সব সংকটের মূলে দুর্নীতি

ডা. জাহেদ উর রহমান
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে বসানো ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলারের ভেতরে নাকি আছে অতি দুষ্প্রাপ্য ধাতুতে তৈরি মুদ্রা। এ মুদ্রার আছে নানা রকম অলৌকিক গুণ। এটি নাকি আকর্ষণ করে চালকে। এটি থেকে অদ্ভুত আলোর বিচ্ছুরণ হয়, ধাতব মুদ্রা হলেও এটি পানিতে ভাসে। সীমান্ত পিলারের ভেতরে এ ধাতব মুদ্রা থাকে যে বোতলাকৃতি পাত্রের মধ্যে, সেটির নাকি আছে অলৌকিক গুণ-ভেতরে পানি নিলে তা নাকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফুটতে শুরু করে।
ধাতব মুদ্রাটির জন্য অনেক মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরেছেন; কারণ, এটি বিদেশে হাজার কোটি টাকায় বিক্রি হয়। কেউ আবার পেয়েছেন এই তথ্য যে, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা সীমান্ত পিলারের একটি অলৌকিক ধাতব কয়েন কিনতে ৫০ কোটি ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে প্রস্তুত আছে। এমন একটি কয়েন নাকি নাসার ১০০ বছরের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবে।
এতক্ষণ যারা এ দুটি প্যারাগ্রাফ পড়লেন, তারা নিশ্চয়ই এটি বিশ্বাস করেননি। কিন্তু এ কথাগুলো বলে কিছু প্রতারক ব্যাংক কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি ঝানু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ১০ লাখ থেকে শুরু করে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত। সীমান্ত পিলারের নামে প্রতারণা করে মানুষের কাছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় এসেছে। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা বিস্তারিত খবর আমাদের সামনে এনেছে। মজার ব্যাপার, এ ধরনের প্রচারণামূলক ব্যবসা শুধু বাংলাদেশই নয়, ভারতেও হয়েছে।
সীমান্ত পিলারের মতো এমন আরও কিছু ব্যবসার নামে প্রতারণামূলকভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর আমাদের সামনে আসে মাঝেমধ্যেই। কিছু মানুষ যখন এরকম প্রতারকের খপ্পরে পড়ে টাকা হারিয়েছে, তখন সেটার জন্য আমরা শুরুতেই সম্ভবত সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী করে ফেলব না। একটা রাষ্ট্রে প্রতারক তৈরি হওয়া ঠেকানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও এমন একটা ব্যবসা যেটি গোপনে চলে, সেটার মাধ্যমে বোকা কাউকে প্রতারিত করা যেতে পারে। তবে এটি নিশ্চিত এ প্রতারকদের ধরে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া সরকারের জরুরি দায়িত্ব।
কিন্তু সরকারকে প্রাথমিকভাবেও কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই যে, ব্যবসাগুলো প্রকাশ্যে চলে এবং যেগুলোর অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে অনেক মানুষকে ভুগতে হয়।
সম্প্রতি অনুমোদনহীন ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। প্র্রথম তিন দিনের অভিযানেই অল্প কয়েকটি জেলায় এমন অবৈধ প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে এক হাজারের মতো। এখন আমরা জানতে পারছি সারা দেশে বৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মোট সংখ্যা ১২ হাজারের মতো। এর বিপরীতে অবৈধের সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এর প্রমাণও পাওয়া গেল সম্প্রতি। সাভারে বৈধ ক্লিনিকের চেয়ে অবৈধ ক্লিনিক প্রায় তিনগুণ বেশি। ময়মনসিংহেও একই অবস্থার কথা জানা গিয়েছিল।
দেশে যা হয়, শুরুর কয়েক দিনের ঢাকঢোল পেটানোর পর এ সংক্রান্ত খবর স্তিমিত হয়ে গেছে। ঘটনার ঘনঘটা চলে এ দেশে, তাই খবর হারিয়ে যায় খুব দ্রুতই। ক্লিনিক ব্যবসা তো সীমান্ত পিলারের মতো কোনো গোপন ব্যবসা নয়। ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘোষণা দিয়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে। সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, পোস্টার এমনকি টিভিতে বিজ্ঞাপন দেন তারা রোগী আকর্ষণ করার জন্য। অর্থাৎ এ ব্যবসা চলে প্রশাসন এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার একেবারে নাকের ডগায়।
এই যে অনুমোদন থাকা প্রতিষ্ঠান যতগুলো আছে, তার চেয়ে বেশি যে আছে অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান, এই তথ্য কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানত না? তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান এতদিন কী করেছে? কোনো একদিন হঠাৎ করে ঘোষণা দিয়ে ৭২ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে তারপর মাঠে নেমে অভিযান শুরু করা কারও কাছে খুব বীরত্বপূর্ণ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে অন্তত মনে হয়নি। কারণ, কথা ছিল এ অভিযান নিয়মিতভাবে চলবে এবং এ নিয়মিত অভিযানের ফলে হাজার হাজার অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে যেতে পারত না।
একটা দেশের যখন সব সেক্টর কোনো না কোনোভাবে সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে, অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়া হয়ে পড়ে তখন কোনো একটা বিশেষ সেক্টর তার বাইরে থাকবে এটা প্রত্যাশা করা ভুল। আমাদের সামগ্রিক পচন স্পর্শ করার কথা স্বাস্থ্যখাতকেও। করেছেও সেটা। কিন্তু একইসঙ্গে এটিও সত্য, এ খাতের অনিয়ম মানুষের জীবনকে যেভাবে প্রভাবিত করে সেটি অন্য অনেক সেক্টরে হয় না। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রপাতি না থাকার অভিযোগ তো বটেই, আছে ভুয়া চিকিৎসাকর্মী, এমনকি ভুয়া ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা, এমনকি অস্ত্রোপচারের অভিযোগ। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, কিন্তু এটুকু আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার এ ভয়ংকর সব অনিয়মের মাশুল দিতে হয় অসংখ্য মানুষকে।
এবার আসা যাক সাম্প্রতিককালের আলোচিত সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়। ঘটনার কয়েকদিন পর এখন এটি আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট, সেই কারখানায় মারাত্মক রাসায়নিক হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মজুত ছিল। এবং অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা সেই তথ্য না জানায় পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন। এতেই এ অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণ ভয়ংকর পর্যায়ে গেছে। যাতে অন্তত ১১ জন অগ্নিনির্বাপণ কর্মীসহ মারা গেলেন প্রায় ৫০ জন মানুষ। দেশের আর সব বীভৎস দুর্ঘটনার পর যা যা ঘটে ঠিক সেসব ঘটেছে এখানেও। সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ টার্মিনালে কেমিক্যাল রাখা হবে এমন অনুমোদন ছিল না। তারা জানান, অনুমোদন থাকলে সেটার জন্য কেমিক্যাল কনটেইনার রাখার জন্য বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা এবং অবকাঠামো তৈরি হতো সেখানে। সেই ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস বিভাগেরও নজরদারি থাকত।
ওদিকে মালিকপক্ষ বলছেন, তাদের কনটেইনার ডিপোতে কোন সব পণ্যের কনটেইনার ঢুকে কিংবা বেরোয় তার কিছুই তারা জানেন না। এ কনটেইনারগুলো কাস্টমসের অনুমোদন নিয়ে ঢোকে এবং বের হয়। তারাই এসব তথ্য জানে। মালিকপক্ষ বলছেন, এ কনটেইনার ডিপোতে যদি রাসায়নিক পদার্থের কনটেইনার থাকে, তাহলে সেটি নিশ্চিতভাবেই কাস্টমসের জানার কথা। তারা প্রশ্ন করছেন, কাস্টমস তাহলে কেন এখানে কেমিক্যাল ঢুকতে দিয়েছেন?
মালিকপক্ষের এ যুক্তির বিরুদ্ধে পালটা যুক্তি হতে পারে কনটেইনার ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পাওয়া গেছে, সেটা রপ্তানির জন্য আনা হয়েছিল এবং সেই কেমিক্যাল তৈরি করা হয়েছিল কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষের মালিকানায় থাকা কেমিক্যাল প্লান্টে। রপ্তানিও করছিলেন তারাই। তাহলে তো তাদের না জানার কোনো কারণ নেই। এত তোলপাড় করা ঘটনাটিতে তাৎক্ষণিক কোনো মামলা হয়নি। এবং শেষ পর্যন্ত যে মামলা হয়েছে, তাতে আসামি হিসাবে মালিকপক্ষের কেউ তো নেই-ই, নেই উচ্চস্তরের কর্মকর্তারাও। মধ্য এবং নিুস্তরের আটজন কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা হয়েছে এবং সেটা হয়েছে আইনের দুর্বল ধারায়।
দেশে কনটেইনার ডিপো এত বড় একটি স্থাপনা তৈরি হওয়া ক্ষেত্রে যদি নিয়ম মানা না হয় অথবা নিয়ম মেনে তৈরি হওয়ার পরও যদি সেই মান পরবর্তী সময়ে ধরে রাখা না হয়, এ সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব সরকারের। শুধুই সরকারের। আমরা অনেকেই জানি, ব্যবসার ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত আছে-ম্যাক্সিমাইজিং প্রফিট। প্রতিটি ব্যবসায়ীর চেষ্টা থাকে তার মুনাফাকে সর্বোচ্চ করার। সেটা করার জন্য এমনকি তারা আইন ও রীতিনীতি ভেঙে সেটা করার চেষ্টা করতে পারেন।
আমাদের মতো ভয়ংকর মাত্রায় না হলেও মুনাফার সর্বোচ্চকরণের জন্য আইন, নিয়ম, প্রবণতা উন্নত বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলোর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরও আছে। সেসব ক্ষেত্রে সরকার রেগুলেটরের ভূমিকা পালন করে এবং আইন ভঙ্গকারীকে দ্রুত শনাক্ত করে শাস্তি প্রদান করে। অত্যন্ত বড় এবং অত্যন্ত ক্ষমতাশালী কোম্পানিও এ রকম শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। যে কারণে একটি বিকশিত পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশের জনগণ বিভিন্ন কোম্পানির অন্যায় থেকে বেঁচে থাকতে পারে, ঠিক তার উলটোটা ঘটে বলেই এ দেশের জনগণ ক্রমাগত মাশুল দেয়। সেসব দেশে সরকার ব্যবসায়ী আর জনগণ দুই পক্ষের খেলায় রেফারির ভূমিকা পালন করে জনগণকে ‘ফাউল’ থেকে রক্ষা করে। আর আমাদের দেশে সরকার রেফারির ভূমিকা পালন তো করেই না, নিষ্ক্রিয়ও থাকে না, রীতিমতো খেলে অতি ধনী ওইসব ব্যবসায়ীর পক্ষে।
সাম্প্রতিককালে ঘটেছে বলে এ দুটি ঘটনাকে নিয়ে আলোচনা করলাম। এ দুটি ঘটনার জায়গায় অন্য যে কোনো রকম অনিয়মকে বসিয়ে দেই, ভেতরের গল্প থেকে যাবে একই।
ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট