Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি

প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে বাজার ঠিক রাখা যায় না

Icon

ড. আর এম দেবনাথ

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে বাজার ঠিক রাখা যায় না

গত ১৭ সেপ্টেম্বরের একটি কাগজের খবর-নয়টি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেঁধে দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আবার ১৮ সেপ্টেম্বর দেখলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকেও সাধুবাদ জানাচ্ছি। মাননীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দুটো বিপরীতধর্মী সিদ্ধান্তকেই আমি কী করে একযোগে সাধুবাদ জানাচ্ছি। ন্যায্য কথা। এটা সাধারণত হয় না। সরকার দেখা গেল চাল, আটা, ভোজ্যতেল, মসুর ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, ডিম, এমএস রড ও সিমেন্টের দাম বেঁধে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নয়টি দ্রব্যের মধ্যে সাতটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং বাকি দুটি খুবই প্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে নির্মাণ শিল্পের জন্য। যে সাতটি ভোগ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে বলে বলা হয়েছে, তা করাই উচিত। কারণ দেখা যাচ্ছে এসব বাজার কেবলই ঊর্ধ্বমুখী।

যৌক্তিক কারণ থাকুক আর না-ই থাকুক, এগুলোর দাম বাড়ছেই। যেমন চালের দাম। সামনে অগ্রহায়ণী বা আমন ফসল। সরকারের গুদামে ২০ লাখ টনের মতো খাদ্যশস্য মজুত আছে। চাল ও গম আমদানি হচ্ছে। সরকার আমদানির যাবতীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমদানি শুল্কসহ অনেক কর কমানো হয়েছে। তারপরও চালের দাম কেন বাড়বে? এর কোনো সদুত্তর নেই। এ অবস্থায় যে কোনো দায়িত্বশীল সরকার চালের দাম বেঁধে দিতে পারে। এটা অবশ্যই ‘ফরজ’ কাজ। অতএব, চালের দাম বেঁধে দেওয়া হবে-এ সিদ্ধান্ত সঠিক। তাই আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।

আবার অন্যদিকে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্যও ধন্যবাদ জানিয়েছি। এর কারণ কী? কারণ খুবই সোজা। চালের দাম বেঁধে দিলেই হবে না, এ বেঁধে দেওয়া দাম যাতে বাজারে বাস্তবায়িত হয় তার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। আমি চোখ বুজে বলতে পারি, এটা সম্ভব নয়। কীভাবে নিশ্চিত হলাম? নিশ্চিত হয়েছি কারণ, অতীতের অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে। ভোজ্যতেল, সয়াবিন তেলের দাম সরকার এ পর্যন্ত কতবার বেঁধে দিয়েছে তার হিসাব নেই। সরকার নির্ধারিত দামে কি তা বিক্রি হয়েছে? না, হয়নি। সরকার তার নির্ধারিত দাম বাজারে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বরং উলটো ফল হয়েছে। সয়াবিন তেল গেছে ‘মাটির তলায়’। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা তা লুকিয়ে ফেলেছেন অতিরিক্ত মুনাফার আশায়। তা-ই তো হবে।

বাজারে যদি অভাব থাকে, পণ্যের টানাটানি থাকে, তাহলে তা মজুতদারিতে ঢুকবেই। এই যদি অবস্থা হয়, সরকার যদি নির্ধারিত দাম ব্যবসায়ীদের দিয়ে নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে বাজারে অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে লাভ কী? সরকার যে নির্ধারিত দাম বাস্তবায়নে ব্যর্থ, এর অন্যতম উদাহরণ সিএনজি অটোরিকশা। এগুলো মিটারে তথা সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না। এ কারণেই, অর্থাৎ ব্যর্থতার কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যই বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। তিনি ব্যবসায়ী লোক, বড় শিল্পপতি। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বন্ধু। অথচ দেখা যাচ্ছে তার কথা কোনো ব্যবসায়ী শোনে না। এটা আমার কথা নয়, তিনিই অতীতে এ কথা স্বীকার করেছেন। সজ্জন ব্যক্তিই তা পারে। কাকে বলব? মন্ত্রীকে বলা যায়, যেহেতু তিনি বড় শিল্পপতি।

বাজারে পণ্যের দাম ঠিক রাখার একমাত্র পথ হচ্ছে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা। পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে কাউকে অনুরোধ করার দরকার হয় না। প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্বারা বাজার ঠিক রাখা যায় না। হাজার হাজার খুচরা ব্যবসায়ী, শত শত পাইকারি ব্যবসায়ী, সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে যত আমদানিকারক/বিগ বিজনেস-কেউ কথা শুনবে না। শোনানোর মতো ব্যবস্থা সরকারের নেই। ‘দশ টাকা-বিশ টাকা’ জরিমানায়, পনেরো দিনের জেলে এসব হয় না-এটা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। এ কারণেই সরকারকে বলব বাজারব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য। অর্থাৎ বাজারকে প্রভাবিত করা যায় এমন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

স্বাধীনতার পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির জন্য সরকার একটি সংস্থা তৈরি করেছিল। এর নাম ‘কনজিউমারস সাপ্লাই করপোরেশন’ (কসকর)। ভালো কাজ ছিল এটি। কসকরের পণ্য আমিও কিনেছি। ‘কসকর’ ছাড়াও ছিল ‘রেশন শপ’, যার মাধ্যমে চাল, গম, চিনি, ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হতো। প্রায় সবারই ছিল ‘রেশন কার্ড’। বাজার অর্থনীতির ধাক্কায় এসব গেছে। ‘রেশন’ ব্যবস্থা নেই। ‘কসকর’ও নেই। আছে একটা সংস্থা-‘ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ’ (টিসিবি)। দেখা যাচ্ছে, পণ্য আমদানিও করে টিসিবি, খোলাবাজারে বিক্রিও করে। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির মধ্যেই এসব করতে হচ্ছে। নিতান্ত প্রয়োজনেই। ব্যাংকিং ব্যবসাতেও তাই।

কত ‘সোহাগ’ করে ব্যাংকিং ব্যবসায় বাজার অর্থনীতি চালু করা হয়েছিল। আজ কী অবস্থা? আমানতের কর, ঋণের কর, বৈদেশিক মুদ্রার কর এখন আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দেয়। ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি এরই ফল। তাই নয় কি? শুধু ব্যাংকিং নয়, ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাই। বলা হলো, সরকার কোনো ব্যবসা করবে না, তার ব্যবসা করা উচিত নয়। ব্যবসা করবে ব্যবসায়ীরা লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে। সরকার অবকাঠামো গড়ে দেবে। কত সুন্দর কথা। কিন্তু বাস্তবে কী? বাস্তবে লাভ ব্যবসায়ীর, লোকসান সরকারের। ব্যবসার যত লোকসান, সব পুষিয়ে দিচ্ছে সরকার। ‘উন্নয়নে’র যুক্তি। উন্নয়নের জন্য ব্যবসা দরকার। কাজেই সুদ মাফ, সুদ ভর্তুকি, কর মাফ, কর অব্যাহতি, শুল্ক হ্রাস, শ্রেণিবিন্যাসকরণে শিথিলতা, ঋণখেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বর্ধিতকরণ-আরও কত কী!

যদি এসব করেই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে সরকারি ব্যবসা কী দোষ করেছিল? সরকারি ব্যবসায় লোকসান হয়, তাহলে বেসরকারি ব্যবসায় যে এত সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়, সেটা কী? এটা কি রাজস্ব ক্ষতি নয়? না, এসব যুক্তি দিয়ে লাভ নেই। বাজার অর্থনীতিই নিয়তি! ঠিক আছে, এখন যে বাজার অর্থনীতি কাজ করে না-তাহলে করণীয় কী? চাল থাকতে চালের মূল্যবৃদ্ধি। এ অবস্থায় ‘কসকরে’র মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা আবার ফিরে এসেছে। ‘টিসিবি’ আমদানি ব্যবসা করুক। ‘কসকর’ করুক বণ্টন ব্যবসা। আবার দেখা যাচ্ছে, সরকার নতুন করে কার্ড দিয়ে গরিবদের মধ্যে ভোগ্যপণ্য বিতরণের ব্যবস্থা করছে। করাই উচিত। যদি তা-ই হয়, তাহলে স্থায়ী রেশনব্যবস্থার মতো কোনো ব্যবস্থা তৈরি করতে বাধা কোথায়?

আমার মনে হয়, সব মন্ত্রণালয় মিলে একটা সমন্বিত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। শোনা যায়, সামাজিক সুরক্ষার কাজ নাকি শতাধিক সংস্থা/প্রতিষ্ঠান করে। এতে কত যে ‘ডুপ্লিকেশন’ হচ্ছে, অপচয়-চুরি-দুর্নীতি হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। এসব এক জায়গায় আনতে অসুবিধা কোথায়? নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। কেউ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছাড়তে চায় না-এটাই কি বাধা? খুব সম্ভবত তা-ই। ‘পাওয়ার’ বড় সাংঘাতিক জিনিস। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি ছাড়িব পাওয়ার’। উদাহরণ দিই।

গল্পটি কার কাছে শুনেছিলাম-আজ আর মনে নেই। তবে এটির সারকথা আজও সমভাবে প্রযোজ্য। গল্পটি ঝড়-বৃষ্টিতে রাস্তায় গাছ পড়ে যাওয়ার। একবার প্রবল বৃষ্টি ও ঝড়ে গাছ ভেঙে রাস্তায় পড়ে যায়। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের (জেলা পরিষদ) রাস্তা। রাস্তা যায় বন্ধ হয়ে। যানবাহন চলাচল বন্ধ। জনগণের দুর্ভোগ। কীভাবে দুর্ভোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করা যায়? পথ একটাই-গাছ কেটে রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কে করবে এ কাজ? এর ওপর শুরু হয় ‘বাহাস’। বিভিন্ন বিভাগের কথা হচ্ছে, যেহেতু এটা গাছ অতএব সরানোর দায়িত্ব বনবিভাগের। বনবিভাগ বলছে-না, এটা আমাদের কাজ নয়; যেহেতু এ গাছ পড়েছে রাস্তার ওপর, অতএব সেটা সরানোর দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ বিভাগের। আবার যেহেতু গাছটি পড়েছে একটি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন রাস্তায়, অতএব গাছ সরানোর কাজ করবে ইউনিয়ন পরিষদ। এই বাহাসের যেন শেষ নেই। অবশেষে ভুক্তভোগী মানুষ গাছটি কেটে রাস্তা থেকে সরায়। এবং গাছের কাঠ, ডাল ইত্যাদি ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। এবার যায় কোথায়? মামলা, পুলিশ। কারণ মানুষ অবৈধভাবে সরকারের সম্পত্তি লুট করে নিয়ে গেছে!

এই হচ্ছে পরিস্থিতি। সমস্যার সমাধানও হবে না, কাউকে এর সমাধানও করতে দেওয়া হবে না। মনে হয়, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীর অবস্থাও তা-ই হয়েছে। কাগজেই দেখলাম খবরটি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে আছে চাল, গম, তেল, পেঁয়াজ, চিনি ইত্যাদি। এর সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় জড়িত, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জড়িত। জড়িত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়। অতএব, পণ্যের দাম নির্ধারণে সবার ঐকমত্য দরকার, দরকার সমন্বয়ের।

এখানেই গণ্ডগোল। কে করবে সমন্বয়, কে ডাকবে সভা, কে সভাপতিত্ব করবে এতে। কবে হবে সভা। সময় হবে তো? এসব করতে সময় যাবে গড়িয়ে। সমস্যা বাড়তে থাকবে সমস্যার জায়গায়। মন্ত্রিত্ব ঠিক থাকবে। মন্ত্রীরা বক্তৃতা দেবেন, অঙ্গীকার করবেন, আশ্বাস দেবেন। সচিবরা বলবেন আইনের কথা, নীতি-পদ্ধতির কথা। মন্ত্রীকে বোঝাবেন, এটা করা সম্ভব নয় বিধির অধীনে। মন্ত্রী থমকে দাঁড়াবেন। বিধি, নিয়ম পড়ার সময় তার কোথায়? তিনি জনপ্রতিনিধি। জনগণকে নিয়ে তিনি ব্যস্ত।

আবার রয়েছে অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য। তাতে সময় দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। থানা-পুলিশ ঠিক রাখতে হবে। এলাকার যুবকদের দেখাশোনা করতে হবে। তাদের ন্যায্য-অন্যায্য দাবি মানতে হবে-নইলে গদি ছাড়তে হবে। আছে উপদলীয় কোন্দল। কোনদিকে যাবেন বেচারা মন্ত্রী মহোদয়। যাওয়ার কায়দা নেই। সবদিকেই বাধা-কণ্টক। এর ফলে মানুষ ভোগে, ভুগছে। উদাহরণস্বরূপ, কুড়িগ্রামের মানুষের দারিদ্র্য যাচ্ছে না। তারা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই আছে।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম