Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে

গত মঙ্গলবারের দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি উক্তি মনে পড়ল। তার কথার অর্থ করলে দাঁড়ায়-তরতরিয়ে ওপরে ওঠার নাম কৃতিত্ব নয়; কোনো কারণে গর্তে পড়ে গেলে কত কম সময়ে উঠতে পারো, তার নাম কৃতিত্ব। বর্তমান সময়ে তরতরিয়ে উন্নয়নের কীর্তন শুনেছি অনেক; কিন্তু বিপর্যয় থেকে খুব সহজে মুক্ত হওয়ার উপায় আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে বড় ধরনের বিভ্রাট দেখা দেওয়ার কারণে গত মঙ্গলবার দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। এদিন জাতীয় গ্রিড ট্রিপ হওয়ায় দুপুর ২টা ১৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবেছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রায় সব জেলা। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের হাসপাতালগুলোয় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়; প্রায় অচল হয়ে পড়ে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা; শিল্প-কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে; আদালত চলেছে মোমবাতি জ্বালিয়ে; ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো ছিল অচল; পূজামণ্ডপে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হয়েছে; জেনারেটরের ডিজেল কিনতে পাম্পগুলোতে ছিল ভুক্তভোগী মানুষের উপচে পড়া ভিড়; অফিস, বাসাবাড়ি, মসজিদে বন্ধ ছিল পানি সরবরাহ।

সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হন রাজধানীর বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। পানি সরবরাহ ও লিফট না থাকায় ভবনগুলোতে বসবাসকারী নারী-শিশু-বয়স্ক মানুষগুলো পড়েন চরম দুর্ভোগে। দেশের ৩২ জেলায় পুরোমাত্রায় ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না; কোনো কোনো অঞ্চলে ভোগান্তির মাত্রা ছিল ৮ ঘণ্টারও বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নেওয়ার সময় বিপর্যয়ের সূত্রপাত ঘটে। তবে সেটি কেন হয়েছে, তা বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঘটনা অনুসন্ধানে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এ নিয়ে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে জাতীয় গ্রিডে দ্বিতীয়বারের মতো বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটল। এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপত্তি ঘটেছিল। সে সময়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা প্রায় দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছিল ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর। তখন গোটা দেশ প্রায় ১৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিল।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ভোগান্তির পাশাপাশি ছিল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি। এ বিষয়ে দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদন বলছে, সঞ্চালন লাইনে বিদ্যুতের বড় ধরনের বিপর্যয়ে দেশব্যাপী অনলাইনভিত্তিক প্রায় আড়াই হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অফলাইনে চলে যায়। একই কারণে এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন কাজ ব্যাহত হয় রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সব ধরনের শিল্পে। পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েন দেশের মার্কেট, বিপণিবিতানসহ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। বন্দরের কার্যক্রমসহ সব ধরনের সেবামূলক খাতে নেমে আসে বিপর্যয়। অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি আনুমানিক হিসাব তৈরি করা কঠিন কাজ নয়। ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসাবে একদিনে সেবা খাতের অবদান ৫ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, শিল্প খাতের (বড়, মাঝারি ও ছোট) ২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার অবদান ১ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতের অবদান ১১০ কোটি টাকা এবং একদিনে গ্যাসের অবদান ২২ কোটি টাকা। আমাদের দেশে সেবা ও শিল্প খাতের বড় অংশই আবর্তিত হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামকে ঘিরে। দুপুর ২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মোট ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। কয়েকটি খাত বিবেচনায় নিলে এতে মোট সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেবা খাতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা, শিল্প খাতে ৬০০ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ খাতে ২৭ কোটি এবং গ্যাস খাতে ৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিপণিবিতানগুলোর সম্ভাব্য ক্ষতি।

যে কোনো ব্যবস্থাতেই কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে। তবে যারা প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দায়িত্ব ও কর্তব্যপরায়ণ, তারা একই ত্রুটির পুনরাবৃত্তি হতে দেন না। আমরা কিন্তু এদিক দিয়ে অনেকখানি অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছি বা এখনো দিচ্ছি। এর কারণ হলো, সমস্যাকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে উদাসীনতা এবং চিহ্নিত সমস্যাকে আমলে না নেওয়া। দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন কার্যক্রম পরিচালিত হয় জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে। আমাদের জাতীয় গ্রিড দুটি ভাগে বিভক্ত। যমুনা নদীর পূর্বপাশে ঢাকাসহ সব জেলায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয় পূর্বাঞ্চল গ্রিডের মাধ্যমে। আর যমুনা নদীর পশ্চিমাঞ্চলে দক্ষিণ-পশ্চিমসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হয় পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডের মাধ্যমে। পশ্চিমাঞ্চল গ্রিডের চেয়ে তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পূর্বাঞ্চল গ্রিড। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছেন, যেন জাতীয় গ্রিডকে কমপক্ষে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। সেক্ষেত্রে গ্রিডের যে কোনো একটি ভাগে সমস্যা দেখা দিলে তা হবে আংশিক বিপর্যয়; সার্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা কমে যাবে।

আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার দিকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছি, সঞ্চালনের দিকে ততটা দেইনি। আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এ সক্ষমতার বিপরীতে চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি নয়। সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে চলতি ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল। সেদিন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। সে হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় সক্ষমতা ৪০ শতাংশেরও বেশি। যদি সঞ্চালন ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা থাকে, তাহলে অতিরিক্ত সক্ষমতা কোনো কাজে আসবে না। সমালোচকরা বলছেন, অতিরিক্ত সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে অতিরিক্ত অর্থযোগ জড়িত। এক পয়সার বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গুটিকয় মানুষ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে মোট বরাদ্দের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৮ শতাংশ আর সঞ্চালন খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২১ শতাংশ। বর্তমানে বিদ্যুৎ সঞ্চালন খাতে ১৭টি প্রকল্প চলমান আছে। এর মধ্যে আটটি প্রকল্পের কাজ গত অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ বছর শেষ হওয়ার কথা মাত্র একটি প্রকল্প। বাদবাকি আটটি প্রকল্প চলমান।

নির্দিষ্ট সময়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় অনেক খেসারত দিতে হচ্ছে। পদ্মা নদী পার করে আসা সঞ্চালন লাইন ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করা যায়নি বলে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রেখে গত দেড় বছর ধরে ক্ষতিপূরণ হিসাবে জরিমানা দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এ মাসেই উৎপাদনে যাওয়ার কথা; অথচ সঞ্চালন এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। আর মাত্র দুই মাস পরে, ডিসেম্বরে ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে; কিন্তু তার সঞ্চালন লাইনের কাজ এখনো শেষ করা যায়নি। দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প হলো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি আগামী বছর ১২০০ মেগাওয়াট ও ২০২৪ সালে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জোগান দেওয়ার কথা। কিন্তু সেখান থেকে বিদ্যুৎ আনার ব্যাপারে সঞ্চালন লাইন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন সরকারের অগ্রাধিকার ছিল। সঞ্চালন টাওয়ার বসানোর জন্য অনেক মানুষের জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। এটি নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা আছে। এখন গুরুত্ব পাচ্ছে সঞ্চালন লাইন। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। তবে আমরা আশ্বস্ত হতে দ্বিধাবোধ করছি। সরকারের লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় আছে। বর্তমানে আমাদের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ৮৮৯ কিলোমিটার। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এ দৈর্ঘ্য ২৮ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা। অর্থাৎ আগামী ৭ বছর শেষে আরও ১৪ হাজার ১১১ কিলোমিটার সঞ্চালন পথ যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে; কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, গত ১২ বছরে আমরা সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারিত করতে পেরেছি মাত্র ৫ হাজার ৮৮৯ কিলোমিটার। সংশয়ের কারণটা এখানেই।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনবান্ধব নয়। ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে অপ্রয়োজনীয় তর্কে লিপ্ত হই; অহেতুক নিন্দা-তর্কে সময় নষ্ট করি। দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও সামাজিক সমস্যাকে আমলে নিতে চাই না। এ পথ পরিহার করে প্রকৃত সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হতে হবে। প্রকৃত সত্য হলো, আমাদের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা যথাযথ নয়। এর অবকাঠামো অনেক পুরোনো। এ কারণে যে পরিমাণ চাহিদার বিপরীতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা প্রয়োজন, তা সঞ্চালনে এ অবকাঠামো অপারগ। বিশেষজ্ঞরা গত এক দশক ধরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের দাবি করে আসছেন। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেননি নীতিনির্ধারকরা আর এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আলোচিত সমস্যার মূল কারণ হলো স্বয়ংক্রিয় গ্রিড না থাকা; যে কারণে বিপর্যয়ের উৎস খুঁজে পেতে অনেক বিলম্ব হয়েছে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে সচেষ্ট হবে। নইলে ভবিষ্যতে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম