শতফুল ফুটতে দাও
বাজেটে সুচিন্তার প্রতিফলন থাকতে হবে
ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ০২ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট অর্থমন্ত্রী আগামী ৯ জুন সংসদে উত্থাপন করবেন। এবারের বাজেট পেশ করা হচ্ছে বিশেষ প্রেক্ষাপটে।
করোনা মহামারি এবং ইউক্রেনে-রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে। করোনা মহামারি যখন প্রবল রূপে দেখা দেয়, তখন দেশে দেশে কলকারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বহু শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়। করোনার ফলে যে বেকারত্ব সৃষ্টি হয় তাতে আয়-উৎপাদন সংকুচিত হয়ে যায়।
বহু দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকোচনের ফলে কর্মসংস্থানজনিত আয় হ্রাস পায় এবং অনেক দেশের জিডিপি হ্রাস পায়। এ ছাড়া অনেক দেশ করোনা মহামারি প্রতিরোধ করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ করোনা ভ্যাকসিন কেনার জন্য ব্যয় করতে বাধ্য হয়। ভ্যাকসিনের জন্য অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অন্যান্য খাতে ব্যয় হ্রাস করতে হয়, এমনকি বেশ কিছু খাতে অর্থ বরাদ্দ থামিয়ে দিতে হয়।
করোনার ঘোর সংক্রমণের সময়ে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হয় অথবা বিমান ভ্রমণের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। শ্রীলংকা এ ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। করোনা সংক্রমণ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এবং এগুলোর শিক্ষার্থীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনার ফলে পাঠদানে যে ক্ষতি হয় তা সত্যিকার অর্থে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে খাদ্য সরবরাহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ইউক্রেন সোভিয়েত আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নের খাদ্যভাণ্ডার রূপে পরিচিত ছিল। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়া নয়, বিশ্বের অনেক দেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং এখনো নির্ভরশীল হয়ে আছে। বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করত। যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ইউক্রেন থেকে গম আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা জানিয়েছে, এ বছর বৈশ্বিক পর্যায়ে খাদ্য শস্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল-গমের বাজারদর দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আয় হ্রাস পাওয়া মানুষগুলো প্রয়োজনমতো খাদ্য কিনতে পারছে না।
করোনা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের সচেতন ও সাবধান হতে শিক্ষা দিয়েছে। ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা মানুষ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তবে কোনো না কোনো বিপদ দেখা দিতে পারে তা বিবেচনায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বাজেটে প্রতি বছর জানা-অজানা ঝুঁকি মাথায় রেখে বিশেষ বরাদ্দ রাখা সমীচীন হবে।
বাজেট পেশের সময় ঘনিয়ে এলে বিভিন্ন স্বার্থ অন্বেষণকারী গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে। তারা তাদের স্বার্থানুকূলে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে চায়। এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো পোশাক শিল্পমালিকরা।
অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোও তৎপর হয়ে উঠছে। তারা তাদের স্বার্থ পাহারা দিয়ে নিরাপদ করতে চায়। অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা বণিক বার্তা ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা নিয়ে ৩১ মে ২০২২ একটি বিশেষ সাপ্লিমেন্ট প্রকাশ করেছে। এই সাপ্লিমেন্ট থেকে উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা সম্পর্কে জানা যায়। মহামারিতে দেশের উদ্যোক্তাদের দাবি করোনা মহামারিতে দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর অন্যতম হলো পর্যটন। উদ্যোক্তাদের দাবি, পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেকটাই পেছনে পড়েছে খাতটি। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মতো একটি বিশেষায়িত ব্যাংক চালুর প্রস্তাব করেছেন তারা। উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট ফুয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রয়েছে উচ্চহারে করপোরেট কর, অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ এবং নিরাপত্তা ও উন্নয়ন ফির ওপর আরোপিত ভ্যাটের চাপ। এ অবস্থায় ব্যবসায় টিকে থাকতে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে এভিয়েশন খাতে আরোপিত বিভিন্ন ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো। প্রযুক্তি খাতে বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অন্তত ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বহাল রাখার দাবি সংশ্লিষ্টদের। দেশীয় পণ্যের জন্য বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখা এবং আমদানি হওয়া ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ভ্যাট বাড়াতে বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। সুপারশপের সুবিধা হচ্ছে, এখানে বাজারের সব তথ্য-উপাত্ত সরকারের কাছে থাকবে। এসব তথ্য-উপাত্ত সরকারের বাজেট ঘোষণার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। অর্থনীতিকেও দ্রুত এগিয়ে দেবে এটি। ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট অন্তত ১/২ শতাংশে কমিয়ে আনা হলে সুপারস্টোর খাতের জন্য টিকে থাকা সহজ হবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপের মতো দেশগুলোয় রপ্তানির বড় সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন গাড়ি উৎপাদন ও সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে নীতি সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ব্যাংকের করপোরেট করহার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। বহুদিন থেকেই ব্যাংকের করপোরেট কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যাংক খাতের উদ্যোক্তারা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার করহার কিছুটা কমিয়েছে। এখনো পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এ করহার অনেক বেশি বলেই মনে করছেন তারা। আসন্ন বাজেটে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার একটা পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ঘোষণার দাবি খাতসংশ্লিষ্টদের। এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা হবে শুধু অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে।
আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির প্রয়োজনে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। তবে কৃষিযন্ত্রের দাম বেশি হলে কৃষকরা কিনতে নিরুৎসাহিত হবেন। ফলে দাম যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে শুল্ক কাঠামোয় পরিবর্তন ও ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি। গবেষণা, উদ্ভাবন, বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন, পোস্ট হারভেস্ট লস কমিয়ে আনতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বরাদ্দ রাখার দাবি জানিয়েছেন কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা। মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুল্ক কমানো না হলে কাঁচামাল সংকটে রডের মূল্য অস্বাভাবিক বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। বাজেটে নির্মাণসামগ্রীর কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রাখার দাবি উঠেছে। ক্লিংকারের ক্রমবর্ধমান দাম এবং ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হয়ে যাওয়ায় সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বহুলাংশে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, যার প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
সিরামিক শিল্পে উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। খাতটিকে সম্পূরক শুল্কের আওতামুক্ত রাখার প্রস্তাব উদ্যোক্তাদের। বড় কোম্পানির জন্য যে আইন, একটি ক্ষুদ্র বা অতিক্ষুদ্র কোম্পানির জন্য একই আইন মেনে চলা সম্ভব হয় না, কোম্পানির আকার অনুযায়ী আইন তৈরির প্রস্তাব আছে প্লাস্টিক খাতের। এলজিপি আমদানির ক্ষেত্রে আড়াই থেকে ৪ শতাংশ হারে অগ্রিম শুল্ক দিতে হয়। অগ্রিম শুল্ক দেওয়ার ফলে কস্ট অব ক্যাপিটালে তার প্রভাব পড়ে। গ্রাহকের কাছে বিক্রির সময় ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। ফলে জ্বালানি পণ্যটির ব্যবহার বাড়াতে শুল্ক-করে ছাড় চাইছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। স্বাস্থ্যসেবায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর সঙ্গে বিভিন্ন কর ও শুল্ক যোগ হয়, যা রোগীর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। তাই শুল্ক-কর কমানোর দাবি খাতসংশ্লিষ্টদের। ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দুই দশকের বেশি সময়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি এপিআই পার্ক। এটির বাস্তবায়ন এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বণিক বার্তার বিশেষ আয়োজন আমাদের বলে দেয় বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্প খাত তাদের দাবি পেশে কতটা সক্রিয়। দেশে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত থাকলে তদসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা চাইবেন তাদের ওপর আরোপ করা হার যাতে হ্রাস করা হয় কিংবা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা হয়। শিশুশিল্প রক্ষণকল্পে এক সময় জার্মান অর্থনীতিবিদরা বলতেন শিল্পের ওপর শুল্কায়নের নীতি হবে-Nurse the baby, rear the child, free the adult. বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা অনেক আগেই বদলে গেছে। নিউলিবারেল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কল্যাণে শিল্পের ওপর কর আরোপে এমন নীতি অনুসৃত হয় যার ফলে শিল্পকারখানাগুলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশও এই নীতির বাইরে অবস্থান করে না। অতীতে পাকিস্তান আমলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে গিয়ে ওঝও বা আমদানি বিকল্পক শিল্পায়নের নীতি অনুসরণ করা হতো। দেশীয় শিল্প সংরক্ষণের নামে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত শিল্পপণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আদায় করা হতো। উচ্চ শুল্ক দেওয়ালের অভ্যন্তরে দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজারে মনোপলি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে এসব শিল্পের ভোক্তারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় তাদের অনেক বেশি দামে পণ্যসামগ্রী কিনতে হতো। বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের নীতির তেমন কোনো স্থান নেই। সরকারকে তার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম চালাতে গিয়ে করের ওপর নির্ভর করতে হয়। সেজন্য সরকার শিল্পের বিভিন্ন স্তরে মূল্য সংযোজন কর আরোপ করে। এ ছাড়াও রয়েছে করপোরেট ট্যাক্স। বাংলাদেশে করপোরেট ট্যাক্সের মাত্রা নিয়ে শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিযোগ রয়েছে। করপোরেট ট্যাক্স কিছু হ্রাস করলে বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে মনে করা সঠিক নয়। করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দিলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি থেকে যে আয় সৃষ্টি হবে, তার ওপর করারোপ করে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনার অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি রয়েছে। বিশেষ করে করজাল বিস্তৃত করে কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু সে অনুযায়ী তেমন কোনো সৃজনশীল উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। যে কারণে কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাজেট প্রণেতাদের গভীর চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে। শিল্পমালিকরা তাদের বাজেটকেন্দ্রিক প্রত্যাশা বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু গ্রামবাংলায় আমাদের মুখের অন্ন উৎপাদনকারী কোটি কোটি কৃষকদের কোনো দাবি জানাতে দেখা যায় না। তাদের কোনো সংঘ, সমিতি নেই। মাঝে মাঝে কৃষক সমিতি নামে কিছু কিছু সংগঠনের কথা শোনা যায়। বাস্তবতা হলো, এসব সংগঠনের সঙ্গে সাধারণ কৃষকের তেমন কোনো সংগঠন নেই। পাকিস্তান আমলে কৃষক সংগঠনগুলো অনেক বেশি তৎপর ছিল। কারণ, সে সময়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য শক্তিশালী কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। আজ মওলানা ভাসানীও নেই, কৃষকদের সুখ-দুঃখ হৃদয়ে ধারণ করার মানুষেরও খুব অভাব। কৃষক যদি অর্থনৈতিকভাবে সচল ও সমৃদ্ধ হয়, তাহলে জাতীয় আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, দেশীয় শিল্প মালিকদের বাজার সম্প্রসারিত হবে, মুনাফাও অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। দেশে পুঁজি গঠনের হারও বৃদ্ধি পাবে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ উন্নত হবে। বাংলাদেশের কৃষকদের এ মুহূর্তে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ফসলের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হওয়া। কৃষকের এই কষ্ট নিরসনের জন্য প্রয়োজন নতুন ধরনের সমবায় সংগঠন। এই সংগঠন খাড়াখাড়ি রূপে গঠিত হবে। সাধারণ সমবায় গড়ে তোলা হয় পাশাপাশিভাবে। সমবায় যদি কৃষকদের নিয়ে উলম্বভাবে গঠিত হয় এবং এর সর্বস্তরের সদস্য যদি নির্বাচিত কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয়, তাহলে বাজারের ওপর কৃষকদের অবস্থান মজবুত হবে। বাস্তবে এই সমবায় গ্রামাঞ্চলে যেসব ফসল উৎপাদিত হয় সেগুলো সংগ্রহকরণ, গুণগত মানের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ, গুদামজাতকরণ ইত্যাদি কাজ প্রাথমিক স্তরে কৃষকরা নিজেরাই করবে। তাদের থাকবে হিমাগার, যানবাহন এবং ওজন মাপার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। বাজার কাঠামো যদি রাজধানী পর্যন্ত তিনটি স্তরের হয়, তাহলে সব স্তরেই কৃষকরা পরিচালন এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। ইউরোপে ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশে এ ধরনের সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে এ ধরনের কৃষক সমবায় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে এবং বাজেটে এর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে। কৃষকস্বার্থ রক্ষাকল্পে কৃষকদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা দিতে হবে।
দেশে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। মানুষের ভোগ্যপণ্যের দাম দেড়গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ৫-৬ শতাংশ থেকে ১১-১২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন। এর পক্ষে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। আগামী দিনে মূল্যস্ফীতির সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠবে বলে অর্থনীতিবিদদের ধারণা। বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতি ঘটছে মন্দাক্রান্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে। মন্দাত্বে উৎপাদন হ্রাস পায়। এর ফলে মুদ্রা সরবরাহ একই থাকলে সংকুচিত পণ্য সরবরাহের মধ্যে মূল্যস্ফীতি অবধারিত। সেজন্য মুদ্রা সরবরাহের প্রতিও দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতি যদি মন্দাক্রান্ত হয়, তাহলে এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষেও স্বস্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। ১৯৩০-এর মন্দায় বাংলাদেশের কৃষকরা অধিকতর দুঃখ-দারিদ্র্যে পতিত হয়েছিল। বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে কৃষকের হাতে তেমন কোনো টাকা পয়সা ছিল না। ফলে কৃষক মহাজনদের ঋণও পরিশোধ করতে পারছিল না। এই প্রেক্ষাপটেই গঠিত হয়েছিল ঋণ সালিশি বোর্ড। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে টাকা ও ডলারের বিনিময় হারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। টাকার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। কর্তৃপক্ষ টাকা ও ডলারের বিনিময় হার বাজারে বিদ্যমান টাকা ও ডলারের বিনিময় হারের কাছাকাছি রাখার চিন্তা-ভাবনা করছে। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রবাসী আয় হুন্ডিতে প্রবেশ করছে। এর ফলে সরকারের হাতে বৈদেশিক মুদ্রা আসার হার কমে গেছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপর চাপ বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কিছুতেই বিপজ্জনক পর্যায়ে হ্রাস পাওয়া প্রতিরোধ করতে হবে। সবরকম বিলাসব্যসনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। প্রতিটি সামাজিক সমস্যা এবং বস্তুত প্রতিটি অর্থনৈতিক সমস্যা শেষ বিচারে আর্থিক সমস্যায় পতিত হয়। আমরা কৃষি ও শিল্পে যে উন্নতি ঘটাতে চাই তার জন্য আমাদের পুঁজি প্রয়োজন। এজন্য আমাদের যন্ত্রপাতি কিনতে হয় যা থেকে ফলোদয় হয় পরবর্তী সময়ে। এই অর্থে পুঁজিবাদ একটি চিরন্তন অর্থনৈতিক পরিভাষা। গণঅর্থনীতি অথবা ব্যক্তিগত অর্থনীতি সর্বত্রই পুঁজির প্রয়োজন। লাভক্ষতির হিসাব-নিকাশও অর্থনীতির দুটি ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। তবে গণঅর্থনীতির ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল প্রোডাকশন এবং মানবসম্পদের অর্থনীতি সম্পর্কে গণঅর্থনীতিতে অনেক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা সম্ভব। একই অর্থনীতির দুটি ধারার মধ্যে পার্থক্য হলো, উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টির ক্ষেত্রের এবং সমাজের স্বার্থে এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ থেকে মুনাফা অর্জনে কিছু এদিক সেদিক করা হয়। তবে এটা নির্ধারিত হয় পরিস্থিতির বিচারে। এটা তেমন কোনো নীতির বিষয় নয় যে এর জন্য সার্বিক সমাধানের প্রয়োজন হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে পুঁজি গঠন এবং সঞ্চয়ন। সমাজের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজস্ব দ্বারা টেকসই গণবিনিয়োগ সামগ্রী নির্মাণ করা এবং উচ্চ ধরনের আঙ্গিক পুঁজি গঠন করা। এসব কারণে রাষ্ট্রীয় পুঁজি এবং মানবসম্পদ একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুটি মৌলিক স্তম্ভ। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে জনসাধারণ-প্রদত্ত করের অর্থ যেন তিল তিল হিসাব করে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজনে বাজেটের গুণগতমান উন্নয়নকল্পে দেখভালের জন্য একটি পৃথক সংস্থা গঠন করা, যে সংস্থা হবে আত্মশাসিত।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ