Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

স্মার্ট প্রযুক্তি কি বদলে দেবে নৈতিকতার মানদণ্ড?

Icon

ড. মতিউর রহমান

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২২, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্মার্ট প্রযুক্তি কি বদলে দেবে নৈতিকতার মানদণ্ড?

মানবসভ্যতার ইতিহাসে তিনটি বড় শিল্পবিপ্লব গোটা দুনিয়ার গতিপথ ব্যাপকভাবে পালটে দিয়েছিল। প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটেছিল ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব ঘটে ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার ও ১৯৯০ সালে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার অবমুক্ত করার মাধ্যমে। ইন্টারনেটের আবিষ্কার বিপ্লবের গতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

স্মার্ট প্রযুক্তি বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে অতীতের সবকিছু বদলে যাচ্ছে। ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে নানা ধরনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটে দ্রুত গতিতে। স্মার্ট প্রযুক্তি বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য হাইটেক করপোরেশন ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন মাইক্রোসফট, অ্যাপল, গুগল, অ্যামাজন, আলীবাবার মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। প্রযুক্তিকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মহাকাশে ভ্রমণের জন্য অত্যাধুনিক মহাকাশযান তৈরির প্রতিষ্ঠান।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজসাধ্য করার জন্য নানারকমের ডিজিটাল উদ্ভাবন ও সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার সব ধরনের সেবা আমরা পাচ্ছি মুহূর্তে। সারা দুনিয়া এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা এদের সেবা ছাড়া অচল। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিুবিত্ত প্রত্যেকেই আমরা ডিজিটাল সেবার আওতাভুক্ত। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গোটা পৃথিবী করোনাভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। নিঃসন্দেহে মানবজাতির জন্য এটি বড় ধরনের একটি সংকট বা বিপর্যয়। এ ভাইরাসের কারণে এক সময় গোটা পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছিল। এ ভাইরাস থেকে বাঁচতে মানুষ নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সরাসরি দেখা-সাক্ষাৎ বা মেলামেশা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তদুপরি বিভিন্ন দেশের সরকার ঘোষিত লকডাউন বা শাটডাউনের কারণেও মানুষকে গৃহবন্দি থাকতে হয়েছিল। এ অবস্থায় প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ মানুষকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে।

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ এখন কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এখনো ডিজিটালি নিরক্ষর। এদের হাতে হাতে এখন ইন্টারনেটের সুবিধাযুক্ত স্মার্টফোন। সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগ স্থাপন বা ভাববিনিময়, মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে কেবল সংযোগের মাধ্যমে টিভিতে সিনেমা দেখা সবই সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির এ যুগে।

সমাজের সব শ্রেণির মানুষ এখন ডিজিটাল বিপ্লবের সুবিধাভোগী। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি বৃহৎ অংশ ইন্টারনেট প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত। লেখাপড়ার পাশাপাশি তারা অন্যান্য বিষয়েও আসক্ত হচ্ছে। অপরদিকে, ঘরে ঘরে ডিশ বা কেবল সংযোগের মাধ্যমে বিদেশি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নাটক, সিনেমা আমাদের ভাবনাজগতেও পরিবর্তন হচ্ছে। ওটিটি প্লাটফরমে এখন আমরা সিনেমা দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি; যেসব সিনেমার বেশিরভাগই আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়, তবু তাতেই আকৃষ্ট হচ্ছি। ইন্টারনেটের গুগল বা যে কোনো সার্চ ইঞ্জিনে ঢুকলেই সেগুলোর বিজ্ঞাপন অযাচিতভাবেই আমাদের চোখে পড়ছে। কৌতূহলবশত কেউ যদি সেখানে ঢুকে দেখতে চাই, তাহলে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় কি? অনেকে পর্নোগ্রাফিতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া অনলাইন গেমস ও জুয়াতে আসক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে আমাদের অগোচরেই কিছু বিষয় আমাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে, যা আমাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন আনছে।

আগেই উল্লেখ করেছি, এদেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো ডিজিটালি সচেতন নয়। ইন্টারনেটে তারা কী দেখছে তা আমরা জানি না। এ সম্পর্কিত কোনো গবেষণাও আমাদের দেশে হয়েছে বলে জানা নেই। সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো অবধি ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহারসংক্রান্ত কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় বলে জানা নেই। সরকারিভাবেও কোনো উদ্যোগ আছে বলে জানা নেই। এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব যে রয়েছে সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন।

আধুনিক প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহারে মানুষের মূল্যবোধেও পরিবর্তন আসছে। মানুষ মানুষের ওপর আস্থা হারাচ্ছে; সততা ও আদর্শের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চরমপন্থা, সহিংসতা এবং অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়ছি। নীতি, নৈতিকতা, মানবতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও দয়ার মতো মানবিক গুণাবলি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, যাকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক পুঁজির সংকট বলে বর্ণনা করেছেন। এ সংকট কতদিন চলবে তা এখনই বলা মুশকিল।

স্মার্ট প্রযুক্তির যুগে এসে আমাদের পূর্বেকার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে। এজন্য এখন আর কেউ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয় না। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি যেমন-গান, নাটক ও সিনেমার ফিউশন তৈরি করা হলেও তা আর আগের মতো আবেদন রাখতে পারছে না। আগে যেসব নাটক, গান, যাত্রাপালা ও সিনেমা আমাদের আকৃষ্ট করত, আমাদের মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিত, আত্মিক উন্নতি ঘটাত, সেরকম এখন আর আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না। ফলে তরুণ প্রজন্মের অনেকের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অবস্থাও একই রকম। আর এ আত্মিক ও নৈতিক শূন্যতার জায়গায় স্থান নিচ্ছে ধমীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার। এ সুযোগে ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আমাদের মনোজগতে ঢুকে পড়ছে। উপরন্তু অনুকূল পরিবেশে বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার দ্বারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি অংশও যে আচ্ছন্ন হয়, তারও প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। এভাবেই আমাদের উদার সমাজব্যবস্থা পরিণত হচ্ছে একটি অনুদার ও রক্ষণশীল সমাজে। এ এক ক্রান্তিকাল। কতদিন এ অবস্থা চলবে, সেটা নির্ভর করবে নতুন সংস্কৃতিতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার ওপর।

এ যুগে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। নতুন এ কঠিন পরিস্থিতিতে গোপনীয়তার সংজ্ঞাও বদলে যাবে। আগের মতো অনেক কিছুকে আর গোপনীয় বলে রক্ষা করতে পারব না আমরা। সবকিছুই খোলামেলা হয়ে গেলে মূল্যবোধকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনো নৈতিকতা দিয়ে চলবে না, চলবে গাণিতিক নিয়মে। মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মেধার অবারিত বিকাশ সামাজিক দায়বদ্ধতার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তার বিলোপ ঘটাতে পারে। ফলে মূল্যবোধের চর্চার পরিবর্তে গুরুত্ব পাবে বাণিজ্য। বাণিজ্যমনস্কতা আগামীতে আরও প্রকট হতে পারে। যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে মূল্যবোধ ও অবক্ষয়ের ব্যবধান কমে যেতে পারে। এমনকি মানবমনের বিবিধ চাহিদাই হয়ে উঠতে পারে মূল্যবোধের নতুন ভিত্তি।

ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যখন উপনিবেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে, তখন ইউরোপের বস্তুবাদী নাগরিক তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা তাতে আর্থিক মুনাফার যোগ ছিল। আর্থিক মুনাফাই নৈতিকতার সীমা ঠিক করে দিয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এভাবে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে, যার বর্তমান নীতি হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসার যে কোনো চাহিদাই নৈতিকতার ভরকেন্দ্র, হোক তা আগের মানদণ্ডে অনৈতিক বা বেঠিক।

আমাদের দেশেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মানস জগতে ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ ও নীতি, নৈতিকতার সঙ্গে এক ধরনের সংঘাত তৈরি হয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতির পার্থক্য থেকে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তি যেহেতু বস্তুগত সংস্কৃতি, সেই প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার এখনো আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। কতদিনে এ দুই সংস্কৃতির ব্যবধান দূর হবে তা নির্ভর করছে আমাদের মানস জগতের ইতিবাচক ও প্রগতিমুখী পরিবর্তনের ওপরে। মোট কথা, আমরা একটি ট্রানজিশনাল সময় অতিক্রম করছি। তবে এ কথা সত্য, স্মার্ট প্রযুক্তি আমাদের বৃহত্তর সমাজে প্রচলিত নৈতিকতার মানদণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। তবে এ পরিবর্তন কতদিনে সম্পন্ন হবে তা সময়ই বলে দেবে।

ড. মতিউর রহমান : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম