Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

চেতনায় বুদ্বুদ

দাওয়াত পেলে তারা যাবেন তো?

Icon

বদিউর রহমান

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দাওয়াত পেলে তারা যাবেন তো?

সরকারি গেজেট অনুসারে ‘পদ্মা সেতু’, আমি বলি ‘শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু’-কারণ শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল আর দুরন্ত সাহসিকতা না থাকলে এ সেতু হতো বলে আমার মনে হয় না।

আমরা দীর্ঘকাল অনেক কিছু মনে রাখি না। বাঙালি সহজে ভুলে যায় এবং চরম অপরাধীকেও আবার সহজে গ্রহণ করে ফেলে। রাজনীতি যখন ‘বাজনীতি’ হয়ে পড়ে, তখন আর ভালো-মন্দের বাছ-বিচার থাকে না বললেই চলে।

তখন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় ‘কাউয়াই’ হোক কিংবা ‘হাইব্রিডই’ হোক, সব একাকার হয়ে যায়। কে আর কার অতীত খোঁজা নিয়ে কত সময় দিতে পারে?

নগদ-নারায়ণের প্রশ্ন এলে তো অন্যসব না-জায়েজ কথাও গুণ হিসাবে গণ্য হয়, তাই না? এই যে লক্ষ্মীপুরে পাপুল এমপি হয়ে যায়, তার স্ত্রীও হয়ে যায়-এটি কীভাবে সম্ভব হলো?

এই যে এক কাপড়ওয়ালাও ঢাকার এক আসনে এমপি হয়ে যায়, তা-ই বা কেমনে হয়? হয়, হতে হয়, না হলে কি আর সংসদে ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য থাকতে পারত? রাজনীতি ‘বাজনীতি’ হলে যা হওয়ার এখন তা-ই হচ্ছে, কেনাবেচায় যে বেশি বেশি লাভ! হালে পদ্মা সেতু আবার রাজনীতির আরেক মহা অস্ত্র হয়ে গেল কিনা ভাববার বিষয়।

রাজনৈতিক দল সরকারে থাকলে অবশ্যই সামরিক সরকার বা অন্য কোনো পদ্ধতির সরকারের থেকে, এমনকি ‘টট্টাবধায়ক’ সরকার হলেও, জনসম্পৃক্ততা বাড়ে।

রাজনৈতিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই বলেই ঘুরেফিরে যত চোর-ডাকাত-হার্মাদই বলা হোক না কেন, আবার রাজনৈতিক সরকারেই আমাদের ভরসা করতে হয়। একমাত্র রাজনৈতিক সরকার থাকলেই বিরোধী দলও চাঙ্গা থাকে। দলীয় সরকারের ক্ষমতাসীন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ওই দলের রাজনীতিকে মহীয়ান করে, বিরোধী দলের সমালোচনাকে ঘায়েল করেই ক্ষমতাসীন দল এগিয়ে যায়। এই যে পদ্মা সেতু নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নানা পয়েন্টে বিষোদগার করে চলেছে, তাতে কি পদ্মার স্রোত বন্ধ হয়েছে, না সেতুর নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে? বিরোধী দলে থাকলে সমালোচনা করতে হয়, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে গলাবাজি করতে হয়, নচেৎ কর্মী-সমর্থক হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তবে লাগামছাড়া অবাস্তব সমালোচনায় হিতে-বিপরীত হতে পারে। পদ্মার পিলার সংখ্যা বেশি বা ঘন ঘন করে টাকা মারার যে সমালোচনা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল করল, তা পিলার কম হলেও হয়তো তারা করত।

আমরা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ে এলএজি স্ট্রংয়ের ‘অন গোয়িং অ্যাব্রড’ শিরোনামে একটা মজাদার প্রবন্ধ পড়েছিলাম। তাতে লেখক একটা উদাহরণ দিয়েছেন যে, আপনি যদি একটা দর্শনীয় স্থানে সকালে ভ্রমণ করে থাকেন, আপনার সমালোচক তখন বলবেন, সকালে ওই স্থানের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ্য হয় না। আবার যদি বিকালে করেছেন বলেন, তখন তো ওই সমালোচক আরও কড়াভাবে বলবেন, আরে ভাই, আপনি তো সকালে ওই স্থানে দর্শনের প্রকৃত মজাই পেতে পারলেন না।

অর্থাৎ আপনার ভ্রমণকে তিনি কোনোভাবেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। পিলার যদি কম হতো, তখন নির্ঘাত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বলত, কম কম পিলার দিয়ে টাকা মেরে দিয়েছে সরকার এবং সেতুকে দুর্বল করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চোখ ঝলসে দেয় বলেই অধিক আলোতে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের আমলের খাম্বা আর খাম্বা দিয়ে বিদ্যুৎ দিতে না পারার সে কাহিনি আমরা ভুলে গেছি নাকি! তখন তো বিদ্যুৎ কখন আসবে তা-ই আমাদের চিন্তার বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ চোখ ধাঁধানো বেশকিছু উন্নয়নে পরবর্তী নির্বাচনে উতরে যাওয়ার যে সুযোগ সৃষ্টি করে ফেলেছে, তা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিকে গর্তে ফেলে দিয়েছে। এ সময় গণতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়েছে, তা-ও ভুলে যাবে মানুষ।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে দাওয়াত দেওয়ার আরেক চমকপ্রদ রাজনীতিও আমরা এখন দেখছি। কী পোড়া কপাল নিয়ে তারা এখন এগোবে? দাওয়াত একেবারে না দিলে তাদের সব কূল রক্ষা পেত। একদিকে আওয়ামী লীগের পদ্মা সেতু নির্মাণের জ্বালা থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল রক্ষা পেত, অন্যদিকে পরে দাওয়াত না পাওয়াকে নতুন সমালোচনার বিষয় করতে পারত। বলতে পারত যে, এ সরকার রাজনৈতিক ভব্যতাও জানে না, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সৌজন্য হিসাবেও দাওয়াত পর্যন্ত দিল না। এখন যেহেতু তারা দাওয়াত পেতে যাচ্ছেন-তারা এখন কী করবেন? কার্টারের ইরানে ব্যর্থ জিম্মি উদ্ধার নিয়ে জহুর হোসেন চৌধুরী তার কলাম ‘দরবার-ই জহুরে’ লিখেছিলেন, ‘কার্টারের অণ্ডকোষ ফাটা বাঁশে আটকাইয়া গিয়াছে।’ তিনি এর দ্বিবিধ অসুবিধার উল্লেখ করেছিলেন। এখন দাওয়াত পাওয়াটাই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্য তেমন অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছে নাকি, তা নিয়ে আমি ভেবে পাচ্ছি না। যদি তারা দাওয়াতে যান, তবে তো পদ্মা সেতু নির্মাণে আওয়ামী লীগের সফলতা স্বীকৃতিতে এসে যায়।

পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এ নিয়ে আর সমালোচনা করবে কীভাবে? আর যদি দাওয়াতে না যান, তাহলে তো জনগণ বুঝেই নিতে পারে যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সত্যি সত্যিই পদ্মা সেতু নির্মাণে অসুখী হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে তাদের জন্য তা আরেক করুণ পরিণতি বয়ে আনবে যে! আর রাজনৈতিক মহানুভবতায় তারা দাওয়াতে গেলেও এর সুফল কিন্তু আওয়ামী লীগই পাবে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নয়। অতএব পদ্মা সেতুর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল থেকে এগিয়ে গেল বলা চলে। আওয়ামী লীগ যদি খালেদা জিয়াকে এ দাওয়াতে হাজির করাতে পারে, তবে তা তো হবে সরকারের জন্য আরেক মহাবিজয়!

আচ্ছা, শেখ হাসিনা হাস্য-রসাত্মকভাবেও যদি ‘চুবানো’র কথা বলে থাকেন, তাতে কি তার অহংকার বা দম্ভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে? এ নিয়ে জনগণের কৌতূহল আছে বৈকি। যদি তা তার অহংকারের সামান্যতমও প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে, তবে বলব, অহংকার পতনের মূল। যদি হাস্য-রসাত্মক ক্ষোভেরও প্রকাশ তাতে থেকে থাকে, তাহলেও বলব, এটি বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মানায়নি, কোনো প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ককে তো নয়ই। তারপরও আমরা বলব, শেখ হাসিনা কথা রেখেছেন। তিনি সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছেন-আমরাও পারি। ব্যয় বেশি হলেও, কিছু যদি এদিক-সেদিক আদৌ হয়েও থাকে, তবুও আমরা বলব-আমরা তো একটি পদ্মা সেতু পেলাম, এটি আমাদের মহাপ্রাপ্তি, আমাদের এক মহাসম্মান। অতএব সালাম শেখ হাসিনা, সালাম। এ প্রসঙ্গে আমাদের গ্রামের দক্ষিণ সীমানায় সেই ১৯৭০ সালে ছোট ফেনী নদীর উপর ছোট্ট একটা পুল নির্মাণে তখনকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মোসলেহ উদ্দিন মোক্তারের টাকা মারার সমালোচনার জবাবে তিনি যে চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন, তা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি সিও (ডেভ) থেকে শুরু করে অন্য কাউকে কাউকে কিছু দিয়ে এবং আমি কিছু মেরে শতকরা ২০-২৫ ভাগ টাকা এদিক-সেদিক করেও ফেলি, পুলটা তো করে দিলাম। এখন তো তোদের আর দিগম্বর হয়ে সাঁতরে নদী পার হতে হবে না।’ সে পুলটা এখনো আমরা ব্যবহার করি। এন্ড রেজাল্টে দিনের শেষে ঝুড়িতে আমরা কী পেলাম সেটাই বড় বিবেচ্য।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এখন কী করবে, তা দেখতে আমরা আগ্রহী। আমার মনে হয়, রাজনৈতিকভাবে সামান্যতম কলাকৌশল বুঝে থাকলেও তারা দাওয়াত কবুল করবে। দাওয়াত পেলে খালেদা জিয়ারও যোগদান করা উচিত। তবে আওয়ামী লীগ যদি আরেকটু মহানুভবতা দেখায়, তাহলে কেমন হয়-যদি খালেদা জিয়াকে অথবা তার অসুস্থতা হেতু যোগদান সম্ভব না হলে ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয়? ড. ইউনূসকে দাওয়াত দিতে যেন আওয়ামী লীগ ভুলে না যায়-এ অনুরোধ আমরা কিন্তু করতেই পারি। ‘তুমি অধম, তাই বলে আমি উত্তম হবো না কেন?’

আমরা আশা করব এবং করতে চাই-বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবশ্যই সুমতি হবে, কারণ পদ্মা সেতু আমাদের গর্ব, আমাদের মহাসম্মান।

অবশ্যই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এখন ২৫ জুনের উদ্বোধনের আগেই ভূমিকম্পে পদ্মা সেতু ধসে যাক কিংবা হারিয়ে যাক, তেমন প্রার্থনা আল্লাহর কাছে করবে না। তেমন চিন্তা থেকে থাকলেও আমরা এটি মনে রাখব যে, শকুনের দোয়ায় গরু কিন্তু মরে না। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম