
প্রিন্ট: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫১ পিএম
শুধু প্রশাসক নয়, দরকার মেধাবী অন্যান্য পেশাজীবীও

খালিদ ফেরদৌস
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির বাজারে ঢোকার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে মানুষ। বলা বাহুল্য, সঠিকভাবে দেশ পরিচালনার জন্য বিসিএস চাকরিতে মেধাবীদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ খুব দরকার। তবে বর্তমানে যে দুর্দমনীয় আগ্রহ-উদ্দীপনা চলছে, তা জাতির জন্য মোটেও সুখকর নয়।
মনে রাখতে হবে, আমাদের সামনে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ। আগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু প্রশাসক নয়; দরকার মেধাবী বিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার। বিসিএস বা প্রশাসনিক চাকরি নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক কথা কারও কারও গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। কেউ কেউ মনে করতে পারে-আঙুর ফল টক।
কিন্তু দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তো একই কথা বলছেন। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক। সেখানে ‘প্রিলিমিনারি পরীক্ষা’, ‘ভাইভা’ ইত্যাদি নামে বিভাগ থাকবে। দারুণ চলবে কিন্তু।’ তার কথার বাস্তব প্রতিফলন চোখে পড়ে উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এখন মৌলিক বই পড়ার শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ভোরবেলা থেকেই চেয়ার-টেবিল দখলের বিশাল ব্যাগের লাইন পড়ে যায়। যদি বলা হয়-বিসিএস বা চাকরির প্রস্তুতির বই পড়া যাবে না লাইব্রেরিতে; তবে হাতেগোনা কয়েকজন পাওয়া যাবে।
আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে আসা এক পর্যটক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীদের ভিড় দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এত লেখাপড়া করে?’ কিন্তু তিনি জানেন না যে তারা গুগল, ইন্টেল, নাসার বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ হতে লেখাপড়া করছে না; তারা লেখাপড়া করছে বিসিএস চাকরিপ্রাপ্তির জন্য।
সত্যিই এ দৃশ্য যদি মৌলিক পাঠ ও গবেষণার জন্য হতো, তাহলে দেশ খুব দ্রুত বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, ইলন মাস্ক কিংবা সুন্দর পিচাইয়ের মতো গুণী লোক খুব দ্রুত পেয়ে যেত। আমরা পাচ্ছি প্রশাসক, সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়া
ইউটিউবার, ফুডব্লগার অথবা ফেসবুক সেলিব্রেটি, যাদের অনেকে দেশের জন্য টিউমারে পরিণত হয়েছে। মেয়েদের চেহারা একটু সুন্দর হলেই নানা কনটেন্ট ইউটিউব বা ফেসবুকে আপলোড দিয়ে হয়ে যাচ্ছে জনপ্রিয় সেলিব্রেটি। হু হু করে বাড়ছে তাদের ফ্যান-ফলোয়ার।
কিছু কিছু ছেলেমেয়ের ইউটিউবে ফুড রিভিউ ও পণ্যের ফেসবুক মার্কেটিং দেখলে মনে হয়, তারা বিশ্বের সেরা কুক বা উপস্থাপক। অথচ তাদের ভাষাজ্ঞান ও উপস্থাপন অত্যন্ত জঘন্য ও অশোভনীয়। তাদের ওভার অ্যাক্টিংয়ের (অতি অভিনয়) কথা না-ই বললাম। অথচ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের পেজে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এ সুযোগ ব্যবহার করে তারা নানা পণ্যের মার্কেটিং করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে।
টাকা ইনকামকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু টাকা যদি ইনকাম হয় মেধাবিবর্জিতভাবে, তবে সেটাতে ঘোরতর বিপত্তি। কারণ, এটি সমাজকে ভুল বার্তা দেয়। এখন উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা ইউটিউব, ফেসবুককেন্দ্রিক সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ হয়তো সফলতা দেখাচ্ছে; কিন্তু তা অত্যন্ত কম সংখ্যায়। এক্ষেত্রে অধিকাংশই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে মাদকাসক্তিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সমাজ এখন একটা ফ্লেভার মাত্র। আর সামাজিক গণমাধ্যম সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনকারীদের কাছে বড্ড অসহায়।
শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন কিছু প্রবর্তন করতে হলে অনেক ভাবনাচিন্তা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অতীব জরুরি। এদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব সহজে শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কোনো রকম বাছবিচার ছাড়া কার্যকর করা হচ্ছে। আমাদের মতো ছোট একটা দেশে নির্বিচারে একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা আত্মঘাতী বলেই সচেতন মহল মনে করছে।
এ বিষয়টিতে সরকারের আরও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে, যেখানে মানসম্মত শিক্ষাবিস্তারে সরকারের দায়বদ্ধতা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, ছাত্রছাত্রীর দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ অনার্স প্রথমবর্ষ ভর্তিসংক্রান্ত একটা সিদ্ধান্ত সবাইকে হতবাক করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা, পরিস্থিতি ও মান বিবেচনায় আকাশচুম্বী করা হয়েছে। এখন থেকে কোনো শিক্ষার্থী ন্যূনতম এসএসসি-এইচএসসির সিজিপিএ ৩.০০ বা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ না হয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এসএসসি ও এইচএসসিতে সিজিপিএ ৩.০০ পেলে তা প্রথম শ্রেণি হিসাবে গণ্য করা হয়। একাডেমিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির রেজাল্ট নিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট, ফরেন ক্যাডারে চাকরি করা যাবে; কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে না। এটি একটি তুঘলকি কাণ্ড ছাড়া কিছু নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি আজব কর্মকাণ্ড-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগেই তারা নতুন ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সার্কুলার দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। বিগত দিনে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলেই শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করত, যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।
এ দু-তিন বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমন কী অর্জন করে ফেলল যে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সবার আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে? এ হঠকারী সিদ্ধান্ত কার স্বার্থে? এটি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে, না বুর্জোয়াদের স্বার্থে? অনেক শিক্ষার্থী ও সচেতন মহলের দাবি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কথা যদি সত্য হয়; তবে জাতির জন্য এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়।
অবশ্য এ ব্যাপারটা প্রধানমন্ত্রীর অগোচরে করা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তাই বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে খতিয়ে দেখা উচিত। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কম খরচে গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের শেষ আশ্রয়স্থল বলে বিবেচিত।
সরকারিভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত নানা উদ্যোগে দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও রেজাল্ট সমৃদ্ধ হয়েছে-এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যারপরনাই প্রশ্ন রয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকল্পে কিছু পদক্ষেপের ব্যাপারে সরকার ভেবে দেখতে পারে। যেমন, শিক্ষা সচিব বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিতে পারে। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার থেকে নিয়োগ দিতে পারে।
এক্ষেত্রে বেসরকারি কলেজের যোগ্য ও দক্ষ অধ্যাপককেও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। দেশের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ ভিন্ন আঙ্গিকের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে এখানে অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগ দিলে নানা জটিলতা তৈরি করে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনেক জ্যেষ্ঠ ও স্বনামধন্য অধ্যাপক চাকরি করেন। অথচ অনেক সময় উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান তাদের তুলনায় অনেক জুনিয়ররা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য বয়সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের অনেক শিক্ষক বা অধ্যাপকের জুনিয়র। এগুলো ইগোগত ও সিনিয়রশিপগত জটিলতা তৈরি করে।
শুধু তাই নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য জাতীয় অনেক বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন না। তিনি একটি নিদিষ্ট সময়ের জন্য উপাচার্য হন। তাই তার ভেতর দায়বদ্ধতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হতেই পারে। অপরদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কোনো কলেজ থেকে যদি উপাচার্য নিয়োগ পান; তবে আশা করা যায়, তিনি নিজের বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে যত্নসহকারে দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে নানা ভালো উদ্যোগ ও কাজ করার প্রচেষ্টা চালাবেন।
আর একটা বিষয় পরিশিষ্ট আকারে উল্লেখ করা যায়, তা হলো-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি। বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত শ্রেণি হয়ে তারা উচ্চশিক্ষা বিস্তারে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু প্রতিদানে তেমন কিছুই পাচ্ছেন না। তাদের অভিভাবকত্ব নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক প্রকার বিকর্ষণগত সম্পর্ক বিদ্যমান।
নিয়োগ, চাকরির স্থায়িত্বকরণ, বেতন-ভাতা প্রদানসহ দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এলেই এক প্রতিষ্ঠান আর এক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়। সরাসরি কাউকে তাদের অভিভাবকত্ব স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত দেখা যায়, যা মোটেও শোভনীয় নয়। এ ধরনের চাপাচাপি বাদ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও প্রদান করাটা সমীচীন বলে মনে হয়।
এ বিষয়গুলো যদি সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সদয় বিবেচনায় নেন, তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ের যে ধারা তৈরি হয়েছে চারপাশে, তা অনেকখানি রোধ করা সম্ভব হবে বলে সচেতন মহল মনে করেন।
খালিদ ফেরদৌস : প্রভাষক, সমাজকর্ম, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ