আমদানি-রপ্তানিতে স্বচ্ছতা আনা জরুরি

মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অনেকটাই উত্তপ্ত বলা চলে। সাধারণ মানুষ মনে করছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতা পুনর্দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে দুই দল।
তাদের এ ক্ষমতার লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের জীবন সংকটের মধ্যে পড়েছে। ভোগান্তির মাত্রা বেড়েছে। আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠীগুলো কোনোকালেই সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা আমলে নেয়নি; এ সময়েও এর ব্যতিক্রম কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মানুষের জীবনকে উন্নততর করাই রাজনীতির কাজ। রাজনীতির বাইরে মানুষের জীবন পরিচালনা করা অকল্পনীয়। একটি খারাপ রাজনৈতিক পরিবেশকে প্রতিরোধ করতে হলে এর বিপরীতে একটি সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রয়োজন।
রাজনীতির মোকাবিলা রাজনীতি দিয়েই করতে হবে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, বড় দুটি রাজনৈতিক দলের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে জনজীবন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে রাজনীতিবিমুখ, আরও স্পষ্ট করে বললে-রাজনীতিবিরোধী। রাজনীতির নামে মানুষের চিন্তাশক্তিকে যে পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, মানুষের মনে যে ধরনের বিতৃষ্ণার জন্ম দেওয়া হয়েছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে এ থেকে মুক্তিলাভের সম্ভাবনা কম বলেই বোধ হচ্ছে।
বিগত পাঁচ দশকে আমাদের দেশে শাসকের পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু তাতে করে দমননীতি, দুর্বৃত্তায়ন আর লুটপাটের চিত্রে কোনো রকমের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। তাই রাজনীতিবিমুখ হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই।
রাজনীতি ও অর্থনীতি পৃথকভাবে পঠিত দুটি বিষয় হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রথমটির দ্বারা দ্বিতীয়টি প্রভাবিত। অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কী হবে, তা নির্ভর করে শাসনক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তুলনামূলকভাবে খানিকটা কম গণতান্ত্রিক দেশের অর্থনীতিও ভালো ফল করতে পারে।
উদাহরণ হিসাবে আমাদের সামনে আছে ভারত ও চীন। গত চার দশকে ভারত চীনের তুলনায় গণতন্ত্রায়নে এগিয়ে আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় চীনের গতি লক্ষণীয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়েছে। দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে দুটি দিকই নেতিবাচক দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে গণতান্ত্রিক আচারে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নিুগতি প্রবহমান।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ স্থিতিশীল, বিভ্রান্ত হওয়ার মতো কিছু নেই-সরকারি মহলের এমন আশ্বাসের ওপর ভরসা করা দায়। গত সপ্তাহের সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর চোখ বুলালে তেমন চিত্রই পাওয়া যায়। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত চিত্রের একটি বড় অংশই হলো বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে, হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র পর্যালোচনা করে মোটা দাগে যা বলা যায় তা হলো, আমরা আমদানি বাবদ খরচ করেছি ৮২ বিলিয়ন ডলার। এ আমদানি ব্যয় মেটানোর প্রধান দুটি উৎস হলো রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়। আমরা ৫০ বিলিয়নের মতো রপ্তানি করেছি আর রেমিট্যান্স পাঠানো হয়েছে কম-বেশি ২০ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে ১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হয়েছে, যা আমাদের রিজার্ভ থেকে মেটানোর কথা। আয় থেকে ব্যয় বেশি হলে ঘাটতি হবে এটাই স্বাভাবিক। বছরওয়ারি ঘাটতি মেটাতে গিয়ে আমাদের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে এসেছে ২৩ বিলিয়ন ডলারে। আমাদের আমদানি ব্যয় প্রতি মাসে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে আগামী তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এর মানে এই নয় যে, আমরা রাতারাতি দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছি। তবে বলা চলে, এখনো যদি আমরা রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের লেনদেনে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে না পারি, তাহলে অবস্থা নাজুক হতে বাকি থাকবে না।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক এক্সপোর্ট রিসিপ্টস অফ গুড্স অ্যান্ড সার্ভিসেস ২০২১-২২ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনের সত্যতা আমাদের মনে কিছুটা হলেও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রতিবেদন বলছে, আমরা গত অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে যে পরিমাণ মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছি তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে আসেনি। এমনিতেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছি, তার ওপর এরকম সংবাদে চিন্তিত না হওয়ার কারণ নেই।
আমাদের রপ্তানিকৃত পণ্যের তালিকা যত বড় করেই দেখানো হোক না কেন, আমলে নেওয়ার মতো রপ্তানি পণ্য খাত মাত্র পাঁচটি; যে খাতগুলো থেকে আমরা বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে থাকি। খাতগুলো হলো-তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং কৃষিপণ্য। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এ পাঁচটি পণ্য রপ্তানির সময়ে যে পরিমাণ অর্থমূল্য থাকে, প্রাপ্তির বেলায় তার চেয়ে কম হয়। এ রপ্তানিমূল্য ও প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে পার্থক্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পাট ও পাটজাত পণ্যে পার্থক্যের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ, পোশাক রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পার্থক্য ২৩ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বেলায় তা ৪১ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি ও প্রাপ্তির ব্যবধান প্রায় ৫৮ শতাংশ। আমাদের মোট রপ্তানির প্রায় ৮২ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।
সেই অর্থে পোশাক খাত আমাদের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য ছিল ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী অর্থপ্রাপ্তির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৬৮ কোটি ডলার। রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হলো হোম টেক্সটাইল এবং অর্থপ্রাপ্তির ব্যবধানে এর অবস্থান প্রথম। গত অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানিকৃত পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ১৬২ কোটি ডলার; কিন্তু অর্থপ্রাপ্তির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬৮ কোটি ডলার। গেল বছরে রপ্তানির ক্ষেত্রে তৃতীয় বৃহত্তম খাত ছিল চামড়া ও চামড়াজাত। এ খাতে গত অর্থবছরে রপ্তানিকৃত পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ১২৪ কোটি ডলার; এর বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ ছিল ৭৩ কোটি ডলার। অর্থের প্রাপ্তি-ব্যবধান থেকে রেহাই পায়নি পাট ও পাটজাত পণ্যও। গেল বছরে এ খাত থেকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১২ কোটি ডলার; আর বছর শেষে প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ হলো ১০১ কোটি টাকা।
যে কয়টি খাতের উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রতিটিরই উদ্যোক্তাদের সংগঠন রয়েছে। রপ্তানিমূল্য ও প্রাপ্তির এ ব্যবধানের বিষয়ে তারা মতামতও দিয়েছেন। যেসব কারণের কথা তারা বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে-পণ্য জাহাজীকরণ ও অর্থপ্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান তিন থেকে ছয় মাসও হয়ে যায়, তাই হিসাবটা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। কিন্তু ডেফারড পেমেন্টের কারণে প্রাপ্তির সময় বিলম্বিত হলেও তা পরবর্তী সময়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় যে কারণটির কথা বলা হয়েছে তা হলো-ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট। এটা ঠিক, কোনো কোনো ক্রেতাকে অনেক সময় নির্ধারিত মূল্যের কমমূল্য নির্ধারণ করে ডিসকাউন্ট দিতে হয়। এ যুক্তি মেনে নিয়েও বলা চলে, এ ডিসকাউন্ট ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি হতে পারে না। কারণ, এর বেশি ডিসকাউন্ট দিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। সুতরাং সব যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে বলা চলে, এত বড় পার্থক্য আমাদের মনকে বিচলিত করতে বাধ্য। কারণ, অর্থ পাচারের একটি স্থায়ী ভীতি আমাদের সংস্কৃতিতে আসন গেড়ে আছে। যে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়, সে দেশে লেনদেনের এমন ফারাক জনমনে শঙ্কা তৈরি করবে বৈকি!
রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে যেমন স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে, তেমনটি রয়েছে আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রেও। গত বছরের জ্বালানি তেল আমদানির হিসাবে অনেক বড় ধরনের ফারাক দেখা যাচ্ছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশন (বিপিসি) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০২১-২২ অর্থবছরের আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের হিসাবে আকাশচুম্বী পার্থক্য দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট ১ হাজার ২০৫ কোটি ৮০ লাখ বা ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৭ কোটি ডলার। পরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১১৯ কোটি বা ১১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের।
সরকারিভাবে জ্বালানি তেল আমদানিকারক একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিপিসি। বিপিসি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সংস্থাটি মোট ৬৬ লাখ ৭ হাজার ২২৪ টন জ্বালানি তেল আমদানি করেছে। এতে সংস্থাটির মোট ব্যয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ৮০ লাখ বা প্রায় ৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেলে ব্যয় হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলে ব্যয় হয়েছে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। বেসরকারিভাবে সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার আমদানি করেছে ৮১ কোটি বা শূন্য দশমিক ৮১ ডলারের তেল। তাহলে আমদানিকারকদের হিসাব অনুযায়ী মোট আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের মূল্য দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের চেয়ে ৫ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার কম।
এবারে আসা যাক কাস্টমসের হিসাবে। কাস্টমসে শুল্কায়িত জ্বালানি তেলের মূল্য সম্পর্কে এনবিআরের তথ্য হচ্ছে, গত অর্থবছরে দেশে মোট জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে ৪৫ হাজার ১০৭ কোটি টাকার। গত অর্থবছরের শুরু ও শেষ দিনে ডলারের বিনিময় হার গড় করে এর পরিমাণ পাওয়া যায় ৫ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। তাহলে উল্লেখিত তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি বলছে ১২ বিলিয়ন, দ্বিতীয়টি প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন আর তৃতীয়টি বলছে ৫ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ কোন তথ্যের ওপর নির্ভর করব?
নির্দিষ্ট কারও প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টি দেওয়া আমাদের ইচ্ছা নয়। তবে মনীষীরা বলেন, ভ্রান্ত জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতা তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। এর সূত্র ধরে আমরা বলতে চাই, ভুল তথ্য প্রদানের চেয়ে তথ্য প্রদান না করা অনেক ভালো। আমাদের দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের তথ্য প্রদানের নির্ভরযোগ্য উৎস হলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআর। তাদের দেওয়া তথ্যের মধ্যে যদি বিস্তর ফারাক থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের নির্ভরতা কার ওপর দাঁড়াবে?
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়