চেতনায় বুদ্বুদ
আলোচনায় জনপ্রশাসনের দুটি খবর

বদিউর রহমান
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রতিককালের দুটি খবর বেশ আলোচিত হচ্ছে। দুটি খবরই দেখা যাচ্ছে জনপ্রশাসন ব্যক্তি-সম্পর্কীয়। জানি না, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তাবাবুদের বিষয় বলেই খবর দুটি এত গুরুত্ব পেয়েছে কি না। রাজনৈতিক নেতা বা এমপি সাহেব গুলি চালালেন কিংবা শিক্ষক পেটালেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা বিনা কারণে ছাত্রদলকে পেটাল অথবা খোদ পুলিশের সামনে অস্ত্রের মহড়া দিল, ইডেনের নেত্রীরা নেতাদের ‘খেদমতে’ নিরীহ ছাত্রী পাঠালেন, কিংবা এমপি সাহেবের লাইসেন্সকৃত পিস্তলের গুলিতে তার কেউ মারা গেলেন, বদির কাহিনি না হয় না-ই বা বলা হলো অথবা আমানুল্লাহও না হয় বাদ গেলেন-তারপরও খবরগুলো সাময়িক গুরুত্বের পর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। জিকে শামীম, সম্রাট, পাপিয়া, এনু-রূপন, ডা. সাবরিনা কী-ই না খবর হলো, নতুন খবরের ভিড়ে পুরোনোগুলোর কদর অবশ্যই কমে যায়-এটা স্বাভাবিক রীতি। সেসব খবরের তুলনায় এক সচিবকে সরকার কর্তৃক অবসর প্রদান, তারপর আবার তিন পুলিশ কর্তাকে; এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্যসচিবের জন্য নতুন বাসস্থান নির্মাণের খবর কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ? হয়তো মোটেই নয়, কিন্তু তারপরও এসব খবর বেশ আলোচিত হয়, অনেককেই উৎসুক করে, ঘটনার পেছনের কারণ খোঁজা নিয়ে আগ্রহ বাড়ে, সাংবাদিকদেরও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। হবেই তো, খবরগুলো যে আমলা নিয়ে, প্রশাসনের বড় বড় কর্তাবাবু নিয়ে। এর পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে-১. প্রশাসনের কর্তাদের নিয়ে জনমনে আগ্রহ থেকে এমন হতে পারে, অথবা ২. তাদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা থেকে হতে পারে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে ধারণা থেকেই হোক, বিষয়টি বিবেচনায় আসার যোগ্য হয়েছে বলা চলে।
প্রথমে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সরকার কর্তৃক সিভিল সার্ভিস আইনের বিধান অনুসারে ২৫ বছর চাকরি পূর্তিতে অবসর প্রদান নিয়ে আলোচনা করা যাক। আগের গণকর্মচারী (অবসর গ্রহণ) আইন, ১৯৭৪-এর ৯(১) ধারার বিধান অনুসারে কোনো সরকারি কর্মচারী ২৫ বছর চাকরি পূর্তিতে ৩০ দিনের আগাম লিখিত নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে অবসর নিতে পারতেন। কর্মচারী নিজে ইচ্ছা করে এমন অবসরে যেতেন বিধায় এটাকে স্বেচ্ছা অবসর হিসাবে গণ্য করা হতো। আর ওই আইনের ৯(২) ধারা অনুসারে সরকারও জনস্বার্থে ২৫ বছর চাকরি পূর্তিতে কাউকে অবসর দিতে পারত। কর্মচারীর ইচ্ছায় নয় বলে অর্থাৎ সরকারের অভিপ্রায়ে হতো বলে এটাকে বাধ্যতামূলক অবসর নামে চেনা যেত। আইনে কিন্তু বাধ্যতামূলক শব্দের উল্লেখ ছিল না। তবে ৯(২) ধারায় জনস্বার্থের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ জনস্বার্থটা কী? কীভাবে এ জনস্বার্থ পরিমাপ করা হয়? এর কোনো ব্যাখ্যা কিন্তু আইনে নেই। সরকারের অনেক আদেশই তো জনস্বার্থে হয়, কর্মচারীদের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি-কোনটা জনস্বার্থে নয়? জনস্বার্থ প্রকৃত অর্থে এমনভাবে ধরে নিতে হয় যে, সরকার যেহেতু জনগণের স্বার্থেই কাজ করে থাকে, সেহেতু সরকারের ইচ্ছা সব সময়ই জনস্বার্থে হবে। এমনকি সরকার কোনো কর্মচারীর ব্যক্তিস্বার্থে কিছু করলেও সরকারি ভাষায় সে আদেশ হতে হবে জনস্বার্থে, নচেৎ ওই আদেশ আইনিভাবে সহিশুদ্ধ গণ্য হবে না। রাষ্ট্র সার্বভৌম, কিন্তু রাষ্ট্র তো পরিচালনা করে সরকার, সরকারই রাষ্ট্রের সব কাজকর্ম দেখভাল করে; অতএব, বাস্তবে সরকারই কিন্তু সার্বভৌম। শুনতে খারাপ লাগতে পারে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে একটু বেসুরো ঠেকতে পারে, কিন্তু সরকারের চেয়ে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আর কে? তবে সরকার অবসর প্রদান করতে চাইলে কোনো কারণ দর্শাতে বাধ্য নয়-উইদাউট অ্যাসাইনিং অ্যানি রিজন। ব্যক্তিও কিন্তু অবসরে যেতে চাইলে কারণ দর্শাতে বাধ্য নন। দুপক্ষের ক্ষমতাই ধরা যায় সমান সমান, তফাত সামান্য এই যে, ব্যক্তিকে ৩০ দিনের আগাম, লিখিত নোটিশ দিতে হয়, সরকারের তা লাগে না। বর্তমান সিভিল সার্ভিস আইনেও আগের বিধান বলবৎ রাখা হয়েছে। অধিকারটা উভয় পক্ষের আনক্যাটার্ড রাইট।
তবে আইনি ভিত্তিতে করা হলেও আমি এটাকে শুদ্ধ আইনি প্রক্রিয়া মনে করি না। এটা একটা জুলুম বলা চলে। ব্যক্তি সরকারের তুলনায় কত ক্ষুদ্র, কত নগণ্য। ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত অসুবিধায় স্বেচ্ছায় যেতেই পারে। কিন্তু সরকার তো ব্যক্তির অভিভাবক, রাষ্ট্রের প্রতিভূ; তাই সরকার এভাবে কাউকে অবসর প্রদান করলে তা কল্যাণমূলক ভাবা অতীব কঠিন। হ্যাঁ, কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থেকে থাকলে তো তার জন্য বিভাগীয় মামলা করে শাস্তি প্রদানের, এমনকি চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারণের ব্যবস্থাও রয়েছে। সে পথে যাওয়াই কি কল্যাণমুখী সুশাসনের লক্ষণ হতো না? কিন্তু বলা হয়ে থাকে যে, অনেক অভিযোগ অনেক সময় প্রমাণ করা কঠিন হয়, কোনো সময়ে হয়তো সম্ভবও হয় না। তারপর আবার আদালতে সরকারকে হেরেও যেতে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। অতএব, সহজ উপায় হচ্ছে আইনে এ ক্ষমতাটা রেখে দেওয়া। সরকার তাই সিভিল সার্ভিস আইনেও এটা রেখেছে, যা সরকারের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা না হলেও অন্তত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার এক মোক্ষম হাতিয়ার। আমাকে যখন বারবার সচিব পদে পদোন্নতি-বঞ্চিত করা হলো, তখনো অপদার্থ এসএসবি ‘আরও তথ্য প্রয়োজন’ ধরনের বায়বীয় মন্তব্য দিয়ে কাজ সেরে নিত।
এ ধরনের অবসর প্রদান মাঝখানে অনেকটা থেমে গিয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ হয়তো বেশ আস্থাশীল হয়ে গিয়েছিল। এখন এ ধরনের অবসর প্রদানের দুমুখী ব্যাখ্যা হতে পারে-১. সরকার হয়তো জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুধাবন করতে পারছে যে কাউকে কাউকে বিভাগীয় মামলায় না এনেই সরানো দরকার, অথবা ২. এ ধরনের অবসর প্রদানের দ্বারা সরকার সরকারি কর্মচারীদের একটা ভীতিকর বার্তা দিয়ে সাবধান করে নিরাপদ থাকতে চাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে সরকার কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে যে, ভেতরে-ভেতরে ভিন্ন কোনো আলামত রয়েছে? তা না হলে, শেখ হাসিনা সরকরি কর্মচারীদের জন্য কী না করেছেন? এখন এভাবে অবসর দিতে যাবেন কেন? তবে সাবধানের মার নেই। আওয়ামী লীগ উপকৃত হলেও সরকারের নিশ্চয়ই জনতার মঞ্চ, পরে উত্তরা ষড়যন্ত্র, পান্ডা গার্ডেনের অনুষ্ঠানের কথা মনে থেকে থাকতে পারে। আমরা জানি না, সরকার এ ধরনের আরও অবসর প্রদানে আগ্রহী হবে কি না। এটুকু বলব যে, কোনো রাজনৈতিক দলেরই দলীয়মনা সৃষ্টি ভালো কাজ নয়, কর্মচারীদের কর্মচারী রাখাই সর্বোত্তম, দেশ চালাবেন রাজনীতিকরা।
আইনি ভিত্তিতে ওই সচিব কিংবা তিন পুলিশ কর্তার অবসর প্রদানকে অন্যায় বলার সুযোগ থাকল না, যদিও আমি কখনো সরকারের এমন ক্ষমতা প্রয়োগকে সবল সরকারের লক্ষণ ভাবি না। আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটাই সাংবিধানিকভাবে বেআইনি কি না, সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
২.
মন্ত্রিপরিষদ সচিব আর মুখ্যসচিবের জন্য ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আলাদা বাসস্থান নির্মাণের বিষয়টি বড়ই নগণ্য। কিন্তু খবরটা বড় হয়ে গেল সম্ভবত দুই কারণে-১. সরকারের কৃচ্ছ্রসাধনের গলা ফাটানো এ সময়ে এটা দৃষ্টিকটূ ঠেকেছে বা শ্রুতিমধুর হয়নি। ইভিএম কেনায়, আমার বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় ইভিএমে আট হাজার সাতশ কোটির বেশি ব্যয়ের তুলনায় ৪৩ কোটি তো কিছুই না। তারপরও এটাও এখনকার বিবেচনায় একটা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প। ২. আমার মনে হয়, আমলাতন্ত্রের বড় এ দুপদের কর্তাদের সম্পর্কে তেমন ভালো ধারণা বা সশ্রদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি যে, এ দুজন কর্মকর্তার পৃথক বাসস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষ খুশি হবেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদটা তো সিভিল সার্ভিসের সর্বোচ্চ পদ, এ পদের কর্তাব্যক্তি সিভিল সার্ভিসের অভিভাবক, পদটা একটা প্রতিষ্ঠানও বটে। কিন্তু সিভিল সার্ভিসকে প্রকৃত সিভিল সার্ভিসরূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ পদধারীদের অবদান চোখে তো পড়েই না, বরং সার্ভিসটাকে রাজনীতিকীকরণে এর পদধারীদের নীরব হলেও ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। এ পদধারীরা প্রকৃত পদক্ষেপ নিলে সিভিল সার্ভিসের মানের অবনমন ঘটত না, নিয়োগ-পদোন্নতিতেও এত হতাশা থাকত না, সরকারকে অযথা অনেক দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না। আর মুখ্যসচিবের পদটা আমার বিবেচনায় একটা বড় পদ বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো কাজেরই নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব কাজ মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অধীনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেই চলতে পারে। এ কার্যালয়ের উচ্চ পদাধিকারীরা বরং কাজের দ্বৈততা সৃষ্টি করে এবং অহেতুক নাক গলিয়ে কাজের সুষ্ঠু ধারাবাহিকতায় অন্তরায় সৃষ্টি করেন। সরকারপ্রধানকে তারা মিসগাইড করেন মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তো তার সচিব/মুখ্যসচিব ‘ডুবিয়েছেন’ মর্মেও মুখরোচক কথা চাউর হয়েছিল। তাদের বিষয়ে সিভিল সার্ভিসের পুরোনোরা কি জানেন না?
যাকগে, এ দুজন কর্তাবাবুর জন্য কোনো অজুহাতেই এখন আলাদা বাসভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় না। তিন বাহিনী প্রধানের বাসভবনের সমতুল্যতায় এ দুজনের আলাদা বাসস্থানের যৌক্তিকতা সার্বিক বিচারে ধোপে টেকে না। এটা বাদ দেওয়াই ভালো।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান