শতফুল ফুটতে দাও
একটি অসুস্থ সমাজ অসুস্থ প্রজন্মেরই জন্ম দেয়
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত কয়েকদিনে কিছু ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে।
সমাজবিরোধী এই ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে তারা কিশোর বয়সি। যদি তারা কৈশোরের সীমারেখা অতিক্রম করে থাকে, তাও ১৮ বছর বয়সি একজন শিশুর তুলনায় এরা বড়জোর ২-৪ বছর বেশি বয়সি হবে।
এখন দেখা যাক, কী ঘটেছে? ২৮ জুন একটি পত্রিকার পাতার মাঝামাঝি জায়গায় গুরুত্ব দিয়ে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তার শিরোনাম হলো, ছাত্র ভয়ংকর-শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা। এরপর সংবাদে সারাংশ হিসাবে লেখা হয়েছে, সাভারে কিশোর গ্যাং চালাত দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু এবং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করায় বিভিন্ন সময় শাসন করেন শিক্ষক উৎপল।
সাভারের আশুলিয়ায় চিত্রশাইল এলাকায় শিক্ষার্থীর পিটুনিতে আহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার (৩৫) মারা গেছেন। সোমবার সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গত শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চিত্রশাইল হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে প্রকাশ্যে শিক্ষক উৎপলকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে একই প্রতিষ্ঠানের ১০ম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু (১৬)। উৎপল কুমার ছিলেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি। ১০ বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। শনিবার দুপুরে খেলা চলার সময় মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছিলেন শিক্ষক উৎপল। জিতু অতর্কিতভাবে তার ওপর স্টাম্প দিয়ে হামলা চালায়। মাথা ও স্টাম্পের সুচালু অংশ দিয়ে পেটে উপর্যুপরি আঘাত করে। উৎপলের আর্তচিৎকারে অন্য শিক্ষকরা এগিয়ে এলে জিতু দৌড়ে পালিয়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের বক্তব্য থেকে জানা যায়, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জিতু স্টাম্প দিয়ে শিক্ষক উৎপলকে আঘাত করে। উৎপল শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং ছাড়াও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতেন। অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেছেন, জিতু কেন এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তা বুঝে উঠতে পারছি না। এ ঘটনার পর অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারী আতঙ্কে আছেন।
এমন ভয়ংকর একটি ঘটনা কী করে ঘটতে পেরেছে এবং এর কোনো আদি ইতিহাস আছে কিনা যা দিয়ে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। শিক্ষক উৎপলের ওপর কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং তার সহকর্মীদের আস্থা ছিল বলেই তাকে শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি আমরা দেখছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৫৫ জন শিক্ষক-কর্মচারী আতঙ্কে রয়েছেন। তাদের আতঙ্কের কারণটি কী তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ বছর বয়সি একজন ছাত্র কেন ৫৫ জন শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য আতঙ্কের উৎস হয়ে উঠল সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এই সংবাদ থেকে জানা যায়, দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু কিশোর গ্যাং চালাত।
কিশোর গ্যাংয়ের সমস্যা বাংলাদেশের অপরাধ চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কেবল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের সমস্যা মোকাবিলা করা যাবে না। জিতুর বয়স যদি ১৬ হয়, তাহলে তার অনুসারীদের বয়স কত হতে পারে? আন্দাজ করা যায় তারাও ১৫-১৬ বছর বয়সি। সমাজতত্ত্বে এই বয়সের অপরাধকে জুভেনাইল ডেলিনকুয়েন্সি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বয়সের অপরাধীদের আইন শাস্ত্রেও বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। একজন সাধারণ অপরাধী কোনো অপরাধের জন্য যে শাস্তি পায় সেখানে কিশোর অপরাধীরা তুলনামূলকভাবে কম দণ্ডে দণ্ডিত হয়। এসব অপরাধীকে ভিন্ন ধরনের কারাগার অথবা সংশোধনাগারে বন্দি থেকে প্রাপ্ত দণ্ডের বছরগুলো অতিবাহিত করতে হয়। বাংলাদেশে দু-চারটি সংশোধনাগার থাকলেও সেগুলো মানসম্মত নয়। এগুলোর ভেতরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। এই দুর্বলতার পেছনে রয়েছে দুর্নীতি। কিশোর অপরাধীদের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে থাকে ভিন্ন এক রকম ইতিহাস। যারা কিশোর বয়সেই অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে, আমাদের দেখতে হবে তাদের পারিবারিক অবস্থা। পরিবারের ভেতরকার সমস্যাগুলো সেই পরিবারের কিশোর সন্তানটিকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি দেখা যায় কিশোরটির পিতা-মাতার মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব রয়েছে, তাহলে কিশোর সন্তানটি মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে উঠবে। সে যদি দেখতে পায় তার বাবা ও মা প্রতিনিয়ত ঝগড়া করছেন এবং একে অপরের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যও করছেন, তাহলে কিশোরটি এ থেকে নেতিবাচক চিন্তাভাবনায় আক্রান্ত হবে। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারপ্রধান তার কোনো একটি সন্তানকে অন্য সন্তানগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শাসন করছেন, তাহলে সেই সন্তানটি হয়ে উঠতে পারে দুর্বিনীত ও উচ্ছৃঙ্খল। অনেক সময় দেখা যায় পিতা-মাতারা তাদের সন্তানের কোনো একটি অগ্রহণযোগ্য আচরণের জন্য যত কঠোরভাবে নিন্দা করছেন, তার তুলনায় ভালো একটি কাজের জন্য কাঙ্ক্ষিত প্রশংসা করছেন না, তাহলেও এই সন্তানটি পরিবারের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করতে পারে।
আমাদের দেশে প্যারেন্টিংয়ের বিষয়গুলো খুবই অবহেলিত। পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে কীভাবে গড়ে তুলবেন একজন চমৎকার মানুষ হিসাবে, সেজন্য পিতা-মাতাকে সঠিক প্যারেন্টিংয়ের কৌশলগুলো আয়ত্ত করতে হবে। আমাদের সমাজ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। কেউ যদি বিভিন্ন প্রজন্মের সন্তানদের সঙ্গে তাদের পিতা-মাতার সম্পর্ক পরীক্ষা করে দেখেন, তাহলে দেখা যাবে অতীতের প্রজন্মে পিতার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক সহজ ছিল না। আজকাল শিক্ষিত পিতা-মাতারা সন্তানদের সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে চলেন। তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করেন তাদের আবদার রক্ষা করতে। সমুদয় আবদার রক্ষা করা অনেক সময় উলটো ফল দেয়। দেখা যাবে আবদারগুলো ক্রমান্বয়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ তার এক লেখায় জনৈক পরিবারপ্রধানের অর্থবিত্ত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, এই বিপুল ধন-সম্পদ অধস্তন তিন পুরুষকে অধঃপতনে নিতে যথেষ্ট। তাই সামর্থ্য থাকলেও সন্তানের সব আবদার রক্ষা করা সমীচীন নয়। সন্তানকে প্রকৃতই মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য পিতা-মাতা তার সন্তানের কোন আবদারটি গ্রহণযোগ্য নয়, তা বুঝিয়ে বলবেন।
আমাদের সমাজে গরিব-ধনীদের মধ্যে বৈষম্যের ফলে সামাজিক বন্ধনগুলো আলগা হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে খুব সাধারণ একটি দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে কেন কোনো স্কুলে পড়া শিশুর মধ্যে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স দানা বাঁধে। স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে সবাই যখন এক জায়গায় বসে টিফিন বক্সগুলো খোলে, তখন দেখা যায় কোনো কোনো শিশু অন্য শিশুকে বলতে শুরু করে, তোমার মা তোমাকে কী টিফিন দিয়েছে? এই টিফিনে কি কারও ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়? ধনীর সন্তানদের এ ধরনের মন্তব্য মধ্যবিত্ত বা নিুমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে তাদের পিতা-মাতার সামর্থ্য সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। প্রায়ই এ ধনের মন্তব্য শুনে মধ্যবিত্তের সন্তানরা ভাবতে শুরু করে এই সমাজে তারা অপাঙ্ক্তেয়। আমরা যখন ছোটবেলায় স্কুলে পড়তাম, তখন স্কুল থেকে আমাদের টিফিন দেওয়া হতো। টিফিনের জন্য আমাদের ৩-৪ টাকা টিফিন ফি হিসাবে স্কুলকে দিত হতো। এর বিনিময়ে যে টিফিন দেওয়া হতো তা ছিল সবার জন্য একরকম। ফলে টিফিন নিয়ে কোনো ছাত্র অন্য ছাত্রকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারত না। এখন বেসরকারিকরণের যুগ। যৌথভাবে অথবা যূথবদ্ধভাবে জীবনযাপনের ঐতিহ্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। সে কারণে এখন শিশুরা যার যার নিজের বাসা থেকেই টিফিন নিয়ে যায়।
সমাজের দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের মানতে হবে যৌথ ব্যবস্থার স্থলে ব্যক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা সমাজটাকে ভঙ্গুর করে ফেলছে। আমাদের ছোটবেলায় আমরা পায়ে হেঁটে স্কুলে গেছি। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে পিতা-মাতারা দুশ্চিন্তা করতেন না। কারণ রাজপথে এত যন্ত্রচালিত যান তখন ছিল না। এখন অনেক পরিবারেরই ব্যক্তিগত গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি বিভিন্ন মডেলের। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, যেসব শিশু রিকশায় স্কুলে যায় অথবা পায়ে হেঁটে যায় তাদের হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। কারণ তাদের পিতা-মাতার গাড়ি নেই। আবার অন্যদিকে যাদের গাড়ি আছে, তাদেরও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় পড়তে হয়। কারোর গাড়ি কোটি টাকা দামের আর কারোর গাড়ি কয়েক লাখ টাকা দামের। এভাবে নানাবিধ কারণে স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীরা মন-মানসিকতার দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
যে কিশোররা আজকাল কিশোর গ্যাং তৈরি করছে, তাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক জীবনের ওপর স্টাডি করলে দেখা যাবে তারা মানসিক সুস্থতা না থাকার ফলে সমাজজীবনে অসুস্থ ও অগ্রহণযোগ্য আচরণ করে। এসব কথা বলে আমি কিশোর অপরাধীদের জন্য সহানুভূতি কামনা করছি না। তাদের অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে তাদের যথাযথ দণ্ড দিতে হবে। একইসঙ্গে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ, সেসব শিশু-কিশোরের জন্য প্রয়োজন মনের চিকিৎসা। এই চিকিৎসা সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের ভেতরেই হতে পারে। যদি দেখা যায় দণ্ড ভোগকারী শিশু-কিশোর মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং অনুতপ্তবোধ করছে, তাহলে তাদের পূর্ণ কারাদণ্ড ভোগের আগেই মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি অসুস্থ সমাজ অসুস্থ প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে। জিতু তার শিক্ষককে হত্যা করেছে। ১৬ বছর বয়সি জিতুকে জীবনের পথে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তাকে কিশোর অপরাধী হিসাবে দেখতে হবে এবং একইসঙ্গে কীভাবে তাকে মানুষ করা যায় তার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে হবে। এই সুযোগে সরকার বাহাদুরের প্রতি আমার অনুরোধ-বাংলাদেশের কিশোররা যেভাবে বিপথগামী হচ্ছে, তা রোখার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ও উন্নত পরিবেশসমৃদ্ধ বেশকিছু সংশোধনাগার তৈরি করুন। একইসঙ্গে এগুলোর পরিচালনার জন্য যোগ্য ও দক্ষ ব্যবস্থাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তুলুন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ