ঘরে-বাইরে মহাসংকটে মিয়ানমার জান্তা
ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সামগ্রিক ক্ষমতা পাকাপোক্তকরণ ও সামরিক শাসনকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে। তারা ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে, যা তাদেরই তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৬২ সাল থেকে দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও অধিক সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন থেকে সামরিক জান্তা রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ক্ষমতার বিস্তার ঘটায়। নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে শুরু করে হত্যা ও ধর্ষণসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা সামরিক জান্তা করেনি।
পরবর্তীকালে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১১ সালে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জোট ক্ষমতায় আসার মাধ্যমে দেশটিতে গণতন্ত্রায়ণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন থেকে সামরিক জান্তা ও এনএলডি ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে যৌথভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছিল।
এমনকি সু চি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্বর ও নৃশংস কার্যকলাপের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। এই এক দশক এনএলডি ক্ষমতায় থাকলেও কার্যত সামরিক জান্তাই ছিল সর্বেসর্বা। সাংবিধানিক আইনে সংসদে সামরিক বাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণ এবং স্বরাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখার মাধ্যমে জান্তা তার ক্ষমতা আরও সুসংহত করে।
কিন্তু ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সামরিক জান্তা ও এনএলডির মধ্যকার সম্পর্কে পরিবর্তন আনে। বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে জান্তার ক্ষমতা চিরস্থায়ীকরণের পথ রুদ্ধ হবে, এটা ভেবে সামরিক জান্তা ২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডির জয়কে মেনে নেয়নি। তাই তারা তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ীকরণের পথের বাধা দূর করতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়।
এককভাবে ক্ষমতা ভোগ করার জন্য জান্তার চেষ্টা ও পরিকল্পনা বেশিদিন টিকে থাকেনি। তিনটি কারণ বা বাধা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। প্রথমত, সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই দেশব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আইন অমান্য আন্দোলন সামরিক জান্তাকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। প্রত্যুত্তরে জান্তা সরকার ব্যাপক দমন ও নিপীড়ন চালালেও জনগণের আন্দোলনকে থামাতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, প্রতিরোধ আন্দোলনের পাশাপাশি এনএলডি গঠিত বিকল্প জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্রম ও আন্দোলনের কারণে জান্তা সরকার আরও চাপে পড়ে। প্রাথমিকভাবে এনইউজিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বেশ বেগ পেতে হলেও পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ হিসাবে এনইউজির ভূমিকার ওপর জোর দিচ্ছে।
এর ফলে জান্তার ওপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়ত, জান্তা সরকার বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছে। এসব জাতিগত গোষ্ঠী এনইউজিকে সমর্থন করছে এবং অনেকেই এনইউজির সঙ্গে জোট করেছে। একই সঙ্গে এসব জাতিগত গোষ্ঠী জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিজস্ব সামরিক শক্তি তৈরি করেছে। ফলে মিয়ানমারে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জান্তা সরকার ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
অন্যদিকে, এনইউজি তাদের কার্যক্রমকে শুধু রাজনৈতিক ফ্রন্টে সীমাবদ্ধ না রেখে সামরিক শক্তির পথ বেছে নিয়েছে। তারা সামরিক বাহিনীর সমান্তরাল হিসাবে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নামে একটি সামরিক কমান্ড গড়ে তুলেছে। পিডিএফ জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অন্যান্য জাতিগত ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। ফলে এই ত্রিমুখী প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে জান্তা সরকার মিয়ানমারে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, দৃঢ় রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য জান্তা সরকার আরাকান আর্মির মতো কিছু বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে জোট তৈরি করেছিল।
প্রথমদিকে আরাকান আর্মি জান্তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলত, কিন্তু সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আরাকান আর্মি নিজেদের কৌশল বাস্তবায়ন শুরু করেছে। ক্রমেই তারা জান্তার বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে উঠছে এবং জান্তা সরকারও তাদেরকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখতে শুরু করেছে। সুতরাং, জান্তা সরকার সবদিক দিয়েই বিপাকে পড়েছে। সম্ভবত, তারা তাদের দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে এত বড় সমস্যায় কখনো পড়েনি। ইতঃপূর্বে সামরিক বা রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও একই সময়ে এ দ্বিমুখী চাপের মুখে পড়েনি। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে জান্তা সরকার দ্বিতীয় পর্যায়ে চতুর্মুখী প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর দেশব্যাপী ব্যাপক গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হলেও সেটি রাজনৈতিক ফ্রন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু গত আগস্ট থেকে জান্তা সরকার মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এনইউজি, পিডিএফ, জাতিগত ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধসহ জনপ্রতিরোধের মুখে পড়ছে। বিশেষ করে রাখাইনে আরাকান আর্মির প্রতিরোধের মুখে পড়ে জান্তা বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি তাদের মধ্যকার সংঘর্ষ নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন, মংডু ও সিত্তওয়েসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। আরাকান আর্মির উপর্যুপরি আক্রমণে জান্তা বাহিনী অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়েছে। তারা ভাবেনি যুদ্ধ এতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে এবং আরাকান আর্মির কাছে তারা সামরিকভাবে পর্যুদস্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে জান্তা বাহিনী উত্তর রাখাইনে তাদের বেশ কয়েকটি কৌশলগত ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, রসদ সরবরাহ লাইনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এবং তাদের কয়েক ডজন সৈন্য নিহত হয়েছে। আরাকান আর্মির আক্রমণে পরাজিত হয়ে জান্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
অধিকন্তু, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা অব্যাহতভাবে রাজনীতিক ও বেসামরিক নাগরিকদের দমন করছে। তারা নির্বিচারে হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জয়ের জন্য তাদের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করছে। কিন্তু কৌশলগতভাবে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার ভূখণ্ডের মাত্র ১৭ শতাংশ জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, ৫২ শতাংশ এনইউজির অধীনে এবং বাকি অঞ্চলে কোনো দলেরই নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং ধারণা করা যায়, জান্তা মিয়ানমারে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। রাখাইনেও তারা বেশ ধরাশায়ী। এটি এখন স্পষ্ট যে, যেসব অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো খুব বেশি সক্রিয়, সেসব অঞ্চলে তাদের কোনো শক্তিশালী অবস্থান নেই। এমনকি বার্মিজ ও বৌদ্ধদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছেও জান্তা জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। তাই জান্তা নেতারা এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ, ক্ষমতা ও দেশের সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চিন্তিত।
২০২০ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার মূল কারণটি ছিল সংবিধানের সংশোধনী, যা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সামরিক কর্তৃত্ব হ্রাস করত। ফলে জান্তা তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হারাত। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে জান্তা সরকারের ওপর কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষণীয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত পরিবর্তনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আসিয়ান জোট মিয়ানমারের ক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে জান্তা সরকারের ব্যাপারে আসিয়ানের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর আসিয়ানের প্রথম শীর্ষ বৈঠকে জান্তা সরকার আমন্ত্রণ পেলেও আঞ্চলিক জোটটি ২০২২ সালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের শীর্ষ সভায় জান্তা সরকারকে আমন্ত্রণ জানায়নি। এটি জান্তা সরকারের ক্ষেত্রে আসিয়ানের নীতিগত পরিবর্তনের বড় দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। জান্তা সরকার ও আসিয়ানের মধ্যে গৃহীত ‘পাঁচ দফা ঐকমত্য’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জান্তা কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধন না করায় এবং সদিচ্ছা প্রকাশে অনীহার কারণে আঞ্চলিক জোটটি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করেছে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। পশ্চিমা অনেক দেশ এনইউজি’কে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং দেশটিতে গণতন্ত্রায়ণের জন্য এনএলডি জোটের বিকল্প সরকারকে উপযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করছে। এছাড়াও জান্তা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘গণহত্যা’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ায় জান্তা সরকার বিপাকে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা এবং নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যদের কানাডা সরকার কর্তৃক আশ্রয় প্রদানের ঘটনাও জান্তার ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু, মিয়ানমারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সংকোচন জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক সমস্যায় ফেলেছে। ইইউ-এর এ সিদ্ধান্তটি ঠিক তখনই এলো, যখন জান্তা সরকার ব্যাপক দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা দেখছি, আসিয়ান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ক্রমাগত যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সম্প্রতি জান্তা বাহিনী কর্তৃক সীমান্ত লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সীমানায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি উসকানিমূলক আচরণের প্রেক্ষাপটে আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলো মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে।
লক্ষণীয়, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো যেমন-জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও কম্বোডিয়াও তাদের মিয়ানমার নীতিতে পরিবর্তন আনছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তাদের তহবিলের প্রবাহ বাড়িয়েছে। আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি দেশ হিসাবে কম্বোডিয়া জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সদস্য দেশগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে। এছাড়াও গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, এনইউজি ও আরাকান আর্মির সঙ্গে চীনের যোগাযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জান্তা সরকার তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনেরও আস্থা হারাচ্ছে। সব মিলে জান্তা সরকার শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই তার রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে না; বহির্বিশ্বেও কূটনৈতিক চাপের মুখে পড়ছে।
এটি এখন স্পষ্ট যে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অভ্যুত্থান করেছিল, তা তারা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। চতুর্মুখী প্রতিরোধ ও চাপে জান্তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। তাদের সামনে ভয়ংকর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আগামী দিনে পরাজয়ের সংকেত বুঝতে পেরে জান্তা বেপরোয়া আচরণ করছে। সেদিন হয়তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন তারা পরাজয়বরণ করবে। তাই তারা একদিকে যেমন মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সামরিকভাবে নির্মূলের জন্য নতুনভাবে আক্রমণ করছে, অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে (বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড) অবন্ধুসুলভ ও উসকানিমূলক আচরণ করছে।
জান্তার এই বিপর্যস্ত সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থায় এবং সংকটময় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কীভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা যায়, তা নিয়েই এখন ভাবতে হবে। সামনের দিনগুলোয় জান্তা সরকার হয়তো আরও বেশি আক্রমণাত্মক হবে, যখন তারা সব দিক থেকে পরাজিত হতে থাকবে। তাই আসিয়ানসহ আঞ্চলিক দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সামরিক জান্তার ওপর চলমান কূটনৈতিক চাপ বজায় রাখা এবং নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জান্তা বাহিনীর বর্বরতা বন্ধ করা।
ড. দেলোয়ার হোসেন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন (প্রেষণে)