নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি
সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে

ড. আর এম দেবনাথ
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থা কী-এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পর একমাত্র অর্থমন্ত্রী। কিন্তু অর্থমন্ত্রী খবরের কাগজে অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় অর্থনীতির অবস্থা জানার উপায় কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো আছেনই। এর বাইরে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক ও গবেষকরা। দেখা যাচ্ছে, তারা অর্থনীতির অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যামূলক মন্তব্য করছেন।
কেউ বলছেন অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, কেউ বলছেন অর্থনীতি সংকটে নিমজ্জিত। আবার কেউ কেউ বলছেন অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে, সংকটে পড়েনি। অনেকের ধারণা, আমরা পড়েছি এক অস্বস্তির মধ্যে। মন্দার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব অর্থনীতি এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু তার সুর মনে হয় একই। এবং এ কথা নির্জলা সত্য যে, যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, অর্থনীতি এমন অবস্থায় উপনীত যখন মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। এটা মুখের কথা নয়, সরকারি তথ্যেই প্রকাশ পাচ্ছে।
সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা বোঝা যায় একটি সূচক দিয়ে। আর এ সূচকটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি বা ইনফ্লেশনের। সর্বশেষ তথ্যে জানা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতির হার গত অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরের তুলনায় সামান্য কমেছে। হ্যাঁ কমেছে, কিন্তু তা এত সামান্য যে তার উল্লেখ না করলেও চলে। অবশ্য ভরসার কথা এই যে, মূল্যস্ফীতি আর বাড়েনি। এটি অবশ্যই স্বস্তির খবর।
এও স্বস্তির খবর যে, সামনে আমন ধান উঠবে। দেশের অনেক জায়গায় আমন ধান অবশ্য উঠতে শুরু করেছে। এর একটা ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়বে বলে আশা করা যায়। এদিকে একটা ভালো খবর হচ্ছে, শীতকালীন শাকসবজি বাজারে আসছে, আসছে মাছও-নানা পদের মাছ। এতেও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। এ বিষয়ে সরকারের আশাবাদ আমরা ইতোমধ্যে শুনেছি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই ভাবিত হলেও আমি বিষয়টি দেখি কিছুটা ভিন্নভাবে। মূল্যস্ফীতি হবে, এটা রোধ করার ক্ষমতা কারও নেই-কম অথবা বেশি। উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী বন্ধু হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-৭১) তুলনায় জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। চাল, ডাল, লবণ, তেল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম থেকে শুরু করে প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে অনেক। শতকরা হিসাব এখানে অকার্যকর। বেড়েছে ‘গুণের’ হিসাবে।
মুশকিল হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি যেভাবে বেড়েছে, মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব, তা গড়ের হিসাব। এখানে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির আয় যেমন আছে, তেমনি দরিদ্রতম ব্যক্তির আয়ও আছে। ফলে গড়ের হিসাব আয় বাড়লেও বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় ব্যয়ের অনুপাতে বাড়েনি। এতে অগণিত মানুষের জীবনমানের ক্রমাবনতি ঘটেছে। এখানে সর্বশেষ তথ্যের কথা বলা যায়। তথ্যটি সরকারের।
যে বিবিএস মূল্যস্ফীতির তথ্য দেয় তারাই বলছে, জাতীয় মজুরি গত অক্টোবরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হারে। তার মানে কী? মূল্যস্ফীতি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে জাতীয় মজুরি। কিন্তু রহস্যটা কোথায়? যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেই হারে মজুরি বৃদ্ধি পায়নি। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম গড়ে বেড়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ হারে, আর মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ হারে। এখানে দুই শতাংশ ঘাটতি। এর অর্থ জীবনধারণের মান কমেছে। যে যা খেত, পরত, ভোগ করত, এখন তা পারছে না। যারা ভোগ ঠিক রেখেছে, তারা অবশ্যই সঞ্চয়ে হাত দিয়েছে।
আরও কথা আছে। যাদের মাসিক আয় নির্দিষ্ট, তাদের আয় তো বাড়েনি। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেউ বেতন-মজুরি-ভাতা বাড়ায়নি। মজুরি বৃদ্ধি এমন সব ক্ষেত্রে ঘটেছে যেখানে তা সম্ভব। এ অবস্থা আজকের নয়। মূল্যস্ফীতির হার বেশি, আয় বৃদ্ধির হার কম। আবার এই ফাঁকে ধনীদের, অতিধনীদের আয় বৃদ্ধি ঘটেছে আশাতীত হারে। তারাই লাভবান, অবস্থার সুবিধাভোগী।
বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ঘটছে বাইরের কারণে। প্রথমে করোনা অতিমারি বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে। এখন করছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে রাতারাতি কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব বেড়ে গেছে। এটা অবশ্যই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনা।
কিন্তু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর অতিমুনাফা প্রবণতা। তারা অবস্থার পুরো সুযোগ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের সংকট তৈরি করে টাকা বানাচ্ছে। এই যেমন এ মুহূর্তে চিনির দাম ১২০ টাকা কেজি। টাকা দিলেই চিনি পাওয়া যায়, অথচ বলা হচ্ছে চিনির অভাব রয়েছে। কারণ মিল মালিকরা অপরিশোধিত চিনিকে বাজারযোগ্য করতে পারছেন না। গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। এ কারণে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ৫০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতা। এটা শুধু চিনি শিল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, শিল্প খাত সামগ্রিকভাবেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল/গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সরকার বাধ্য হয়ে ভর্তুকি কমিয়েছে পেট্রল, জিজেল, কেরোসিন ও অকটেনে। ফলে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। বর্ধিত মূল্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রচুর ডলার খরচ হচ্ছে। ফলে ডলারের রিজার্ভ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ছিল ৪৮ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার, এখন তা নেমেছে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে।
আইএমএফ অবশ্য বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের রিজার্ভ মাত্র ২৭ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে ভীষণভাবে টান পড়ায় ডলারের দাম হঠাৎ ৮৭-৮৮ টাকা থেকে ১০৬-০৭ টাকায় উঠেছে। অবশ্য এ দামে ডলার পাওয়া যায় না বাজারে। ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলো ঋণপত্র খুলতে পারছে না। সরকার অপ্রয়োজনীয় আমদানি হ্রাস করেছে। ঋণপত্র খোলার ওপর বিধিনিষেধ জারি করেছে। তেল/গ্যাস খরচ কমানোর জন্য অফিসের সময়সূচি পরিবর্তন করেছে। লোডশেডিং চলছে। বিশ্বের বড় বড় ব্যাংক আমাদের ঋণপত্র ‘অনার’ করছে না। তারা আমাদের ‘লাইন অফ ক্রেডিট’ হ্রাস করেছে। ব্যাংকাররা এ নিয়ে দেনদরবার করছে।
ডলারের সংকট দুভাবে তৈরি হয়েছে। ডলারের উৎস তিনটি-রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণ। রপ্তানি আয় আগের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। রেমিট্যান্সে টান পড়েছে। রেমিট্যান্সে থাবা বসিয়েছে হুন্ডিওয়ালারা। তারা ডলারের দাম বেশি দিয়ে রেমিট্যান্স প্রেরকদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে নিচ্ছে। এতদসত্ত্বেও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, এখনো আমাদের যে ডলার রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে ৩-৪ মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো যাবে।
এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। আইএমএফের ঋণের টাকা ছাড় হতে পারে। সাহায্যের যে ‘পাইপ লাইন’ আছে, সেখানে কিছু ডলার পাওয়া যেতে পারে। এদিকে দেখা যাচ্ছে, ডলারের সংকটে মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পাচ্ছে। ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ তিন পণ্যের আমদানি কমেছে যথাক্রমে ৬৬, ১৪ ও ১৪ শতাংশ হারে। এটা ভালো খবর নয় কোনোভাবেই। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি হচ্ছে শিল্পায়নের সূচক। মধ্যবর্তী পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির তথ্য থেকে বোঝা যায় শিল্পের অবস্থা কী। একটি খবরে দেখলাম, মোটরসাইকেল বিক্রি গত এপ্রিলের তুলনায় সেপ্টেম্বর/অক্টোবরে বেশ হ্রাস পেয়েছে।
পণ্য রপ্তানির তথ্যেও নিুগতি। গত সেপ্টেম্বর/অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে ৬ দশমিক ২৫ এবং ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ হারে। ভারী শিল্পে উৎপাদন হ্রাসের ঘটনা পুরোনো খবর। ইস্পাত, সিমেন্ট, বস্ত্র ও সিরামিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে। এর থেকে বোঝা যায় দেশের নির্মাণশিল্পে একটা মন্দা দেখা দিয়েছে। শিল্পে কেবল উৎপাদন কমেছে, বিক্রিও কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতির ঘটনাও ঘটছে।
সর্বশেষ খবরে দেখলাম, দেশের বড় দুটি কোম্পানি জুলাই-সেপ্টম্বর প্রান্তিকে লোকসান দিয়েছে। অথচ এরা খুবই লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে ওয়ালটন ও সিঙ্গার। নামেই তাদের পরিচয়। মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি, লোডশেডিং, উৎপাদন ঘাটতি, বিদ্যুৎ/গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি, রপ্তানি হ্রাস, আমদানি বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স হ্রাস ইত্যাদিই হচ্ছে এ মুহূর্তের বড় সমস্যা। এটা শুধু আমাদের অবস্থা নয়, সারা বিশ্বই একই সমস্যায় জর্জরিত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, আগামী দুবছরে যে মন্দা দেখা দেবে, তার লক্ষণ হবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ পরিশোধের সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো সুদের হার সমানে বাড়াচ্ছে। এর ফলে মন্দা আরও ঘনীভূত হবে।
বিশ্ব পরিস্থিতি ও দেশীয় অবস্থা বিবেচনায় অনেকেই বলছেন, আগামী দিনগুলো হবে খুবই কঠিন, ঝুঁকিপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি হবে জটিল। অনিশ্চয়তার চিত্র দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। আশার কথা, সরকার সমগ্র পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার সাবধানতা অবলম্বনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন মিতব্যয়ী হতে, সাশ্রয়ী হতে, সঞ্চয়ী হতে। তিনি কৃষি উৎপাদনের প্রতি গভীর নজর দেওয়ার কথা বারবার বলছেন। এক ইঞ্চি জমি পতিত না রাখতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। মেগা প্রজেক্ট গ্রহণ করতে বারণ করেছেন। অপচয় বন্ধ করার আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেছেন বিলাসী পণ্যের ব্যবহার এড়িয়ে চলতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা/উপদেশ থেকে বোঝা যায় তিনি পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তিনি শুধু কৃষির কথা বলেননি, বলেছেন ছোট ছোট শিল্প, কুটিরশিল্প, অতিক্ষুদ্র শিল্পের কথা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব উপদেশ বাস্তবায়ন করবে কে? সরকারি ব্যবস্থা/প্রশাসনিক অবস্থা কি এসব বাস্তবায়নের উপযোগী? আমাদের প্রশাসনের দক্ষতা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দেখতে হবে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি। বিদ্যুৎ, সার, বীজ, কীটনাশকের অভাবে যাতে কোনোভাবেই কৃষি উৎপাদন ব্যাহত না হয়। কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ঋণ সহজলভ্য করা দরকার। সস্তা করা দরকার। এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ছোট ছোট শিল্প যাতে চাঙা থাকে, তার ব্যবস্থা সর্বাগ্রে করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থান বেশি এসব শিল্পেই। আরও লক্ষ রাখা দরকার-বেসরকারি খাতে যেন অহেতুক চাকরিচ্যুতির ঘটনা না ঘটে। ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর জন্য রেমিট্যান্স বৃদ্ধির যাবতীয় পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। বিলাসদ্রব্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা দরকার।
ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়