
প্রিন্ট: ০১ মে ২০২৫, ০৫:১৫ এএম
সভ্য পৃথিবীর এই রূপ কি সমর্থনযোগ্য?

সালাহ্ উদ্দিন নাগরী
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
এ পৃথিবীতে ৮০০ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। সব মানুষের মৌলিক জীবনাচরণ মোটামুটি একরকম হলেও জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ও ব্যক্তিভেদে বহুবিধ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
মানুষে মানুষে ভিন্নতা ও চিন্তাভাবনার পার্থক্যের কারণেই হয়তো এ পৃথিবী এত সুন্দর ও ছন্দময়। কিন্তু এ ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য কখনো কখনো মনে হয় সোজা পথে চলছে না। কেউ কেউ তার জীবনাচরণ এমনভাবে সাজাচ্ছে, যাতে অন্যদের চরম বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। তাই কোনো কোনো শিষ্টাচার স্থান, কাল, পাত্রভেদে খেই হারিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।
যেমন ধরুন, আব্রু রক্ষা এবং নিজেকে মার্জিত ও ভদ্রভাবে উপস্থাপনের জন্য মানুষ পোশাক পরে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা সাধারণত ছেঁড়া-ফাটা, পুরোনো ও রঙচটা কাপড়-চোপড় এড়িয়ে চলেন। কিন্তু এখন নতুন কাপড়কে ছিঁড়ে, রঙচটা করে হাল ফ্যাশনের পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কারও কারও কাছে ওসব পোশাকই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ছেঁড়া পোশাক ফ্যাশন হবে কেন? আমাদের মানসিকতা কি সম্মুখপানে যেতে পারছে না?
সভ্যতার চাকা সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয়েছে, ‘আব্রু’ রক্ষার বিষয়টি ততই মাধুর্যমণ্ডিত হয়েছে। আমরা তো আগুনের ব্যবহারহীন কাঁচা মাছ-মাংস খাওয়ার সেই আদিম যুগ বহু আগেই পার করে এসেছি। তখনো তো মানুষ গাছের ছাল-বাকল জড়িয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করত, আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র ও কাপড়-চোপড়ের সহজলভ্যতার এ যুগে আমরা কেন জানি পুরোনো যুগে আবার ফিরে যেতে চাচ্ছি।
পত্রিকায় আরও দেখলাম, শুধু ছেঁড়া-ফাটা কাপড়-চোপড়ই নয়, উন্নত দেশগুলোতে নতুন ফ্যাশন হিসাবে ছেঁড়া-ফাটা জুতা, স্যান্ডেলও বাজারে আসতে শুরু করেছে। ছেঁড়া-ফাটা, পুরোনো জুতা-স্যান্ডেল যেমন হয়, ঠিক তেমনভাবেই সেগুলো বানানো হয়েছে এবং এটাকেই হাল ফ্যাশন বলা হচ্ছে। আসলে আমাদের চিন্তাভাবনাই কেমন যেন উদ্ভট ও আজগুবি আকার ধারণ করছে।
বিদেশের কিছু কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভিন্নতার ছোঁয়া দেওয়া ও নতুনত্বের অংশ ও ফ্যাশন হিসাবে টয়লেটের কমোড, বেসিন এবং নারী-পুরুষের নগ্ন শরীরের আদলে আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ দেখা যায়। খেতে আসা মানুষদের ওইসব পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হয়। এটি কী ধরনের রুচিবোধের পরিচায়ক? এসব দেখলে লজ্জা, ক্ষোভ ও ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে।
ইউরোপ, আমেরিকা এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে হাত দিয়ে কোনো কিছু খাওয়ার প্রচলন নেই। ওইসব দেশে চামচ-কাটাচামচ বা কাঠি দিয়ে খাওয়া-দাওয়া করা হয়। তাই যেসব দেশের মানুষ হাত দিয়ে খাবার খায়, তাদের ওরা একটু ভিন্ন দৃষ্টিতেই দেখে এবং অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে। তাই আমাদের ও আশপাশের দেশের অনেক মানুষ আভিজাত্য প্রকাশে তাদের অনুকরণে বহু আগে থেকেই ছুরি-চামচ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করছেন। কিন্তু যারা চামচ, কাটাচামচ ছাড়া মুখে খাবার তোলে না, তারাই হাত দিয়ে ইয়া ঢাউস ঢাউস বার্গার, স্যান্ডউইচ, পিৎজা খাচ্ছে। ওগুলো গলাধঃকরণ করার সময় ম্যাওনেস, সস মুখের চারদিকে লেপ্টে গিয়ে মুখকে একাকার করে ফেলে। এমনকি সব দাঁত বের না করলে ওসব খাবারে ঠিকভাবে কামড়ও দেওয়া যায় না এবং মুখ-হাঁ করতে গিয়ে চেহারার ব্যাপক বিকৃতি ঘটে। আসলে ওইসব খাবার অন্য মানুষের সামনে এভাবে খাওয়া তাদের শেখানো শিষ্টাচার ও টেবিল ম্যানারের সঙ্গেই খাপ খায় না।
অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেটের ছবি এখন পত্র-পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই আসছে। কেউ কাপড় দিয়ে ঢেকে কেউবা উদোম পেট প্রদর্শন করছে। গর্ভবতীর পেট প্রদর্শন কিন্তু হাল ফ্যাশনের তালিকার নতুন সংযোজন। এগুলো কি প্রদর্শন করার বিষয়? ফ্যাশন উদ্ভাবকদের ঝুলিতে নতুন আর কিছু কি নেই? আমাদের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে নর-নারীর ব্যক্তিগত আরও কত কী যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বেচ্ছায় প্রকাশ করা হবে কে জানে! অথচ সবকিছু প্রদর্শনের জন্য নয়, সবকিছু যদি প্রদর্শিতই হতো, তাহলে মানুষ আজকের এ স্তরে আসতে পারত না। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের ‘প্রাইভেসি’ বা ব্যক্তিগত বিষয় বলে কিছুই থাকবে না, সবই হয়ে যাবে ‘পাবলিক’। আর এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক এবং ছোট-বড়র পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহ-ভালোবাসার বিষয়গুলো হবে তিরোহিত। এর লাগাম টানা দরকার। নতুবা এক সময় হয়তো পুরো সামাজিক কাঠামোই নড়বড়ে হয়ে যাবে।
ইদানীং ‘সাহসী’ শব্দটিকে ভিন্ন একটি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কেউ, বিশেষত কোনো নারী যদি প্রকাশ্যে কোনো রাখঢাক ছাড়া কথাবার্তা বলেন, তাহলে বাহবা দিয়ে বলা হয় তিনি ‘সাহসী’ কথা বলেছেন। একইভাবে একটু ভিন্ন পোশাক পরা ছবি ‘পাবলিক’ করলে ‘সাহসী’ ছবি পোস্ট করার জন্য অভিনন্দন জানানোর হিড়িক পড়ে যায়। বলা হতে থাকে-নারী অবরোধবাসিনী নয়, নারী শৃঙ্খল খুলে বের হয়ে আসতে শিখেছে। ইত্যাকার আরও কত কী! এসব কথার ফুলঝুরির মাধ্যমে আমরা কি নারী জাতির উন্নতি করছি, নাকি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা করছি? নারীকে প্রকৃত অর্থেই সম্মান করতে হবে। নারীই তো আমাদের মা, আমাদের বোন, স্ত্রী, কন্যা। তাদের প্রতি সত্যিকারের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। একইসঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, ‘সাহসী’ শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে কিন্তু ভুল বার্তা যাচ্ছে। এর মধ্যে সাহসের কী আছে? আর এ সাহসে ভর করে কী-ই বা অর্জন করা হচ্ছে? হাজার হাজার বছর ধরে ‘প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধনে’র মাধ্যমে বিশ্ব সভ্যতার আজকের এ অবস্থানে আসা, একে ধরে রাখতে হবে। এ পৃথিবীতে নিজেকে তুলে ধরার অযুত-লক্ষ পথ ও পদ্ধতি আমাদের অপেক্ষায় আছে। সমাজের সুধীজনদের শুধু কাণ্ডারি হয়ে অন্যদের এর দিশা দিতে হবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর টয়লেটে সাধারণত পানির কোনো ব্যবস্থা থাকে না। ওরা টিস্যু পেপার দিয়ে শৌচকর্ম সম্পন্ন করে। আমরা তো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ আরও বহুবিধ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীজুড়ে তৎপরতা চালাচ্ছি। কিন্তু পানির বদলে টিস্যু পেপার ব্যবহারে পরিষ্কার-পরিছন্নতা নিশ্চিত করা যায়-এ ব্যবস্থার প্রবর্তকদের কাছে তেমন কোনো স্টাডি কি আছে? আমি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই, সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয়, এটি সম্ভব নয়। এখন তো পৃথিবীজুড়ে মানুষের বিচরণ বেড়েছে, এ ব্যাপারে পানি ব্যবহারকারীরা ভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই পানির বদলে টিস্যু পেপার ব্যবহারে যদি কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে বিষয়গুলো স্পষ্টীকরণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই যাচ্ছে।
ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বে নারীতে নারীতে, পুরুষে পুরুষে বিয়ে হচ্ছে, একজন স্বামী সাজছে, অন্যজন স্ত্রী। তারা বছরের পর বছর একসঙ্গে থাকছে। বাস্তবতা বিবেচনায় এ ধরনের ব্যবস্থা কতটুকু যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত? পৃথিবীতে মানবধারা অক্ষুণ্ন রাখতে এ ধরনের ব্যবস্থা কি কোনো অবদান রাখতে পারে? মনে হচ্ছে, সমাজস্বীকৃত নয় এমন আচার-আচরণ, প্রথা ও ব্যবস্থাকে জোর করে স্বাগত জানানো ও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সভ্যতা রক্ষায় এটা কি সহায়ক? কোনো ধর্মই তো এসব সমর্থন করে না এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও অনুমোদনযোগ্য নয়। সবাই যদি এ ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চায়, তাহলে কি এ পৃথিবী টিকবে?
কুকুর ও অন্য পোষা প্রাণী নিয়েও আমাদের আদিখ্যেতা অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। অঞ্চল, বর্ণ, ভাষা ও কৃষ্টিভেদে মানুষে মানুষে বৈচিত্র্য উদ্ভূত সৌন্দর্য আজ প্রশ্নবিদ্ধ এবং এর সর্বজনীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এ বিষয়গুলোকে সমন্বয় করার জন্য বিশ্বের কোথাও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা জানা নেই। সমাজ, বিশ্বসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বীকৃতিহীন বহু কাজকে আমরা আধুনিকতা আর ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। এগুলো নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে ভাবতে হবে।
আমরা তো প্রতিনিয়ত সভ্য হচ্ছি! শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী (মধ্যযুগ) সুদীর্ঘ সময়কালকে অন্ধকার, বর্বর ও কুৎসিত বলে অভিহিত করছি। কিন্তু আমরা এখন এমন যুগে প্রবেশ করেছি, যা আমাদের রুচিবোধ, নীতি-নৈতিকতাকে আহত করছে। মন-মননকে উন্নতির কোন্ জায়গায় নিয়ে এসেছি যে, অশোভন বিষয়কে জীবনের অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলতে হচ্ছে। এগুলো কিন্তু সভ্যতার চাকাকে যোজন যোজন মাইল পেছনে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। আমরা কি ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে ভুলে গেছি? আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা, সর্বোপরি জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শালীনতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখনকার বিশ্ববাসীকে কোনো এক সময় পথহারা মানবগোষ্ঠী বলেও ঠাহর করে বসতে পারে।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী
snagari2012@gmail.com