রাজনীতিতে অপকর্ম কখনোই সুফল বয়ে আনে না

মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই সরলপথে চলতে পারেনি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এর গতি পরিবর্তিত হয়েছে। কখনো দেশীয় বিশ্বাসঘাতকরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কখনো বিদেশিদের অদৃশ্য হস্তক্ষেপে এর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ বাংলাদেশের রাজনীতি যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সেটিও যে খুব সন্তোষজনক অবস্থানে আছে তা নয়। তবু বিগত দিনের চেয়ে যে অনেক স্থিতিশীল অবস্থায় আছে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
১৯৪৭-পরবর্তী বাংলায় রাজনীতিতে নতুন ধারা যুক্ত করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবন শেষ করে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে নতুনভাবে রাজনীতি শুরু করেন তিনি। এক সময় তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেকের মতো তিনিও বুঝতে পারেন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের মনেপ্রাণে ভালোবাসে না। বরং বাঙালিদের দমন-পীড়নই পাকিস্তানিদের মূল লক্ষ্য।
পাকিস্তানিদের দানবীয় শোষণ থেকে বাঙালিদের মুক্ত করতে নতুনভাবে, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেন তিনি। প্রথমে তিনি গড়ে তোলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে ‘আওয়ামী লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দল হিসাবে গড়ে তুলতে শেখ মুজিব নিরলস পরিশ্রম করেন। আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব থেকেও পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানি শোষণ-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার মানুষ। প্রথমে ভাষা আন্দোলন, এরপর ছয় দফা দাবিনামার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে আসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাহেন্দ্রক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করলে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পান গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালি জাতির মানসপটে একজন মানুষই নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকেন-তিনি বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রথম বিপথগামী হয়। দীর্ঘ ২১ বছর সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, জাসদ-বাসদের মতো দল-উপদল বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে থাকে। এই একুশ বছরে এদেশের রাজনীতি কখনোই সুস্থ ধারায় বিকশিত হয়নি। নানামুখী ষড়যন্ত্র, ক্যু, পালটা ক্যুর মধ্য দিয়ে পথ চলতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে বাংলাদেশবিরোধী চক্র। এরা গণতান্ত্রিক ধারাকে অবরুদ্ধ করে পাকিস্তানি মৌলবাদী ও সামরিক আমলাতান্ত্রিক ভাবধারায় বাংলাদেশ পরিচালনা করতে থাকে। এরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বাংলাদেশে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ করতে না পারলেও ১৯৭২ সালের সংবিধান কেটেছিঁড়ে ‘ইসলাম ধর্ম’কে ঠিকই রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হুমকির মুখে পড়ে।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যায়নি। এই ২১ বছর আওয়ামী লীগের ওপর যে জুলুম-অত্যাচার সংঘটিত হয়েছে, বিশ্বের কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের ওপর এত জুলুম-নির্যাতন হয়েছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ নেই। যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা উপহার দিয়ে জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, সেই মহান নেতার দুই কন্যা পর্যন্ত দীর্ঘদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেননি। সামরিক শাসক জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা আজ নানা দলিল-দস্তাবেজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ঘাতকের দলের সঙ্গে জিয়ার গোপন পরামর্শ, ঘাতকদের সাহস জোগানো থেকে শুরু করে তাদের পুরস্কৃত করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে জিয়া শুধু নিজেকেই কলঙ্কিত করেননি, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেও জলাঞ্জলি দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু নিজে যেমন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূর্ণ আস্থা রাখতেন, তার প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে রাজনীতি করতে বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগ একটি সংগ্রামী দল। গণমানুষের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করাই এ দলের মূল্য লক্ষ্য। জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। তিনি দেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ যেভাবে বাংলাদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল-তিনি দৃঢ় মনোবলে সে সবকিছু বাংলার মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রাদর্শ যেমন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল, শেখ হাসিনার স্বপ্নও তা-ই। সেই লক্ষ্যেই তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। পিছিয়ে পড়া বাংলার জনপদে আজ তিনি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আন্দোলনের স্লোগান তুলে দেশের চেহারা বদলে দিয়েছেন। দেশের মানুষ প্রথম দিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের মমার্থ বুঝতে দেরি করলেও আজ সবাই স্বীকার করছে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে।
শেখ হাসিনার সক্রিয় রাজনীতির বয়স কম-বেশি ৪০ বছর। এই ৪০ বছরে তিনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার মৃত্যুঝুঁকিতে পতিত হয়েছেন। এতবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা রাজনীতিক পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। এ বিষয়ে কেবল কিউবার বিপ্লবী রাজনীতিক ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গেই তার তুলনা চলে। রাজনীতিতে পা দিয়েই তিনি গৃহে অন্তরীণ, কারা নির্যাতন ভোগ, মিথ্যা মামলায় হয়রানিসহ নানারকম জুলুমের মুখোমুখি হন। তবু তার অপ্রতিরোধ্য গতি কেউ থামাতে পারেনি। বরং যারা তার গতিরোধ করতে চেয়েছে, তারাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে গেছে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন নীতি-আদর্শের স্খলন দেখা যাচ্ছে। দলীয় মতাদর্শের বাইরে গিয়ে সুবিধাবাদী নীতি-আদর্শহীন ব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করে ব্যক্তিগত ফায়দা লুটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীই আজ দলীয় মতাদর্শ ধারণ করেন না। আন্তঃদলীয় কোন্দল, মারামারি, খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ছেন সব দলের নেতাকর্মীরা। দলের মধ্যে মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নেই বলেই নেতাকর্মীরা আজ নীতিহীন হয়ে পড়ছেন। এটি রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত বলেই মনে হচ্ছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে তিনি সাধ্যের চেয়েও বেশি কিছু দিয়েছেন-উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালনার জন্য শেখ হাসিনা আজ সংবর্ধিত হওয়ার যোগ্য। আজ জনগণের সামনে সময় এসেছে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করা। শেখ হাসিনা শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ উন্নত হবে, সুখী হবে এদেশের সুখহীন, নিরন্ন মানুষ। আজ বিএনপির নেতারা নানারকম ফন্দি-ফিকির, আর অপপ্রচার করছেন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু জনগণ বিএনপির কথায় কান দিচ্ছে না। বিএনপি কোনো কর্মসূচিই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এদেশের উন্নয়নকামী সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অতীতে যেমন আস্থা রেখেছেন, আশা করি ভবিষ্যতেও সেই আস্থা অটুট থাকবে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে এটুকু বলা যায়-বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপরই নির্ভর করছে। দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে তিনিই আমাদের একমাত্র ভরসা। তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই বাংলাদেশকে নিরাপদ ও উন্নত করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক ও লেখক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ