অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ
মো. আতিকুর রহমান
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ রেলওয়ে হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রপরিচালিত সংস্থা। ১৯৯০ সাল থেকে সংস্থাটি রেল মন্ত্রণালয়ের অধীন নিজ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে ২৫ হাজার ৮৩ জন নিয়মিত কর্মচারীসহ আড়াই হাজারের অধিক কিমি. রুট নিয়ে দেশে রেল চলাচল করছে। মূলত এ রেলই দেশের পরিবহণব্যবস্থার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কেননা অধিকাংশ যাত্রীর কাছে রেল যাতায়াত অনেকটা নিরাপদ ও আরামদায়ক। তাই অধিকাংশ যাত্রী যাতায়াতের মাধ্যম হিসাবে রেলকেই অধিক পছন্দ করেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রেল কর্তৃপক্ষ রেলের সেবার মান ও যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে? যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে শত শত অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, একের পর এক রেল দুর্ঘটনা, রেলে দুর্নীতি, টিকিট কালোবাজারি ও নানাবিধ অনিয়মের কারণে স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের মনে রেল নিয়ে বর্তমানে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে রেলের সার্বিক অগ্রগতি যেমন ব্যাহত হচ্ছে, ঠিক তেমনই রেলের প্রতি যাত্রীদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে, যা কাম্য নয়। এ অবস্থার দ্রুত আশু সমাধান হওয়া জরুরি।
প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেশে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে যেসব তথ্য সামনে আসে, তা অত্যন্ত ভীতিকর। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সারা দেশে বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪১২টি। এর মধ্যে ৯৪৬টিতে, অর্থাৎ ৬৭ শতাংশে কোনো গেট নেই! এমনকি নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও। নেই সংকেত বাতি। এছাড়া রেললাইনের ওপর দিয়ে স্থানীয় লোকজন অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার, রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজে সমন্বয়হীনতার কারণে হিসাবের বাইরেও আরও বিপুলসংখ্যক মরণফাঁদ তৈরি হয়েছে, যা রেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও পুরো পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহতার দিকে ঠেলে ছিয়েছে। এমন এক বাস্তবতায় রেলের সার্বিক সেবার মান বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করি।
তথ্যমতে, ২০০৪-২০০৫ সালের শেষে বাংলাদেশে ১ হাজার ৬১০টি লেভেল ক্রসিং ছিল। ২০২০ সালের হিসাবে দেশে মোট লেভেল ক্রসিং ২ হাজার ৮৫৬টি, যার মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অনুমোদনহীন। ক্রসিংগুলোর (বৈধ-অবৈধ) প্রায় ৮৪ শতাংশ অরক্ষিত। পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৮১১টি অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। বাংলাদেশ রেলওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ধারণা করা হয়, দেশে সংঘটিত রেল দুর্ঘটনার ৭২ শতাংশ মানব ত্রুটিজনিত, ২৩ শতাংশ যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত এবং বাকি পাঁচ শতাংশ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং এবং যানবাহন চালক ও পথচারীদের অসতর্কতার সঙ্গে লেভেল ক্রসিং পারাপারের কারণে ঘটে। মানব ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকোমাস্টার, স্টেশনমাস্টার ও পরিচালকের ত্রুটি বা অবহেলা এবং বেপরোয়াভাবে ট্রেন চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটে লোকোমোটিভের ত্রুটি, ত্রুটিযুক্ত ট্র্যাক ও সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে। ২০০৮-২০১৯ সালে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৩১০টি দুর্ঘটনায় ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন মারা গেছে। যদিও ১৯৭২ সালে এক রেল দুর্ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৭২ সালের ৪ জুন যশোর জেলায় স্টেশনে দাঁড়ানো একটি মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে খুলনা থেকে আসা একটি জনাকীর্ণ যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষ ঘটে। এতে ৭৬ জন নিহত ও ৫০০ জন আহত হয়েছিল। এর সাড়ে ছয় বছর পর, ১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গায় একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে উলটে যায়; এতে ৭০ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হন। এরপর ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজীপুর জেলায় একটি মেইল ট্রেনের সঙ্গে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষ্যে উভয় ট্রেনে ২ হাজারের অধিক যাত্রী ছিল, যাদের অনেকেই ছাদে বা কোচের মধ্যবর্তী স্থানে ভ্রমণ করছিল। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ১৭০ জন নিহত ও ৪০০ জন আহত হন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ৪২ জন এবং গত ১০ বছরে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেবল যে অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়েই দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটছে তা নয়, বৈধ ক্রসিংগুলোতেও হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। এমন এক বাস্তবতায় ত্রুটিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলো যত দ্রুত সম্ভব সুরক্ষিত করতে হবে। বছরের পর বছর এগুলো অরক্ষিত থাকলেও দেখা গেছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ পরস্পরের ওপর দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে, যা কাম্য নয়।
এত বলার পরও দেশের লেভেল ক্রসিংগুলো কেন নিরাপদ করা যাচ্ছে না এবং অবৈধগুলো কেন বন্ধ হচ্ছে না-এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের কাছে রইল। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্বে লেভেল ক্রসিংজনিত রেলের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তালিকার এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে রেলে দুর্ঘটনার প্রায় ৯৫ শতাংশই ঘটছে বিভিন্ন লেভেল ক্রসিংয়ে। এর প্রধান কারণ হলো, অন্তত ৮৫ শতাংশ বৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে নেই কোনো প্রহরী। পাশাপাশি রেলে যত্রতত্রভাবে বেড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজারগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ করছে রেল সেবা ব্যবস্থাকে। কারণ, সেগুলোয় কোনো প্রতিবন্ধক দণ্ড পর্যন্ত নেই। দেশের অসংখ্য অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে কেবল নামকাওয়াস্তে যেটি করা হয়েছে তা হলো, একটি নোটিশ টাঙিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে রেল বিভাগ; যা তাদের দায়িত্ব পালনের প্রতি চরম উদাসীনতা বলে মনে করি।
লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার জন্য পথচারী ও যানবাহনের চালকরাও দায় এড়াতে পারেন না। সাধারণত দুই কারণে রেলপথে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় এবং ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে। ট্রেনের নিচে কাটা পড়লে রেল কর্তৃপক্ষ কোনো দায় নেয় না; উলটো মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। অন্যদিকে, লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, দুর্ঘটনার কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে। এ কারণে যাত্রী ভোগান্তি বাড়ে; উপরন্তু রেলওয়েকে লোকসান গুনতে হয়। দুর্ঘটনা রোধে ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে লেভেল ক্রসিংগুলো অবশ্যই সুরক্ষিত করতে হবে। লেভেল ক্রসিং অতিক্রমকালে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। নিয়মকানুন ও আইন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে কর্তৃপক্ষ লেভেল ক্রসিংগুলো সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।
গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে খৈয়াছড়া ঝরনা লেভেল ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত ২৪ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুরে ট্রেনের সঙ্গে পোশাক কারখানার শ্রমিক বহনকারী একটি বাসের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বলাকা ট্রেন সোয়া ৭টার দিকে শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশন অতিক্রম করে। এরপর মাইজপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জানা যায়, এটিও একটি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। যখন শ্রমিক বহনকারী একটি বাস মাইজপাড়া এলাকায় রেললাইন অতিক্রম করছিল-সে সময় বাসটিকে ট্রেনটি ধাক্কা দেয়। আর দুর্ঘটনার সময় ওই লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটকিপার ছিল না। জ্বলেনি ট্রেন আসার কোনো সিগন্যাল বাতিও। অনুরূপ গত ৪ জুন নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় পিকআপ ভ্যানের তিন যাত্রী নিহত ও দুজন আহত হন। দেখা যাচ্ছে, সচেতনতার অভাবেও একদিকে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অন্যদিকে সুরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়েও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, যা দুঃখজনক। দেশের রেলপথগুলো কতটা অরক্ষিত এবং এর নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঝুঁকিপূণর্, তা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভিন্ন সময়ে এসব দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে। রেলওয়ে পুলিশের দুর্ঘটনাসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, অরক্ষিত ও সুরক্ষিত সব ধরনের লেভেল ক্রসিংয়ে পথচারীরা সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির শিকার হচ্ছে। তবে লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে গাড়িচাপা পড়া ও ধাক্কা খেয়ে ছিটকে প্রাণহানির ঘটনাও কম নয়। গত এক বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন। আর এ সংখ্যা রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের হিসাব বাদেই। এছাড়া রেলওয়ের অনুমতি ছাড়াই যেসব রেললাইনের ওপর দিয়ে অবৈধভাবে যানবাহন ও পথচারী চলাচল করছে, সেখানেও প্রায় প্রতিনিয়ত ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরও আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে। সরকারের কমবেশি পাঁচটি সংস্থা রেললাইনের ওপর সড়ক নির্মাণ করার কারণে লেভেল ক্রসিং সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট সবার অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আমলে নেওয়া অপরিহার্য।
পরিশেষে বলতে চাই, দেশে বিভিন্ন স্থানে ৬৭ শতাংশ অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং থাকাসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে দেশে একের পর এক রেলদুর্ঘটনা ঘটছে, এগুলো যেমন আমলে নিতে হবে, ঠিক তেমনই লেভেল ক্রসিং সুরক্ষিত করা এবং দুর্ঘটনা এড়াতে সামগ্রিক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া রেলের প্রতি যাত্রীদের আস্থা ফেরাতে সব ধরনের অনিয়ম, টিকিট কালোবাজারি চিরতরে বন্ধ করতে হবে। যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটবে এবং মানুষ চলে যাবে না-ফেরার দেশে; এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে লেভেল ক্রসিং সুরক্ষিত করাসহ যাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মো. আতিকুর রহমান : সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা, বিইউএফটি
atik.buft.edu.bd@gmail.com