চা আমাদের সতেজ করে, শ্রমিককে সতেজ করছি না কেন?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
এক কাপ চা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কোনো বিষয়ে আমরা যদি একাগ্রচিত্তে কাজ করতে থাকি, তখন একপর্যায়ে দেখা যায়, আমাদের স্নায়ু বিদ্রোহ করে ওঠে, আমরা অবসন্ন বোধ করি এবং কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। ঠিক এমনই অবস্থায় এক কাপ চা আমাদের সতেজ করে তোলে, প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রফুলতা ফিরে আসে। আমরা ফের কাজে মনোযোগ দিই। আধুনিক সভ্যতার বিচারে আমরা যখন সভ্য থেকে সভ্যতর হয়ে উঠি, তখন আমাদের জীবনযাত্রায় চায়ের অপরিহার্যতা অনুভব করি। দেহ ও মনকে চাঙা করে তোলা পানীয় হিসাবে চা আমাদের কর্মক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়।
চাইলে যে কোনো মানুষ সারা জীবনে এক কাপ চা পান না করেও থাকতে পারে। সেই বিচারে পানীয় হিসাবে চা আবশ্যিক কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। কিন্তু চায়ে অভ্যস্ত হলে চাবিহীন জীবন চলতে চায় না। খাদ্য-বস্ত্র মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, এছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু নিত্যব্যবহার্যের ফর্দে চা না থাকলেও জীবন থেমে থাকে না। তবে চায়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে চাবিহীন অবস্থায় আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বিদ্রোহ করে ওঠে। আমরা কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। এমনই অবস্থায় চা হয়ে উঠে আমাদের দৈনন্দিন বাজেটে অপরিহার্য দ্রব্য। সে কারণে অর্থনীতিবিদরা চায়ের মতো পানীয়কে চিহ্নিত করেছেন Conventional necessity হিসাবে। চা পানে অভ্যস্তদের চায়ের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি যে, চাকে খাদ্য পানীয়ের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায় না।
ছোটবেলায় দূরে কোথাও যেতে হলে রেল যোগাযোগ থাকলে আমরা রেলেই চড়তাম। তখন বর্তমান সময়ের মতো সড়ক যোগাযোগ উন্নত ও ব্যাপক ছিল না। রেল স্টেশনগুলোয় চায়ের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য থাকত স্টিল প্লেটের বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপনগুলো শতবর্ষ পুরোনো ছিল। বিজ্ঞাপনগুলো প্রথমবারের মতো যখন টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন মানুষ চা কী জিনিস, তা জানত না। এ বিজ্ঞাপনগুলোয় ধূমায়িত চায়ের কাপের পাশে লেখা থাকত, ‘চা পান করুন, সতেজবোধ করুন।’
বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে চায়ের প্রচলন খুব একটা ছিল না। ইংরেজ বণিকরা চীন থেকে প্রক্রিয়াজাত চা এবং চায়ের চারাগাছ তাদের ভারতীয় উপনিবেশে আমদানি করে। ইংরেজ বণিকরা চা-বাগান করার জন্য চা চাষের উপযোগী এলাকাগুলো নির্ধারণ করে। চা চাষের জন্য বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টির পানি সহজে গড়িয়ে যায় এমন ধরনের জমি প্রয়োজন। এভাবেই বাংলাদেশের সিলেট, ভারতের আসাম, দার্জিলিং ও বিহার অঞ্চল চা-বাগান করার জন্য উপযোগী হিসাবে বিবেচিত হয়।
প্রায় একই সময়ে শ্রীলংকায়ও চা-বাগান গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে সিলেটের বাইরে চট্টগ্রাম ও দিনাজপুর অঞ্চলে চা-বাগান গড়ে উঠেছে। এই বাগানগুলো পাকিস্তান আমলে ও তৎপরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৩৭ সালে প্রথমবারের মতো চা বাগান তৈরি করা হয় আপার আসামের চাবুয়া নামক স্থানে। ১৮৪০ সালে আসাম টি কোম্পানি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চায়ের উৎপাদন শুরু করে। আগেই বলা হয়েছে, চা বাগান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল ঔপনিবেশিক কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশে এখনো জেমস ফিনলে নামক বিদেশি কোম্পানি চা-বাগান ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
চা-বাগানগুলো প্রথমবারের মতো যখন গড়ে ওঠে, তখন চা-বাগানে কাজ করার জন্য শ্রমিক নিয়ে আসা হয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে। এসব শ্রমিক প্রধানত ছিল বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী থেকে আগত। এদের ভাষা উপমহাদেশের প্রধান ভাষাগুলোর মতো নয়। এদের গাত্রবর্ণ এবং শারীরিক গঠন লক্ষ করলে বোঝা যায় এরা উপমহাদেশের প্রধান নৃ-গোষ্ঠী নয়। এরা ছিল খুবই গরিব। বিদেশি চা কোম্পানিগুলো এদেরকে নানা কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে চা-বাগান এলাকাগুলোয় নিয়ে আসে। এদেরকে আনা হয় ওড়িশা, বিহারের কিছু এলাকা এবং ঝাড়খণ্ড থেকে।
তাদের যেসব শর্তে চা-বাগানের কাজে নিয়োজিত করা হয়, এর মধ্যে ছিল নির্দিষ্ট আর্থিক মজুরি, বাস করার জন্য ক্ষুদ্র এক টুকরো জমি এবং কখনই জন্ম স্থানে ফিরে না যাওয়া। চা কোম্পানিগুলো নিজ নিজ বাগানের শ্রমিক হিসাবে স্থানীয়দের নিয়োগ দিতে পারত। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটেনি। তারা বহিরাগত শ্রমিকই পছন্দ করেছে। স্থানীয় শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হলে তারা সহজে মালিকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে পারত।
চা-বাগান নিজেদের এলাকায় থাকার ফলে তাদের সামাজিক যোগাযোগ এবং আত্মীয়তা শক্তি হিসাবে কাজ করত। বাগান মালিকরা এমন কোনো শ্রমিককে নিয়োগ দিতে চাইল না, যে বা যারা গোলযোগ করতে পারে। দূরবর্তী অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা চা-শ্রমিকরা মালিকদের অনুগত থাকবে, কারণ বাগান এলাকার অন্য মানুষগুলোর সঙ্গে তাদের সামাজিক যোগাযোগ নেই। এই শ্রমিকরা নিয়োজিত হলো এমন শর্তে যে তারা বংশপরম্পরায় বাগানের শ্রমিক হিসাবেই থাকবে।
চা-বাগান শ্রমিকরা খুব সামান্যই আর্থিক মুজরি পায়। এবার চা-বাগান শ্রমিকদের মুজরি বাড়ানোর আন্দোলন থেকে বোঝা গেল তারা কত অবহেলিত ও বঞ্চিত। আমরা জানতে পারলাম তাদের দৈনিক মজুরি মাত্র ১২০ টাকা। বাংলাদেশের অন্যান্য আর্থিক খাতে মজুরি চা-শ্রমিকদের আর্থিক মজুরির অন্তত তিনগুণ। চা-শ্রমিকরা কী করে এত কম মজুরিতে কাজ করে বেঁচে থাকছে?
কারণ এ মজুরিতে কোনো শ্রমিকের পক্ষে নিজেকে পুনরুৎপাদিত করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল সন্তান এবং শ্রমিকের স্ত্রী প্রাপ্ত মজুরিতে তাদের ভরণপোষণ চালাতে পারে এবং ওই নির্দিষ্ট শ্রমিক যখন শ্রম দিতে অক্ষম হয়ে পড়বে বা মারা যাবে, তখন ওই শ্রমিকের পোষ্যরা নতুন শ্রমিক হিসাবে কাজ করবে। এটাই পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের চা-শ্রমিকরা এখন ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি হিসাবে পাচ্ছে। মালিকদের বক্তব্য হলো, তারা শ্রমিকদের আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়। যে কারণে আর্থিক মজুরি ১২০ টাকা হলেও চা-শ্রমিকদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। চা-বাগানের শ্রমিকরা বাড়তি সুবিধা হিসাবে থাকার জন্য বাগান এলাকায় খুবই ছোট একটি কুটির পায়। এছাড়া ওই কুটিরের আশপাশের সামান্য এক টুকরো জমিও ব্যবহার করতে পারে। এই জমি চা-শ্রমিকদের ব্যবহারের সুযোগ আছে। তবে মালিকানার সুযোগ নেই। এ ক্ষুদ্র প্লটে বাগান শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যরা নানা ধরনের শাকসবজির আবাদ করে এবং উৎপাদিত শাকসবজি তাদের ভোগের প্রয়োজন মেটায়।
এই সুবিধাকে আমরা যদি মজুরির অংশ হিসাবে গণ্য করি, তাহলে দেখা যাবে এ অংশটি বাগান শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদের শ্রমে তৈরি হয়। এভাবে চা-বাগান শ্রমিকদের নিজেদের শ্রম দিয়ে মজুরির একটা অংশ পয়দা করতে হয়। এর তাৎপর্য হলো, শুধু বাগান শ্রমিক হিসাবেই নয়, তার ভরণপোষণের একটি অংশ নিজস্ব শ্রম দিয়ে পয়দা করতে হয়। এটা ঘোর শোষণ। এত তীব্র শোষণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্য কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এ ধরনের শোষণকে হেনরি বার্নস্টাইন চিহ্নিত করেছেন Simple reproduction squeeye হিসাবে।
চা-শ্রমিকরা ৩০০ টাকা ক্যাশ মজুরি দাবি করেছেন। এতদিন তারা পেতেন ১২০ টাকা। মালিকপক্ষ তাদের ২০ টাকা মজুরি বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী এর সঙ্গে পাঁচ টাকা যোগ করেছেন। অর্থাৎ ক্যাশ মজুরি ১৪৫ টাকা ধার্য করার প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয়েছে। চা-শ্রমিকদের একটি অংশ এটা মেনে নিলেও বড় একটি অংশ এটা মানেনি।
বর্তমান মূল্যস্ফীতির বাজারে ৩০০ টাকা মজুরি এমন আহামরি কিছু নয়। চা-শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করলেও দরকষাকষিতে এর চেয়ে কিছু কম মজুরিতে সমঝোতায় আসতে পারে। যে চা পান করে আমরা সতেজ হই, সেই চা উৎপাদনকারী শ্রমিকরা যাতে সতেজ থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা বাগান মালিকদের নৈতিক ও ব্যবসায়িক দায়িত্ব। শ্রমিকরা পরিতৃপ্ত থাকলে উৎপাদনও ভালো হবে, এটা মালিকপক্ষকে বুঝতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ্ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ