ইলন মাস্ককে নিয়ে সারা পৃথিবীতে এখন ব্যাপক হইচই। টুইটার কিনতে গিয়ে তিনি এত বেশি অর্থ অফার করেছিলেন, যা রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেয়। কোনো কোনো দেশ তো ভাবতেই শুরু করে দেয় যে, ইলন মাস্ক তাদের দেশটিও চাইলে কিনে নিতে পারেন।
বিষয়টি যতই হাস্যরসপূর্ণ হোক, ইলন মাস্ক সেদিকে খুব নজর দেওয়ার সুযোগ পাননি। পরবর্তীকালে কী করে নতুন কিছু করা যায়, সেদিকেই তিনি মনোযোগ ধরে রেখেছেন।
এই ইলন মাস্কই ২০০১ সালে মহাকাশ যাত্রার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির জন্য মঙ্গলগ্রহে গ্রিনহাউস প্রজেক্টের মাধ্যমে খাদ্যশস্য তৈরি করার একটি ‘মার্চ ওয়াসিস’ কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছিলেন।
২০০১ সালের অক্টোবরে ইলন জিম ক্যান্ট্রেল এবং কলেজবন্ধু এডিও রেসিকে সঙ্গে নিয়ে মহাকাশ পরিবহণের মাধ্যম হিসাবে পরিমার্জিত ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) পরিদর্শন করেন। দলটি মস্কোর মনপিও লভস্কিন ও কসমোট্রাস কোম্পানি পরিদর্শন করে।
সাক্ষাৎ শেষে দলটি শূন্য হাতেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসে। ২০০২ সালে তারা আবারও তিনটি আইসিবিএম দেখার জন্য রাশিয়ায় যান। কসমোট্রাসের সঙ্গে আবারও সভা করেন। কোম্পানি একটি রকেট ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রির প্রস্তাব করলে এবারও দলটি শূন্য হাতে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসে।
ফিরতি প্লেনে ইলন সঙ্গে থাকা দলটিকে জানান, তিনি একটি নতুন কোম্পানি গঠন করে নিজেরাই রকেট তৈরি করবেন। এরপরই ২০০২ সালের মে মাসে তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে সহযোগী কোম্পানি ‘স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজি করপোরেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র দুটি সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে রকেট টেকনোলজি আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন ইলন মাস্ক।
এরই বহিঃপ্রকাশ ‘ফ্যালকন-১’ ও ‘ফ্যালকন-২’ নামের মহাকাশ যান। এরপরই কোম্পানির পূর্ণাঙ্গ মহাকাশ যান ‘ড্রাগন’ তৈরি হয়ে যায়। ‘ফ্যালকন-১’ রকেটটি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজস্ব তহবিলে নির্মিত বিশ্বের প্রথম মহাকাশ যান, যা পৃথিবীর কক্ষপথের স্যাটেলাইটে গমন করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তি-মেধার টাইকুন ইলন মাস্কের মেধার হিসাব নিতে হলে এ উদাহরণটিই যথেষ্ট।
প্রযুক্তি-মেধা জগতের আরেক চমক অ্যামাজনের জেফ বেজোস। ইতোমধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছেন, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সিলিন্ডারের মধ্যে মানুষ ভরে মহাকাশে পাঠানো। মহাকাশে সন্তানসন্ততি জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে; গড়ে তোলা যাবে পুরোদস্তুর উপনিবেশ। সেখানকার বাসিন্দারা ছুটি-ছাটায় বেড়াতে আসবেন পৃথিবীতে। তিনি আরও বলেন, মহাকাশে বহু মানুষের জন্ম হবে।
সুতরাং সেটাই হবে তাদের জন্মভূমি। আর পৃথিবী হবে তাদের কাছে ঘুরতে আসার জায়গা। ইতোমধ্যে তাদের এমন স্বপ্নের ঘরে ঘি ঢেলেছেন এক মডেল সমকামী দম্পতি অ্যাডলি ও রবি। তাদের স্বপ্ন মহাকাশে উদ্দাম মেলামেশার। লক্ষ্য, ২০২৬ সালে ‘স্পেস এক্স’ যে যাত্রীবোঝাই মহাকাশ যান পাঠাবে, তাতে সওয়ার হওয়া।
আজকের দুনিয়ায় প্রযুক্তি সংস্থার প্রভূত প্রভাব। গত দুই দশকে তারা মানুষের জীবনযাত্রায় বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়েছে। অন্যদিকে আবার তা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে এ টেক জায়ান্ট বা প্রযুক্তি দৈত্যদের লড়াই দানা বেঁধেছে।
গুগল, টুইটার আর ফেসবুককে চাপ দিয়ে চলেছে রাশিয়া, ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দেশ। ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জোট ‘ফাইভ আইস’ জানিয়ে দিয়েছে, প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে এনক্রিপ্ট করা উপাদান আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে দিতে হবে। তারা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, গোপনীয়তা এবং এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনের নামে এমন কিছু করা যাবে না, যা অপরাধীদের সাহায্য করে। মাস কয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ফেসবুকের যে লড়াই হয়, এ গ্রহের দখলদারিত্বে প্রযুক্তি দৈত্যদের ওপর তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
অস্ট্রেলিয়ার সংবাদ সংস্থা অভিযোগ করেছিল, তাদের খবরের লিংক ব্যবহার করে ব্যবসার সমূহ ক্ষতি করছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলো। ফলে সরকার আইন প্রয়োগে উদ্যোগী হয়, যাতে প্রযুক্তি সংস্থাগুলো খবর ব্যবহার করলেই উপযুক্ত অর্থমূল্য দিতে হয়। প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করেও এ আইন মেনে নেয় গুগল। বিপুল অঙ্কের চুক্তি সেরে ফেলে প্রধান অস্ট্রেলীয় সংবাদ সংস্থাগুলোর সঙ্গে।
লড়াইয়ের ওদিকে অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার খবর নিষিদ্ধ করে দেয় ফেসবুক। প্রবল চটে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেন, সংস্থাগুলো দুনিয়া পালটে দিতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারাই দুনিয়া চালাচ্ছে।
১ দশমিক ৭ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ফেসবুক ব্যবহারকারীর জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্ত সহজ হলেও তা নিশ্চয়ই ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো বা ফিলিপাইনের মতো যেসব দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আমেরিকার পরেই সর্বাধিক, সেসব দেশে ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটলে খেলা অন্যরকম হতে পারে। অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছে আলোচনার টেবিলে। কিন্তু এটা সমাপ্তি নয়, বৃহত্তর যুদ্ধের শুরু মাত্র।
স্বয়ং আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ার মতো করে আইন আনা যায় কিনা, সে নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। ব্রিটেন, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও অস্ট্রেলীয় আইন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
গত বছর ৪ অক্টোবর ‘গেল গেল’ আর্তনাদ উঠেছিল পৃথিবীজুড়ে। ছয় ঘণ্টার জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল হোয়াট্সঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম। এ সময় প্রতিযোগী সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফরমে উপচে পড়ে নেট-নাগরিকদের ভিড়। ফেসবুক কিংবা হোয়াট্সঅ্যাপনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য থমকে যায় মুহূর্তেই।
ভাবুন তো, কয়েকটি মাধ্যম নয় কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্য নয়, যদি উধাও হয়ে যায় সব সোশ্যাল মিডিয়া-চিরতরে, অনির্দিষ্টকালের জন্য, কেমন হবে তখন পৃথিবীর চেহারা? আবার অন্যদিকে ভাবুন, আজকের প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী যদি পৌঁছতে পারে কয়েক দশক আগের সেই আবহে-যে সময়টায় শুধু গুগল, ইউটিউব, ইমেইল ছিল, অন্য কোনো প্রযুক্তি ছিল না! বর্তমানে পৃথিবীর ৯০ শতাংশের বেশি সংস্থা সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নেয় চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় ৪০ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয় ফেসবুকে। প্রায় পাঁচ কোটি প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে যোগাযোগ রাখে ক্রেতাদের সঙ্গে।
পৃথিবীর ৮০ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বর্তমানে খবর সংগ্রহ করে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। ছাপানো উৎস থেকে খবর নেয় মাত্র ৫-১০ শতাংশ মানুষ। ভাবতে পারেন, কী হবে এসব হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলে! কল্পনায় দেখতে পারেন-আবার মানুষ সংবাদপত্র পড়ছেন, বই পড়ছেন, সিনেমা দেখছেন সিনেমা হলে গিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে সামনাসামনি বসে সময় কাটাচ্ছেন অনেক বেশি, হাতেলেখা চিঠির পুনর্জন্ম হচ্ছে, নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে ইমেইল! এসব কি কল্পনায় কিংবা স্বপ্নে আসছে আপনার কাছে?
সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক কে হবে-বিজ্ঞান না প্রযুক্তি? নাকি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমন্বিত পদ্ধতি? সেই কবে প্রযুক্তিকে মৌলিক বিজ্ঞানের ‘জারজ সন্তান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল তার ‘স্টাডিজ ইন এ ডাইং কালচার’ নামের বিশ্বনন্দিত বইয়ে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বিশুদ্ধ মৌলিক বিজ্ঞানকে বিপথে নিয়ে যাবে প্রযুক্তি। মানুষের জন্য যা যা অকল্যাণকর, তার সবটাই ঘটাবে প্রযুক্তি। একটা সময় আসবে, যখন প্রযুক্তি হয়ে উঠবে মৌলিক বিজ্ঞানের হাতে গড়া ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
প্রযুক্তির রমরমায় মানুষ মেতে উঠবে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেই প্রযুক্তিই ডেকে আনবে মানুষের সর্বনাশ। কডওয়েলের তত্ত্ব কি আজ আমাদের হাতেনাতে ফলছে? আমরা প্রযুক্তিতে বুঁদ হয়ে ভুলতেই বসেছি যে আলো, পাখা, কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট-এসব ব্যবহারিক বস্তু আদতে আবিষ্কার হয়েছিল দীর্ঘদিনের মৌলিক বিজ্ঞানচর্চার ফলে এবং এর বেশিরভাগটাই হয়েছিল গবেষণাগারে।
প্রযুক্তিকে বিজ্ঞান বলে ভুল করে বসে অনেকেই। প্রযুক্তি বিজ্ঞানভিত্তিক হতে পারে, কিন্তু সব প্রযুক্তিই বিজ্ঞান নয়। প্রযুক্তি বিজ্ঞানের হাত ধরে আসতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আছে সিলিকন ভ্যালির, বিজ্ঞান গবেষণাগারের নয়। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে মেলবন্ধনে জড়িয়ে ফেলার প্রচেষ্টা ঠিক একচক্ষুবিশিষ্ট হরিণের দেখার মতো। আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনের সঙ্গে প্রযুক্তির দর্শনের রয়েছে বিশাল ব্যবধান। প্রযুক্তি বিজ্ঞানচর্চার বহমান ধারায় নিরন্তর আঘাত হেনে চলেছে। বিজ্ঞান প্রকল্প রদ হয়ে গিয়েছে, প্রকল্প ও প্রশাসনিক কাঠামোতে এসেছে পরিবর্তন।
বৈজ্ঞানিক সত্য কোনো স্থির সত্য নয়। এসব সত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। যেমন সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘুরে চলা একটি চলমান সত্য-যা কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন হয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে। বিজ্ঞান অপেক্ষা করে শেষ কথা কে বলবে তার জন্য। এ ফাঁক দিয়েই ঢোকে প্রযুক্তি, অপবিজ্ঞান। আর অপবিজ্ঞানের হাত ধরে আসে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। বিজ্ঞানের পরিবর্তে বর্তমানে চলছে ভুয়া তথ্য আর অপবিজ্ঞানের বাড়বাড়ন্ত। এটা আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সমাজের বৃহৎ একটি অংশই আজ বিজ্ঞানের সঙ্গে অপবিজ্ঞানের মিলন ঘটিয়ে তাদের কল্পজগতের বাস্তব রূপ দিয়ে দিচ্ছে। মানুষের সুপ্ত আত্মপ্রচারের লোভকে উসকে দেয় সমাজমাধ্যমের প্রযুক্তিগুলো। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন প্রযুক্তির ফায়দা তুলছে, তেমনি ধর্মের ধ্বজাধারী কিছু গোষ্ঠী চালিয়ে যাচ্ছে মিথ্যা প্রচার এবং হিংসার সর্বনাশী বিষ বিতরণ।
সুধীর সাহা : কলাম লেখক
ceo@ilcb.ne