শতফুল ফুটতে দাও
বাংলাদেশ কি সুখী মানুষের আবাসভূমি?
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চলতি বছরের মার্চ মাসে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় ৭ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৪৬টি দেশের তালিকায় এ বছর ৯৪ নম্বরে এসেছে বাংলাদেশ। আগের বছর ১৪৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১। এ মাসেই আরেকটি বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেল, বিশ্বের সপ্তম দুঃখী দেশ হলো বাংলাদেশ।
বড় জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ জানিয়েছে তাদের ২০২২ গ্লোবাল ইমোশনস রিপোর্ট অনুযায়ী রাগ, দুঃখ ও মানসিক চাপে থাকা অবস্থার দিক থেকে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের সপ্তম স্থানে রয়েছে। তাদের নেগেটিভ এক্সপেরিয়েন্স ইনডেক্স সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এসেছে ৪৫। বছরের শুরুর দিকে করা এবং বছরের মাঝামাঝি সময়ে করা জরিপ দুটি বিপরীতমুখী অবস্থানে এসেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
এখানে দুটি জরিপ এবং দুটি খবর নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। শুধু সংবাদপত্রের শিরোনাম বিবেচনায় নেওয়া হলে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। কারণ প্রথমোক্ত খবরের শিরোনাম ‘সুখী দেশের তালিকায় ৭ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ’। পরের জরিপটি জানাচ্ছে, ‘বিশ্বে সপ্তম দুঃখী দেশ বাংলাদেশ’। অর্থাৎ শুধু শিরোনাম দেখে বিচার করলে মনে হবে দুটি শিরোনামের তথ্য পরস্পরবিরোধী। একটিতে মনে হয় দেশ সুখের দিক থেকে এগিয়েছে, আরেকটিতে মনে হয় দেশ পিছিয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা জানেন কোনো বিষয় বা সমাজের ওপর গুণগত তথ্য সংগ্রহ করা হলে এ তথ্যের সংখ্যাগত পরিমাপ অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি করে। এক সময় অর্থনীতিবিদরা মনে করতেন উপযোগ বা ইউটিলিটি পরিমাপযোগ্য। যেমন একটি কমলা প্রথমবার খাওয়ার জন্য এর ভোক্তা ১০টি ইউটিল পেল, দ্বিতীয় কমলা থেকে ইউটিল পাওয়া গেল ৯টি।
কিন্তু ইউটিলিটি বা উপযোগিতা পরিমাপযোগ্য নয়। কারণ এটা মানুষের অনুভূতি মাত্র। অনুভূতি এমন একটি মানসিক অবস্থা যা সংখ্যার স্কেলে পরিমাপ করা যায় না। কমলার দৃষ্টান্ত থেকে শুধু বলা যায় প্রথমবার কমলা খেয়ে যে উপযোগ পাওয়া গেছে, দ্বিতীয়বারের সেটা প্রথমবারের তুলনায় কমেছে মাত্র। গণিতশাস্ত্র এ অবস্থায় অধিকতর অথবা উন্নততর অবস্থাই নির্দেশ করতে পারে, অবশ্যই সংখ্যা দিয়ে এর পরিমাপ করা যায় না। এ রকম অবস্থায় র্যাংক ব্যবহার করাই সঠিক। জরিপ দুটিতে সুখের পরিমাপক দুই ধরনের।
জাতিসংঘ সুখী দেশের তালিকা করার ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়নকে পরিমাপক হিসাবে ধরেছে। জাতিসংঘের জরিপে মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। আর গ্যালাপের জরিপে ব্যক্তির শারীরিক ব্যথা-বেদনা, উদ্বেগ, দুঃখ, মানসিক চাপ এবং ক্ষোভের বিষয়কে বিচেনায় নেওয়া হয়েছে। সুখ কিংবা দুঃখ নিয়ে গবেষণা আমাদের সন্ধিগ্ধ করে তোলে।
এ ধরনের জরিপ কেন করা হয় তা খুব পরিষ্কার নয়। যখন শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ড উন্নত হচ্ছিল এবং তার দেখাদেখি ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র উন্নত হতে থাকে, তখন এ ধরনের জরিপ খুব একটা করা হতো না। নতুন সহস্রাব্দে এ ধরনের অনেক জরিপ চালু করা হয়েছে। এসব জরিপ শুধু দু-চারটি দেশকে কেন্দ্র করে নয়, সমগ্র পৃথিবীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর একটি বড় কারণ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বিশ্বায়নের পথে চলতে গিয়ে কোন দেশ কী করছে, কী তাদের অভিজ্ঞতা এবং এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনটা সুখকর এবং কোনটা দুঃখ জাগানিয়া, সেসব ভালো করে জানতে পারলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ জন্যই এ ধরনের জরিপ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। অবশ্য সম্প্রতি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ক্ষমতার দম্ভে হোঁচট খেতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের দ্রুত উন্নয়নকে সহজভাবে নিতে পারছে না। তাই দেশটি স্যাংশন আরোপের পথে হেঁটেছে। চীন থেকে রপ্তানি করা কিছু পণ্যসামগ্রীর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চড়া হারে শুল্ক আরোপ করেছে। চীনও চুপ করে বসে থাকেনি।
চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক বাধা জোরদার করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে হচ্ছে, বিশ্ব এখন বাণিজ্য যুদ্ধের ক্ষতিকারক পরিস্থিতিতে বন্দি হওয়ার উপক্রম। এসব কারণে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। চীনের বেল্ড অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার পথে অবদান রাখতে পারত।
কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। বিশ্বের সমৃদ্ধিতে সবাইকে অংশীদার করার এ প্রকল্পটি ভূ-রাজনীতির আক্রমণের শিকার হচ্ছে। দেখা যাবে নতুন নতুন প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী জরিপের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুখ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? দুঃখ বলতে আমরা কী বুঝি? দর্শনশাস্ত্রের উৎপত্তি থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মানুষের মনের অবস্থা নিয়ে অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও চিন্তাভাবনা হয়েছে। গৌতম বুদ্ধ রাজকীয় বিলাসব্যসন ছেড়ে সত্যিকার সুখ কী তা জানার জন্য ৩৩ বছর মৌন ধ্যানে কাটিয়েছেন। অবশেষে বধিবৃক্ষের মূলে বসে তিনি সাধনা করেছেন কীভাবে এ জগতের মানুষ সুখী হতে পারে।
বৌদ্ধদের প্রার্থনায় কামনা করা হয়, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। গৌতম বুদ্ধ বধিবৃক্ষের নিচে ৩৩ বছরের ধ্যানের শেষ বছরগুলোয় দৈনিক একটি মাত্র দানা ফল খেয়ে তার সাধনা চালিয়ে গেছেন। এ দানা ফলটি আসলে কী ফল ছিল তা নিয়ে নানা ধরনের মত আছে। তবে অনেকেই মনে করেন দানা ফলটি হল ‘ডুমুর’। প্রশ্ন উঠতে পারে কে সুখী? গৌতম বুদ্ধ নাকি তার সময়ের ভারত সম্রাট? এ ধরনের প্রশ্ন বিচারে অনেকেই মেনে নেবেন গৌতম বুদ্ধই সত্যিকার অর্থে সুখী ছিলেন।
প্রবাদ আছে, রোম যখন জ্বলছিল, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। রোমবাসী যখন আগুনে তাদের সর্বস্ব হারাচ্ছিলেন তখন তাদের সম্রাট কীভাবে বাঁশি বাজাতে পারলেন! এ নিয়ে দুরকম ব্যাখা আছে। প্রথম ব্যাখ্যা হলো আগুনের শিখার মধ্যে নীরো অনির্বচনীয় সুন্দরকে দেখেছিলেন। তাই তখন তার মনে ছিল অপার আনন্দ। দ্বিতীয় মতটি হলো, নীরো প্রজাদের দুঃখের কথা ভেবে বাঁশিতে করুণ সুর তুলেছিলেন।
সুখ ও আনন্দের ব্যাখ্যা করতে গেলে কোনো সহজ সমাধান পাওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধ মনে করতেন দুঃখ-কষ্ট অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ দুঃখ আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে অসুখ-বিসুখ এবং বার্ধক্যে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই হয় অবধারিত। কিন্তু কেন আমরা কষ্ট পাই, দুঃখ পাই? এর উৎপত্তি আমাদের কামনা-বাসনায়। এ যৌনসুখ থেকে সম্পদ সম্পত্তি আহরণ এবং ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানো সবকিছুই আমাদের কামনা-বাসনার ফল। দুঃখকে কীভাবে জয় করা যায়? দুঃখকে জয় করতে হলে লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। গৌতম বুদ্ধ প্রদত্ত অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথে চলার জন্য আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করতে হবে এবং নিজের ভেতরকার আমিত্বকে জয় করতে হবে।
এ আমিত্বের কারণেই একজন ফরাসি সম্রাট বলেছিলেন, I am the state. আমিই রাষ্ট্র। আবার অনেকে নির্ঝঞ্ঝাট ক্ষমতা চান। এমন সব লোভের কারণে পৃথিবী হয়ে ওঠে নরকতুল্য। প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, অনেক কিছুই জ্ঞানকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রম অবস্থান এবং মানবজীবনের সংক্ষিপ্ত রূপ। জালাল উদ্দিন মুহম্মদ রুমি বলেছেন, দুঃখ করোনা, যা কিছু তুমি হারাও তা ফিরে আসে ভিন্ন রূপে। ডেসিডেরিয়াস বলেছেন, সুখ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে পৌঁছানোর পর ব্যক্তি মনে করে এটাই তার প্রাপ্য ছিল। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ যদি বুঝতে পারত তার যোগ্যতা কী, তাহলে বাড়তি কিছু পাওয়ার জন্য সে পেরেশান হয়ে উঠত না। তাতেই নিহিত আছে সুখ।
জেরেমি বেনথাম বলে গেছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য সুখ নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। দার্শনিক সোরেন ক্রিয়ারকে গার্ড বলেছেন, মানুষ দুশ্চিন্তায় ভোগে। দুশ্চিন্তা থেকে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন্ন হয়। মানুষ যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তখন সে মনে করে পছন্দ করার বা বাছাই করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে তার। কিন্তু একটা সময়ে এসে সে বুঝত পারে তার বাছাই করা বাস্তবে কিছু না। এর ফলে তার মনে ভয় ঢুকে যায় এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই আমাদের মনে চূড়ান্ত স্বাধীনতার ভাবনা দুর্ভাবনার ঝড় তোলে।
বাংলা সাহিত্যেও খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে গল্প-কাহিনি আছে। দার্শনিক মাইকেল ডি মন্টেইন বলেছেন, সুখ্যাতি ও শান্তি একই বিছানার সঙ্গী হতে পারে না। দার্শনিক রাসেল বলছেন, কাজের প্রতি আমাদের মনোভাব অযৌক্তিক। আমরা মনে করি কাজের মধ্যে ভালো কিছু আছে। আমরা আরও বিভিন্ন কাজকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করি। এসবের ফলে আমরা অসুখী হই। সুখহীনতা এড়াতে হলে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোন কাজটি সত্যিকার অর্থে মূল্যবান। শেষ পর্যন্ত কম কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ সুখ অর্জন করে।
আসলে নিত্যদিন আমরা অনেক কাজ করি। কিন্তু এসব কাজের অনেকই অকাজ। তাই রাসেল কাজ কমিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তা করতে পারলেই আমরা জীবনে সুখ-শান্তি পেতে সক্ষম হব। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Ignorance is bliss. অর্থাৎ অজ্ঞানতার মঝেই শান্তির অবস্থান। আমি আমার অনেক বন্ধুকে দেখেছি তাদের মধ্যে রোগ-ব্যাধি সংক্রান্ত জ্ঞানের খুবই অভাব। তাই তারা অসুখ-বিসুখ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না। তাদের ওপর দুশ্চিন্তার ছাপ অনেকটুকুই থাকে না। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারলে অথবা আংশিকভাবেও মুক্ত থেকে সুখ-স্বস্তি নিশ্চিত করা যায়।
যদি কোনো মানুষ খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়, তাহলে সে যা অর্জন করেছে তার চেয়েও বেশি কিছু সে পেতে চায়। এ ব্যক্তি বিষণ্ন নন। কিন্তু অতৃপ্ত। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখি, আর একটু কিছু হলে ভালো হতো। এই যে মানুষটি আরও কিছু চায়, তার মানে হলো সে অতৃপ্ত। তার অতৃপ্তি যদি পূরণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে তার মানসিক কষ্ট আরও বৃদ্ধি পাবে।
সুখ, আনন্দ, পরিতৃপ্তি, আরাম-আয়েশ, সুখহীনতা ও শূন্যতাবোধ ইত্যাদি বিষয় মূলত মানুষের মনোজগতে প্রোথিত। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সুখ-দুঃখকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। কৃষকরা পুঁজিপতিদের মতো বিশাল মুনাফা চায় না। সে চায় ডাল-ভাতের সুখ। এটাই হলো থিয়োরি অব লিমিটেড গুড। সীমিত মঙ্গলই তার কাম্য। বাংলাদেশের দুর্বৃত্ত পুঁজির দুর্মতি এবং লোভ অন্তহীন। তাই সমাজটা দিনে দিনে অসুখী এবং অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ