ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কি শরণার্থী সমস্যা দূর করবেন?
সোলায়মান তুষার
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের পরিবার তিন প্রজন্ম ধরেই ভারতের বাইরে বসবাস করেন। তার দাদা-দাদি দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে পূর্ব আফ্রিকায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেক বছর বাদে তারা যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন শহরে এসে বসবাস করতে থাকেন।
১৯৮০ সালে জন্ম হয় ঋষি সুনাকের। তিনি সাউদাম্পটনেই বড় হয়েছেন। ব্রিটেনের রাজনীতিতে খুব দ্রুতই উত্থান হয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাকের। ২০১৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথম পার্লামেন্ট সদস্য হন সুনাক। আর এর মাত্র সাত বছরের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন।
গত ২৪ অক্টোবর ঋষি সুনাক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর ২৫ অক্টোবর বাকিংহাম প্রাসাদে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস। এই প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ এবং অভিবাসী পরিবারের সন্তান ব্রিটেনের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হলেন।
ঋষি সুনাক এমন একসময় প্রধানমন্ত্রী হলেন, যখন ব্রিটেন কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যায় আক্রান্ত। স্থবির প্রবৃদ্ধি, ১০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড মহামারি ও ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারের অস্থিতিশীলতা। এসবের সঙ্গে রয়েছে শরণার্থী সমস্যা।
২০২১ সালে যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের ৪৮,৫৪০টি আবেদন জমা পড়ে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটিতে শরণার্থীদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে’র সময় থেকে শরণার্থীদের দুর্ভোগ বাড়তে থাকে। থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হলে সমস্যা আরও প্রকট হয়। এরপর কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন।
কিন্তু শরণার্থীদের দুর্ভোগ কমেনি। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় শরণার্থীদের অনেক অধিকার রহিত হয়েছে। ব্রিটেন সরকার নতুন আইন করেছে শরণার্থীদের বিষয়ে। এর ফলে শরণার্থীদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
গত ২৮ জুন থেকে দেশটিতে ন্যাশনালিটি অ্যান্ড বর্ডারস অ্যাক্ট-২০২২ কার্যকর হয়। আইনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন দুটো হলো-শরণার্থীদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করা এবং স্বয়ংক্রিয় ডিপোর্টেশন নীতি, যা দেশটিতে বসবাসকারী এশীয় ও বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলবে।
প্রথমত, আইনটির ১২ ধারার অধীনে সরকার আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন নীতি তৈরি করেছে, যেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা হোম অফিস আশ্রয়প্রার্থীদের অস্থায়ী শরণার্থী (আড়াই বছরের জন্য) এবং শরণার্থী (বিদ্যমান ব্যবস্থায় যারা পাঁচ বছর পর সেটেলমেন্টে যাওয়ার সুযোগ পান) এ দুটি ভাগে শ্রেণীকরণ করবে।
অস্থায়ী শরণার্থীদের ১০ বছর পর্যন্ত প্রতি আড়াই বছর পরপর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হবে এবং এরপর তারা সেটেলমেন্টের সুযোগ পাবেন (অনিদির্ষ্টকালের জন্য)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অস্থায়ী শরণার্থীরা কমপেশনেট গ্রাউন্ডসে কারণ দর্শানো ছাড়া তাদের পরিবারের সদস্যদের স্পন্সর করতে পারবেন না।
এর অর্থ হলো, তারা স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের আনতে পারবেন না। তবে প্রচলিত ব্যবস্থায় শরণার্থীরা সহজেই তা করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অব স্টেটকে বেআইনিভাবে যুক্তরাজ্যে প্রবেশকারী বা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও অবস্থানকারী যে কোনো অভিবাসীকে ডিপোর্টেশন বা দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
আইনের ধারা ৪০-এর (এফ) অংশের (এ) ও (বি) অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষকে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার পাশাপাশি ৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। (চলতি বছরের ২৮ জুনের আগেও তা ৬ মাস পর্যন্ত ছিল)। এছাড়া যদি কেউ ১২ মাসের বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডাদেশ পান, তাহলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অব স্টেটকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ইউকে বর্ডারস অ্যাক্ট-২০০৭-এর ধারা ৩২(৫)-এর অধীনে ডিপোর্টেশনের আদেশ দিতে হবে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল সম্প্রতি রুয়ান্ডার সঙ্গে ‘মাইগ্রেশন পার্টনারশিপ’ চুক্তি করেন। এর লক্ষ্য হলো ‘যারা বিপজ্জনক, অবৈধভাবে বা প্রয়োজন ছাড়াই যুক্তরাজ্যে আসছেন তাদের জীবন উন্নত করার লক্ষ্যে স্থানান্তরিতকরণ’। ১২০ মিলিয়ন পাউন্ড চুক্তির অধীনে রুয়ান্ডা আশ্রয় আবেদনগুলো বিবেচনা করবে এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে সেগুলো ‘মীমাংসা বা বাতিল’ করা হবে। হোম অফিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ৩০০ জনকে রুয়ান্ডায় পাঠানো হবে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের জুনে কয়েকজন শরণার্থীকে রুয়ান্ডায় ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত হস্তক্ষেপ করলে তা বাতিল হয়। নতুন আইন ও রুয়ান্ডার সঙ্গে চুক্তি কার্যকর হলে শরণার্থীদের দুর্ভোগ বাড়বে বহুগুণে। নিজ দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়েও হতাশ হতে হবে শরণার্থীদের। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে কি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবেন?
ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার : অনারেবল সোসাইটি অব লিঙ্কন ইনস ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য