Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চা শ্রমিকরা আর কতকাল বঞ্চিত হবে?

Icon

সঞ্জয় কান্ত দাস

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চা শ্রমিকরা আর কতকাল বঞ্চিত হবে?

চা শ্রমিকরা যখন ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন, ঠিক তখন মালিকরা বলছেন, তারা নাকি চা শ্রমিকদের ৪০৩ টাকা মজুরি দেন! তাদের এ তথ্য দিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনে একটি প্রতিবেদন পরিবেশিত হয়েছে, যা স্পষ্টতই মিথ্যাচার ও আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার কৌশল। এ মিথ্যাচারের জবাব দেওয়া জরুরি মনে করছি।

১. মালিকরা বলছেন, তারা দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬.৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭.৫০ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ০.০২ টাকা এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা শ্রমিকদের দেন, যা দাঁড়ায় ৯৮.৪৪ টাকায়। বাস্তবে এটা ধোঁকাবাজি। শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে-বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অবসর ভাতা বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক দেওয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। ফলে মালিকরা উপরোক্ত খাতগুলোতে যে টাকা মজুরি বাবদ প্রদান করছেন বলে দেখাচ্ছেন, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আবার শ্রম আইনে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, চা শ্রমিকদের গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করবে মালিকরা (৯৬নং ধারা)।

এখানে মনে রাখতে হবে, চা শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয় যে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কাজ করানো যায়। বিশেষ ধরনের শিল্প হওয়ায় চা শিল্পের শ্রমিকদের বাগানেই থাকতে হয়। আর এ বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা শ্রমিকরা। মালিক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু শ্রমিকরা সেখানেই আছেন। ফলে চা শ্রমিকদের গৃহে উৎপাদিত কাঁঠাল বা পেয়ারাজাতীয় ফলের মূল্য মজুরিতে দেখানো হাস্যকর যুক্তি ছাড়া আর কী হতে পারে?

২. মালিকরা দেখাচ্ছেন, প্যাকিং বোনাস/মাঠ/কারখানায় অধিক কাজের জন্য তারা দৈনিক ৬৫ টাকা দেন। এটি বাস্তবে সাধারণ দৈনিক মজুরি নয়। এটি শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের টাকা। শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় অধিক কাজে সাধারণ হারের দ্বিগুণ মজুরি প্রদানের কথা আছে। ফলে এগুলোকে দৈনিক মজুরিতে দেখানো মানে শ্রমিক ঠকানো।

৩. মালিকরা বলছেন, একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ১০.৬১৫ কেজি চাল/আটা দেওয়া হয়, যার মূল্য ধরা হচ্ছে ৩০.৭৯ টাকা। কিন্তু সত্য হলো, একজন পুরুষ শ্রমিককে ৩.২৭০ কেজি রেশন দেওয়া হয়, তার পোষ্য নারী শ্রমিককে দেওয়া হয় ২.৪৪ কেজি, শিশুকে ১.২২ কেজি (যদি শিশু থাকে)। এসব মিলে হয় ৬.৯৩ কেজি। নারীরা পোষ্যের জন্য রেশন পান না। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। অন্য সেক্টরে যে রেশন দেওয়া হয়, সেটাকে মজুরি হিসাবে দেখানো হয় না। যেমন-পুলিশ সদস্যরা রেশন পান, এটি মজুরি বা বেতন হিসাবে গণ্য হয় না।

৪. বছরে দুটি উৎসব ভাতা এবং কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা দেওয়া হয়। মালিকরা এ ভাতাকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে (৪.৬০+১৫.৪৫ টাকা) ২০.০৫ টাকা হারে যুক্ত করে দেখাচ্ছেন, যা বাস্তবে অন্যায়। কারণ শ্রম আইনের আওতায় প্রণীত শ্রম বিধিমালায় বলা আছে, প্রতিটি উৎসব ভাতা মাসিক মজুরির অধিক হবে না, এবং তা অতিরিক্ত মজুরি হিসাবে বিবেচিত হবে না। তাহলে মালিকরা এ টাকাকে কেন মজুরিতে যুক্ত করে দেখাচ্ছেন?

আর যদি ধরে নিই, চা শ্রমিকরা দৈনিক ৪০৩ টাকা মজুরি পান, তাহলে আইন অনুযায়ী উৎসব বোনাস হবে [৩০x৪০৩=১২০৯০)x২] ২৪ হাজার ১৮০ টাকা। এটা কি মালিকরা দেন?

৫. মালিকরা বলছেন, চা শ্রমিকদের প্রতিবছর অর্জিত ছুটি (১৪ দিন) বাবদ দৈনিক ৪.৬০ টাকা দেওয়া হয়। এটিও প্রতারণামূলক কথা। শ্রম আইন অনুযায়ী, চা শ্রমিকরা প্রতি ২২ দিনে একদিন করে সবেতন ছুটি পান [১১৭-এর ১(খ) ধারা]। এ দিনগুলোর মজুরি শ্রমিকের আইনত অধিকার। এমনকি যদি শ্রমিক ছুটি ভোগ না-ও করেন, এর বিপরীতে এ দিনগুলোর মজুরি তিনি দাবি করতে পারেন। এ টাকাগুলোকে দৈনিক মজুরির সঙ্গে যুক্ত করে দেখানো প্রতারণার শামিল।

এভাবে মালিকদের উত্থাপিত প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করে এসব অপপ্রচারের জবাব দেওয়া যায়। তবে এটুকুতেই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করি। তাই আসুন চা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি একাত্ম হই। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে রাজপথই দাবি আদায়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ। এ সময়ে সমাজের সর্বস্তরের সচেতন ও বিবেকবান মানুষের চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।

সঞ্জয় কান্ত দাস : সংগঠক, চা বাগান শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম