রাজা যায়, রাজা আসে। তাতে প্রজাদের অবস্থা কতটা বদলায় জানি না। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, বাসস্থান ইত্যাদি যদি ধরি; কিন্তু মহামুনি মার্কস যাকে বলেন সুপারস্ট্রাকচার বা অধিকাঠামো, তাতে তড়িঘড়ি ব্যস্ততায় নানা পরিবর্তন শুরু করে দেওয়া হয়। ব্যাপার হলো, এগুলোই মানুষের বেশি চোখে পড়ে; মানুষ ভাবে, হ্যাঁ, ওরে বাপ রে বাপ, কী দারুণ দারুণ সব পরিবর্তন হচ্ছে! দেশের ক্ষেত্রে পুরো সংবিধানটাই বদলে যায়। দেশ, অঞ্চল, শহর, রাস্তাঘাট, স্টেশন, বাড়ি ইত্যাদির হাজার হাজার নাম বদলে যায়, আগেকার শাসকদের নানা মূর্তি কোনো একটা ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়, নতুন শাসকদের বা তাদের গুরুদের মূর্তি ওঠে, শাসকের দর্শন বদলে যায়, ড্রেস কোড বদলে যায়, শিক্ষানীতি বাতিল হয়, আগেকার ইতিহাস পুরাণ সব পুনর্লিখিত হতে থাকে, কখনো পুরাণ, গালগল্পকে ইতিহাসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ভারতে এখন তাজমহলে শিবলিঙ্গ খোঁজা হচ্ছে, আর সব মসজিদের নিচে মন্দির। বলা হচ্ছে, কুতুব মিনারও নাকি কার মন্দির ছিল! শাসক দলের এক নেত্রী ইসলামের পয়গম্বরের নামে অনুচিত কথা বলে, আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। আমাদের মতো স্থবির লোকেরা এসব পাগলের কাণ্ড বসে বসে দেখি, কারণ আমরা আট-নয় দশক ধরে অন্যায়ভাবে বেঁচে আছি। পরিবর্তন হয়, পরিবর্জন হয়। হয়েই চলে। কেউ খেয়াল করে, কেউ করে না। কেউ জেনেশুনেও পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারে না। তারা মরে গেলে নতুন প্রজন্ম নতুন শিক্ষা নেয়।
যেমন আমাদের দেশের (ভারত) একটা সংবিধান পেয়েছিলাম আমরা ১৯৫০-এ, স্বাধীনতার তিন বছর পর। তাতে যে দেশের নামটাই বদলে গিয়েছিল, ‘ভারতবর্ষ’কে ফেলে দিয়ে শুধু ‘ভারত’ হয়েছিল, তা কতজন খেয়াল করে? সবাই এখনো বক্তৃতায় ‘ভারতবর্ষ ভারতবর্ষ’ করে চলে। যখন শুনি, ছুটে গিয়ে তাদের গলা ধরে ঝাঁকুনি দিতে ইচ্ছা হয়, বলতে ইচ্ছা হয় যে-ওরে, তোদের ‘ভারতবর্ষ’ আর নেই রে বাপু, এখন শুধুই ন্যাজকাটা ‘ভারত’। ‘বর্ষ’ ছাঁটাই হয়েছে। তেমনি কলকাতায় অনেককেই দেখি এখনো বলে-‘হ্যারিসন রোডের দিকে যাব’ বা ‘রাইটার্স বিল্ডিংয়ে।’ মহাত্মা গান্ধী রোড, মহাকরণ মনে থাকে না। তারা সবাই আমাদের বয়সি হবে, এখন প্রায় বাতিলের দলে এসে পৌঁছেছে। পূর্ব বাংলা থেকে আমাদের মতো উদ্বাস্তুরা এলো দলে দলে, এসে কত পুরোনো জায়গার নাম বদলে দিয়ে দেশপ্রেমিকদের নামে নতুন উপনিবেশ বসাল-চিত্তরঞ্জন কলোনি, বাঘা যতীন, কাটজু নগর, সূর্য সেন, সতীন সেন কলোনি-কত কী। আগের নামগুলো কী ছিল এখন আর কেউ জানে না। স্বাধীনতার পরে যারা জন্মেছে, তারা হয়তো শিখে গেছে-দশমিক হিসাব লিটার, মিটার, পয়সা (আমাদের সময় বলতাম ‘নয়া পয়সা’), সিকি, ছটাক, গজ, মাইল-এসব আর বলা হয় না। কলকাতায় মেট্রো এলো, তো কত পাড়ার নামই বদলে গেল। যা ছিল গড়িয়া বাজার, তা হয়ে গেল কবি নজরুল, যা ছিল বাঁশদ্রোণী, তার নাম বোধহয় হলো সূর্য সেন। ঢাকাতেও তা-ই হবে। এরই নাম হলো ‘পোগোতি’, যা আমাদের বুড়োদের সবসময় পেছনে ফেলে দৌড়াতে থাকে।
২.
সুখের বিষয়, আমাদের প্রজন্ম আর বেশিদিন এ ধরাধাম দূষিত করে বেঁচে থাকবে না। আমাদের আর নতুন করে শিখতে এবং হজম করতে হবে না যে, গোমূত্র পান করলে ক্যানসার সারে, গোদুগ্ধে সোনা আছে, রাবণ রাজার লঙ্কার এয়ারপোর্টে চৌত্রিশ রকমের এরোপ্লেন ছিল, স্টেম সেল প্রযুক্তিতে দুর্যোধনদের মা গান্ধারী শতপুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, পুরুষ ময়ূরের চোখের জল পান করে ময়ূরী ডিম্ব প্রসব করে। এগুলো নিয়ে অ্যাকাডেমিক বিতর্ক চলতেই থাকবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে-সে তাদের মাথাব্যথা, আমরা তার মধ্যে নাক গলাতে যাব না। কিন্তু আমাদের, যতদিন বেঁচে আছি, হয়তো একটু অভ্যস্ত হতেই হবে এলাহাবাদের বদলে প্রয়াগরাজে, বা মোগলসরাইয়ের বদলে দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশনে। যে নতুন শহরের নাম নির্মাতারা দিয়েছিল জ্যোতি বসু নগর, সেটা কীভাবে সেই নাম থেকে বঞ্চিত হলো, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে কিনা তা নিয়েও ভাবব না।
৩.
নতুন প্রশাসক এসে তো সিলেবাসও বদলাবেন। আমাদের মনে আছে, ২০০১ সাল নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (আমরা ইউজিসি হিসাবেই জানতাম) জ্যোতিষচর্চা আর পৌরোহিত্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির মধ্যে আনার চেষ্টা করেছিল। কেউ কেউ শুরুও করেছিল, কারণ অনেক টাকা পাওয়া যাচ্ছিল। পৌরোহিত্য বোধহয় ততটা জমেনি। কারণ তখনকার ইউজিসির অধ্যক্ষ ডা. হরি গৌতমকে আমরা লিখেছিলাম, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা সংসদের তরফে, ‘আচ্ছা স্যার, এই পৌরোহিত্যের কোর্সে মেয়েরা এবং মুসলমানসহ অন্য ধর্মের ছাত্ররা ভর্তি হতে পারবে তো? আর যদি তারা পাশ করেন, তবে হিন্দুদের পুজোয় পৌরোহিত্যে তাদের অধিকার স্বীকৃত হবে তো?’ ডা. গৌতম একটু বিব্রত হয়ে আমাদের লিখেছিলেন যে, বিষয়টা নিয়ে তারা ভাবছেন। তারপর আর বেশি এগোয়নি। কোথাও কোথাও বৈদিক গণিত নাকি চালু হয়েছে। আমি সাহিত্যের লোক, বিষয়টার মর্ম আমি কিছুই বুঝি না। নিশ্চয়ই গণিতজ্ঞ বন্ধুরা বোঝেন।
কিন্তু এক কাণ্ড হলো গত বছর থেকে! তখন কোভিড অতিমারি এসে পরিবর্তনকামীদের কাছে এমন সব সুযোগ এনে হাজির করল যে, লাখো বছরে তা একটা আসে কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। তাই জয়প্রকাশ নারায়ণের নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিষয়ে পাঠ নিষিদ্ধ হলো, রামমনোহর লোহিয়া বাদ গেলেন, রামমোহন রায়ও। তাদের নামের আগে যে ‘রাম’ কথাটা আছে, তা-ও এদের বাঁচাতে পারল না। এখন যে পরিবর্তনেরই সমালোচনা করা হোক, তারা বলবেন, ‘অতিমারির ইমারজেন্সি স্যার, এখন কিছুই বলা যাবে না।’ পরীক্ষা নেওয়া হলো না, আর শতকরা একশ ভাগ পাশ করে গেল কী করে? এক উত্তর-‘অতিমারি, আবার কী করে? এ তো শুধু জাতীয় বিপর্যয় নয়, বিশ্ববিপর্যয়, বোঝেন না স্যার?’ ‘উত্তর প্রদেশের বারো ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ রাধাকৃষ্ণন্ এরা বাদ পড়লেন কেন? দিল্লির ইংরেজিতে মহাশ্বেতা দেবী বাদ পড়লেন কেন?’ ‘এ তো মহা মুশকিল! আবার জিজ্ঞেস করেন কেন? অতিমারি বললাম না!’ ‘আচ্ছা, আমাদের এই কাছের পশ্চিমবঙ্গে সিলেবাস ছাঁটা হচ্ছে দেখলাম, তাতে বামপন্থিদের আন্দোলনের ইতিহাস নাকি বাদ গেছে?’ ‘বামপন্থি? ও, মানে যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুছে গেছে? তাদের ইতিহাস নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে নাকি? আমরা তো সিঙ্গুর আন্দোলনের ইতিহাস রেখেছি! তাতে কি আপনারা সন্তুষ্ট নন?’ ‘পরিবেশও যে বাদ গেল!’ ‘চোপ্! এখন শিল্প আসছে, পরিবেশ এখন রাখুন তো!’ মুখ্যমন্ত্রীর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট হয়েছে, বাংলা একাডেমি পুরস্কার হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য হওয়া হয়েছে। কোনো প্রশ্ন করবেন না।
অতিমারি, অতিমারি! তোমার যে এত বিপুল উপকারিতা আছে নানা লোকের কাছে, তা কে জানত! বাচ্চারা রচনা লিখতে গিয়ে খারাপ জিনিসের উপকারিতার কথাও লেখে, তোমাকে নিয়ে রচনায় তারও ভাবনা রইল না।
পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা