শতফুল ফুটতে দাও
পুঁজিবাদের দুই চেহারা
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বের পরাশক্তিগুলো নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর রাষ্ট্র।
প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান পরাশক্তি হিসাবে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। শুধু প্রযুক্তি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখার ব্যাপারে কোনো আপস করেনি।
মার্কিন পুঁজিবাদ স্বল্প শিক্ষিত আমেরিকানদের স্বার্থে কাজে লাগছে না। গত ৫০ বছরে ভালো চাকরি না পাওয়া এবং প্রকৃত মজুরি হ্রাস পাওয়ার ফলে ওখানকার জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে।
জীবনযাপন কঠিন হয়েছে জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া এবং শ্রমিক শ্রেণির জীবনকে প্রায় মূল্যহীন ভাবার ফলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিদ্যমান কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন বিয়ে-শাদি, গির্জা এবং কমিউনিটি যারা দুঃখ-কষ্টে আছে তাদের সাহায্য করত।
এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বেকার ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে। সমাজে পরিচয় এবং মর্যাদা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। জীবনের যে অর্থ ছিল তাও হারিয়ে গেছে। আত্মহত্যার ওপর বিশিষ্ট গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুরখিম বেঁচে থাকলে বলতেন আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর কারণ হলো, একদিকে ইচ্ছাপূর্বক আত্মহনন এবং অন্যদিকে সমাজে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে দুশ্চিন্তা এবং নেশাগ্রস্ত হওয়ার মতো রোগ দেখা দিচ্ছে। নেশার ফলে অস্থিরতাজনিত মৃত্যুও বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সমাজজীবনে নেতিবাচক প্রবণতা কেন বাড়ল এবং কীভাবে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়? সামন্তবাদের অবসানে পুঁজিবাদের উত্থান সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখাগুলো সমৃদ্ধ হয়েছে। ব্যক্তি মানুষের সামাজিক অবস্থান জন্মসূত্রে নির্ধারিত হয় না, এটা নির্ধারিত হয় মানুষের যোগ্যতা এবং দক্ষতার মাপকাঠিতে।
পুঁজিবাদের প্রধান দুটি শক্তির উৎস হলো প্রতিযোগিতার শক্তি এবং মুক্তবাজার। পুঁজিবাদের উত্থানের ফলে মানুষের দুর্দশা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। লাখ লাখ মানুষ অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো পুঁজিবাদের কারণে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে। গত ২৫০ বছরে এসব দেশে দ্রুততার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার মান এবং সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারত ও চীনে গত ৫০ বছরে ইতিবাচক পরিবর্তনগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক মুক্ত উদ্যোগ মানুষকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। এই পরিবর্তন ঐতিহাসিকভাবে দৃষ্টি কাড়ে এবং পৃথিবীর অনেকাংশে এই ধরনের পরিবর্তন মানুষের সামাজিক জীবনে যা কিছু শুভ ও মঙ্গলময় সেসবের বিকাশ ঘটিয়েছে। পরিবর্তনের এই গল্পে বাণিজ্য, উদ্ভাবনা এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিগমন ইতিবাচক উপাদান হিসাবে ক্রিয়াশীল হয়েছে। এখন আমরা লক্ষ করছি, এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যাচ্ছে অভিবাসী হয়ে। দেশ-দেশান্তরে মানুষ এখন কর্মসংস্থানের জন্য যাতায়াত করে। দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মজীবী মানুষ বাজার থেকে আশানুরূপভাবে উপকৃত হচ্ছে না। বর্তমানে আমরা পুঁজিবাদের সবচেয়ে খারাপ চেহারাটি দেখছি। স্বাস্থ্যরক্ষা শিল্প নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের কাছে পুঁজিবাদের হিংস্র চেহারাটি ধরা পড়ে।
অর্থনীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাজারকে পরিহার করে তার জায়গায় অন্য কিছু নিয়ে এলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের দেখতে হবে সত্যিকার অর্থে খাঁটি মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার কীভাবে ক্রিয়াশীল করা যায়। বাজার কাঙ্ক্ষিত রূপে কাজ করছে না। অন্যান্য ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। রাজনৈতিক ক্ষমতা উত্তরোত্তর শ্রমজীবীদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার।
আজকের দিনের আমেরিকায় অসাম্যকে প্রধান সমস্যা হিসাবে দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এটাকে বর্তমান সময়ের নির্ধারক চ্যালেঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অনেক বামপন্থি যুক্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করেন, আমেরিকার জন্য একটি পুনর্বণ্টন কর্মসূচি প্রয়োজন। এই কর্মসূচি হলো ধনীদের ওপর বেশি করে কর আরোপ করে তা গরিবদের নিকট হস্তান্তর করা। গণদ্রব্য তৈরি করার জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে যার ফল সবাই সমানভাবে ভোগ করবে। অসাম্যের সমস্যাটি একটি গভীর সমস্যা। আমেরিকায় এখন যে সমাজ বিরাজ করছে তা বহুলভাবে রবিনহুড সমাজের প্রতিরূপ হিসাবে আয়নায় দেখা যায়। এই সমাজেও পুনর্বণ্টন হচ্ছে। কিন্তু তা ওপর থেকে নিচের দিকে নয়। বরং নিচ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে।
অর্থাৎ গরিবদের কাছ থেকে ধনীদের কাছে যাচ্ছে। রবিনহুড ধনীদের সম্পদ লুট করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা যেভাবে চলছে তা আসলে গরিবদের কাছ থেকে ধনীদের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়ার শামিল। কেউ যুক্তি দিতে পারে, গরিবদের কাছ থেকে লুট করা লাভজনক নয়। কারণ, তাদের সামান্যই আছে। কিন্তু তারা সংখ্যায় অনেক। অন্যদিকে ধনীরা সংখ্যায় কম। ফলে বিপুলসংখ্যক গরিবের কাছ থেকে অল্প অল্প করে ধনীদের হাতে সম্পদ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার পরিমাণ অগ্রাহ্য করার মতো নয়।
এই যে গরিবদের কাছ থেকে সম্পদ ধনীদের কাছে চলে যাচ্ছে, তাতে করে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের পরিস্থিতিটি এমন নয় যাতে করে গরিবদের হাত থেকে সম্পদ ধনীদের হাতে যাওয়া অনিবার্য হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদে এমনভাবে কাজ করার কথা নয়। তবে এই ঝুঁকিটি থেকেই যায়। মার্কিন অর্থনীতির বিরাট অংশ এমনভাবে দখল হয়ে গেছে, যার ফলে ধনীরা সরকারের সম্মতি এবং যোগসাজশে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে। অসাম্যের সমস্যাটি এরকম যে এতে যারা ওপরে অবস্থান করছে, সম্পদ ও আয়ের দিক থেকে তারা সেটা করতে পারছে দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে। মার্কিনিরা অসাম্যজর্জরিত একটি সমাজে বাস করছে। এই সমাজে শুধু অসাম্য বিরাজ করে এমনটি নয়। এ সমাজে ইনসাফেরও অভাব আছে। যদি কেউ ধনী হওয়ার প্রক্রিয়ায় অন্য সবার উপকার করে, তাহলে তা নিয়ে আপত্তি করার খুব কারণ নেই।
নিম্ন মজুরিভূক শ্রমজীবীরা তিন ধরনের হুমকির সম্মুখীন। এ ব্যাপারে ব্যাপক দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। স্বল্প দক্ষ শ্রমজীবীরা অন্য দেশ থেকে আগত কম মজুরির শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়ে যায়। অন্য দেশে গেলেও সেখানে কম দক্ষ মার্কিন মজুরদের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে। প্রতিযোগিতার বিষয়টির একাধিক মাত্রা রয়েছে। এক সময় শিল্পোন্নত দেশ থেকে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ থেকে পণ্যসামগ্রী আমদানি হতো। এখন অনুন্নত দেশে কিছু পণ্যসামগ্রী কম মজুরির শ্রমিকরা উৎপাদন করে। এদিক থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা অন্য দেশের শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। প্রতিযোগিতা শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষে প্রতিযোগিতা নয়। এখন শ্রমিকদের দিনে দিনে অধিকতর হারে রোবটের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হয়।
রোবট অনেক ধরনের কাজ করতে পারে। রোবটের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন নেই। অথবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধারও প্রয়োজন নেই। রোবটের ক্ষেত্রে মানবসম্পদের মতো প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন নেই। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি রোবটকে বাধাগ্রস্ত করে না। কর ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন মেশিনের জন্য ভর্তুকি দেওয়া হয়, কিন্তু শ্রমিকের পেছনে খরচের জন্য কোনো ভর্তুকি পাওয়া যায় না।
অভিবাসনের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলাপ-আলোচনায় এসেছে। কিন্তু অভিবাসন দীর্ঘমেয়াদে শ্রমিকদের মজুরি স্থবির করে দেয় না। এর ফলে নিম্নবিত্তদের মধ্যবিত্তে উত্তরণেও বাধার সৃষ্টি করে না। এসব ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন এবং স্বয়ংক্রিয়ায়ন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্য অনেক দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এগুলোর প্রভাব অনেক বেশি নেতিবাচক হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের ইতিহাস, সীমিত কল্যাণব্যবস্থা এবং খুব ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সমস্যাটির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কম শিক্ষিত শ্রমিকরা তিন ধরনের হুমকি মোকাবিলা করছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধীর গতির হওয়ায় নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পুরাতন প্রজন্মের জীবনযাত্রার মানে তেমন কোনো হেরফের হচ্ছে না। নতুন প্রজন্ম উন্নততর জীবনযাত্রার আশা করে হতাশায় পড়ে যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধি যদি সাম্যের নীতি মেনে চলত, তাহলেও এই হতাশা থাকত। বর্তমান সময়ে শ্রমিকের মজুরি অতীতের মতো দ্রুত হারে বাড়ছে না। যখন অসাম্য বেড়ে যায় তখন কম শিক্ষিত শ্রমিকরা কম প্রবৃদ্ধির অবস্থায় বেশি কষ্ট পায়।
যদি প্রবৃদ্ধির হার বেশি হতো, তাহলে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় তেমন করে গায়ে লাগত না। স্বাস্থ্যসেবা শিল্পে যেভাবে রেন্টসিকিং হচ্ছে, তা সত্ত্বেও শ্রমজীবী মানুষদের কষ্ট কম হতো, সবার সমান সুযোগের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। অর্থনৈতিক কাঠামোতেও পরিবর্তন হয়েছে। অর্থনীতি এখন মেনুফ্যাকচারিং থেকে সেবা খাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেবা খাতের মজুরি মেনুফ্যাকচারিং খাতের মতো নয়। শ্রমিকরা ভালো মজুরি পাচ্ছে না। সেবা খাতে ট্রেড ইউনিয়নের প্রভাব কম এবং নিয়োগকারীদের তুলনায় শ্রমিকদের ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ খাতের শ্রমিকদের জন কেনেথ গলব্রেথ নির্দেশিত কাউন্টার ভেইলিং পাওয়ার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম দেড় থেকে দুই গুণ বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে বয়োবৃদ্ধ মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয়ের লোকেরা বিপদে পড়বে। আমরা এখনো এমন কোনো কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি, যার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষ, নিম্নআয়ের মানুষ এবং বয়োবৃদ্ধ মানুষদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সাহায্য করা সম্ভব। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জানার জন্য দ্রুততার সঙ্গে জরিপ গবেষণা খুবই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ