নব্বই দশকের তুলনায় একেবারে দ্বিগুণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি নম্বরের পরীক্ষা সফলভাবে মোকাবিলা করে তবেই একজন শিক্ষার্থীকে পাশ কোর্সের স্নাতক (গ্র্যাজুয়েট) হতে হচ্ছে। একই ভাবে চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্সের ক্ষেত্রেও একই কথা। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকাকালীন মোট ১৫০০ নম্বরের (অনার্স ৯০০ + সাবসিডিয়ারি ৬০০) আগের সেই সিলেবাস এখন আর নেই। মেজর ও নন-মেজর বলে কথিত ৩২০০ নম্বরের বিষয়, পত্র বা কোর্সের পরীক্ষা মোকাবিলা করে তবেই সম্মানসহ স্নাতক হওয়া যায়। এর মানে, পাশ কোর্সের মতোই অনার্সেও দ্বিগুণ বা এরও বেশি নম্বরের পরীক্ষা গ্রহণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যায়, ডিগ্রি কোর্সটি (অনার্স এবং পাশ) খুবই দীর্ঘ এবং বেশ কঠিন। কিন্তু বাস্তবে? এমন দীর্ঘ ও কঠিনের আড়ালে আরও কি কিছু লুকিয়ে আছে? হ্যাঁ, আর প্রধানত এ কারণেই আজকের এ লেখাটির অবতারণা। এ এক অবিশ্বাস্য রকমের ভেলকিবাজি, নিজের সঙ্গে তো বটেই; গোটা জাতির সঙ্গেও। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, এমনকি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও, বাস্তবতাটি এমনই যে-বছরে নামকাওয়াস্তে দু-চারদিন ক্লাসে উপস্থিত থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন শত শত কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাশ ও অনার্স এবং মাস্টার্সের মতো একেকটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। অনিয়মিত নয়, ক্লাসে অনুপস্থিতদের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবেই বছর বছর এ সুযোগটি করে দিয়ে চলেছে কর্তৃপক্ষ। বাস্তবিকই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন উচ্চশিক্ষার হালহকিকত নিয়ে মানুষের ভাবনা ও দুর্ভাবনার শেষ নেই।

অতি সহজেই সুযোগ পেতে পেতে শিক্ষার্থীদের মাঝে এরূপ ক্লাস না করার প্রবণতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। দিনে দিনে পরিস্থিতিটি যে কী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, তা শিক্ষার সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নন; তাদের বোধকরি সহজে বিশ্বাসই করানো যাবে না। ডিগ্রি পাশ কোর্সের মেয়াদ এখন তিন বছর। সেমিস্টার পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রথমবর্ষ, দ্বিতীয়বর্ষ ও তৃতীয়বর্ষে (চূড়ান্ত) পৃথকভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশ করতে হয়। লক্ষ করার বিষয় হলো, অধিভুক্ত কলেজগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৫০, ৪০, ২৫ শতাংশ, এমনকি শাখা বা বিষয় বিশেষে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীও ক্লাসে উপস্থিত থাকে না।

কলেজে কলেজে এবং কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা সব শাখার ক্ষেত্রেই বলতে গেলে একই পরিস্থিতি। আর বিজ্ঞান শাখায় তো শিক্ষার্থী এমনিতেই কমছে দিন দিন। শহর এবং মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুব একটা আলাদা করা যাবে না। এ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা এবং বিড়ম্বনার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গ্রাম বা মহল্লায় আশপড়শি তরুণ-তরুণীদের পড়ালেখার খোঁজখবর জানতে চাইলে অনেকেই বলে-ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ কিংবা গুরুদয়াল কলেজে অনার্স পড়ি। পরক্ষণেই যখন জিজ্ঞাসা করা হয়-‘বাড়ি এলে কবে?’ এ প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘বাড়িতেই তো থাকি।’ ‘বাড়িতেই থাক! তার মানে? ক্লাস করো কীভাবে, আসা-যাওয়া?’ অবাক করার মতো জবাব দেয় ওরা, ‘ক্লাস তো করতে হয় না।’ সবার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলেও এমনটাই এখন সারা দেশের অনার্স বা পাশ কোর্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় কমন অবস্থা।

শিক্ষার্থীদের যে ক্ষুদ্র অংশটিকে শিক্ষকরা ক্লাসে পান, তা কেবল প্রথম বর্ষেই। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বা চূড়ান্ত বর্ষে (অনার্সের ক্ষেত্রে চতুর্থ বর্ষে) একদম করুণ অবস্থা। এদিক দিয়ে বাংলা, ইংরেজি, দর্শন, ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর সমাজকর্ম সব বিষয়ই যেন একাকার। যার যার রুটিন অনুযায়ী হাজিরা খাতা এবং চক-ডাস্টার হাতে নিয়ে ক্লাসে গিয়ে কোনো শিক্ষার্থীর সন্ধান না পেয়ে যথারীতি ফিরে আসার দুঃসহ বিড়ম্বনাময় অভিজ্ঞতা নেই-এমন শিক্ষক আজকাল খুঁজে পাওয়াটা আসলেই বোধকরি খুব দুষ্কর হবে। শিক্ষকদের এমন অভিজ্ঞতা এক-দুই দিনের নয়। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি-‘দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, সপ্তাহের পর সপ্তাহ।’ এছাড়া একটি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যদি ১০০, ১৫০ কিংবা ২০০ জন থাকে আর শিক্ষক পড়াতে গিয়ে ক্লাসে পান মাত্র ১০, ১২ কিংবা ১৫ জনকে, তাহলে এটাকে কী বলা যায়। শিক্ষকদের আরও একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বিড়ম্বনা হলো-আজ যে শতকরা পাঁচ, আট বা দশ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ক্লাসে পেলেন, আগামীকালের ক্লাসে আর ওদের সবাইকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। উপস্থিতির হার হয়তো একই থাকবে কিংবা একটু এদিক-সেদিক হবে; কেবল নতুন ও পুরোনো মুখের আংশিক অদল-বদল। এ অবস্থায় বিষয়ভিত্তিক কোর্সের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পড়াতে গিয়ে এ-ও এক মহাবিড়ম্বনা। নতুন আর পুরোনো মুখের অদল-বদলে যে কজন শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত থাকে, তারা কি আসলে শিখতে আসে? আমার তা মনে হয় না। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য থাকে তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে শিক্ষকের কাছ থেকে একটি তথাকথিত সাজেশন আদায় করা। সাজেশন আদায় হয়ে গেল তো শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার আরও কমে গেল। স্যারের দেওয়া সাজেশন আর গাইডবই দেখে দেখে প্রশ্ন ও উত্তর মেলানো-এই করতে করতেই বছর শেষ। তবু কিছুটা রক্ষা; নিয়ম অনুযায়ী এক কলেজের পরীক্ষার্থীকে অন্য কলেজ কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দিতে হয়। তা না করে আগের মতো নিজেদের কলেজেই বসে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে পরীক্ষার হলে এমনসব অসংখ্য পরীক্ষার্থীর দেখা পাওয়া যেত, যাদের ক্লাসে তো দূরের কথা, শিক্ষকরা ক্যাম্পাসেই কখনো দেখেননি।

শুধু পাশ কোর্স নয়, অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্সের বেলায়ও বলতে গেলে একই পরিস্থিতি। শ্রেণিকক্ষে লাগাতার অনুপস্থিতি, চরম অমনোযোগিতা ও কেবল গাইডবইয়ের তত্ত্ব-তালাশ। গাইড বই-ই শিক্ষার্থীদের আশা-ভরসা। বলা যায়, একমাত্র অবলম্বন। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মতোই ডিগ্রি পাশ, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদেরও হাতে হাতে বিভিন্ন কোম্পানির প্রকাশিত গাইডবই শোভা পাচ্ছে। গাইডবই কিনতে, হাতে রাখতে কিংবা হাতে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করতে কারও কোনো সংকোচ নেই। মূল বই কেনা এবং পড়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই নেই তাদের। কালেভদ্রে ক্লাসে ঢুকলে শিক্ষার্থীরা গাইডবইয়ের সঙ্গে শিক্ষকের দেওয়া বক্তৃতা মিলিয়ে দেখে নেয় কোনটি তার কাছে অধিকতর বোধগম্য। গাইডবইয়ের বাইরে যে বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি বা বিখ্যাত লেখকের গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ বই রয়েছে বা থাকতে পারে, এ সম্পর্কে বেশির ভাগেরই কোনো ধারণা নেই। ধারণা থাকবে বা এ ব্যাপারে শুধু শিক্ষার্থীদেরই বা দোষ দেওয়া যাবে কীভাবে! মূল বই বাজারে কেনাবেচা বা পাওয়া গেলে তো ওরা কিনবে? শুধু জেলা সদর নয়, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েরও অনেক প্রতিষ্ঠানে এখন অনার্স-মাস্টার্স পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু থাকলে কী হবে; এসব কোর্সের মোটামুটি উপযোগী বিভিন্ন বিষয়ের মূল বই কয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিংবা আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। কদাচিৎ যদি কোনো কৌতূহলী শিক্ষার্থী ‘যে কোনো লেখকের’ একটি মাত্র মূল বই কিনতে আগ্রহী হয়, তাহলে খুঁজতে খুঁজতে সে গলদঘর্ম হয়ে যাবে!

এখানে আর একটি কথা বলা বোধকরি প্রাসঙ্গিক হবে। মান নির্বিশেষে বিষয়ভিত্তিক অসংখ্য গাইডবইয়ের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে কেবল শিক্ষার্থী নয়, অনেক শিক্ষকও বলতে গেলে দিশেহারা। শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে আছেন এবং সংখ্যাটি নিতান্ত কম হবে না-যারা প্রধানত গাইডবইয়ের ওপর নির্ভর করে শিক্ষাজীবনের প্রতিটি স্তর অতিক্রম করে এসেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা শিক্ষার্থীদেরও গাইডবই কিনে পড়তে বেশি উৎসাহিত করেন। গাইডবইয়ের ছড়াছড়ি, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের অনীহা এবং বাস্তব পরিস্থিতি-সবকিছু বিবেচনা করে স্বনামখ্যাত লেখক ও অভিজ্ঞ শিক্ষকরা মূল বই লেখার ব্যাপারে অনেকটা নিস্পৃহ হয়ে পড়েন।

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষবিমুখতার কারণ অনুসন্ধান, এর বাস্তবচিত্র এবং বিরাজমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের কাজটি সহজ নয়। বিষয়টি নিয়ে বড় পরিসরে আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে কর্মশালা হতে পারে। সবকিছু শুধু আইনকানুন দিয়ে হয় না, যদি না এর যথাযথ প্রয়োগ হয়। এমনকি পাকিস্তান আমলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কলেজিয়েট, নন-কলেজিয়েট ও ডিস-কলেজিয়েট শব্দগুলো খুবই শোনা যেত। নন-কলেজিয়েট ও ডিস-কলেজিয়েট হিসাবে অনেককেই মাশুল গুনতে দেখা গেছে। এ ধরনের বিধান এখনো চালু আছে, তবে তা নামমাত্র; কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। স্বীকার করতেই হবে-বই, পড়াশোনা ও শ্রেণিকক্ষবিমুখতা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা আজকাল পরীক্ষায় বেশ ভালো ফলাফল করছে। অবশ্য এ নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা। আমরা চাই, সবস্তরেই শিক্ষার্থীরা যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক; ধাপে ধাপে অর্জন করা সনদপত্রগুলো কোনোক্রমেই যাতে শিক্ষার্থী এবং তার পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম