শতফুল ফুটতে দাও
শিক্ষায় বয়স কোনো বাধা হতে পারে না
ড. মাহবুব উল্লাহ
প্রকাশ: ২৬ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
লেখাপড়ার কি বয়স আছে? আমরা জানি, যতদিন চোখের জ্যোতি এবং শারীরিক সক্ষমতা থাকে ততদিন জ্ঞানসাধকরা বই পড়েন এবং বই লিখেন। এ রকম ঘটনা নিজ চোখে একাধিকবার দেখেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ছিলাম, তখন প্রয়োজন ছিল শতভাগ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা। এর জন্য উত্তম স্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি।
সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য পড়ার টেবিলটি দুই দিকে দৃষ্টি রেখে পড়া যায় এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল। টেবিলের মাঝখানে ছিল একটি কাঠের দেয়াল। এ টেবিলের দুই দিকে দুজন শিক্ষার্থীর পড়ার ব্যবস্থা ছিল। লাইব্রেরির ভেতরকার পরিবেশটি এমন ছিল যে, কেউ কোনোরকম গল্প করত না। সবাই শতভাগ মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করত। সবাই যখন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে তখন আমার মনোযোগ ভিন্ন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার তাড়নাবোধ করত না।
ক্ষুধা পেলে নিচতলায় ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে হালকা কিছু খাওয়ার সুবিধা ছিল। তবে লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়ে বিশেষ প্রয়োজন বোধ করতাম চা কিংবা কফির। ক্যাফেটেরিয়া থেকে ডিসপোজেবল কনটেইনারে চা কিংবা কফি নিয়ে পড়ার টেবিলে বসা যেত। কিছুক্ষণ পরপর পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ডিসপোজেবল কনটেইনারগুলো ঝুড়িতে সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসত।
একদিন লক্ষ করলাম, ৮০ বছরেরও ঊর্ধ্ববয়সি একজন নারী আমার কাছের টেবিলটিতে পড়াশোনা করছিলেন। বয়সের কারণে তার চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল। আমি আমার কৌতূহল দমন করতে পারছিলাম না। ওই মহিলার কাছ থেকে অনধিকার চর্চার জন্য ভর্ৎসনার শিকার হতে পারি বুঝেও আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এই বয়সে এ লাইব্রেরিতে কেন পড়তে এলেন?
মহিলা আনন্দচিত্তে আমার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে বললেন, আমি পিএইচডি ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছি। আমি এখনো কর্মক্ষম, যদিও আমার বয়স অনেক আগেই ৮০ বছর অতিক্রম করেছে। মহিলা আরও বললেন, বার্ধ্যক্যের একাকিত্ব ঘোচাতে এবং অর্থবহ কিছু কাজ করে আনন্দ লাভের জন্যই এখন আমি পিএইচডির কাজ করছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আশির দশকের শেষ দিকে দিল্লিতে গিয়েছিলেন আফ্রো-এশীয় সংহতি সংস্থার এক সেমিনারে।
তার আগমনের খবর পেয়ে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ছুটে গেলাম তার হোটেলে। সেই সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রফেসর। তিনি ছিলেন নবতিপর একজন মানুষ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাকে জানালেন, এই প্রফেসর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর তখন পর্যন্ত ২৪ খণ্ড রচনা শেষ করেছেন। তিনি আরও ছয় খণ্ড রচনার কাজ করছিলেন।
নবতিপর এই প্রফেসরের নাম আমি স্মরণ করতে পারছি না। নবতিপর এই প্রফেসর তার কোমর নব্বই ডিগ্রি বাঁকিয়ে হাঁটছিলেন। হাতে অবশ্য একটি লাঠি ছিল। বয়সের কারণে তিনি বাঁকা হয়ে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার মুখমণ্ডল ছিল সজীব এবং আলাপ-আলোচনায় তিনি ছিলেন সপ্রতিভ। এমআইটির প্রফেসর নোয়াম চমস্কির অনেক বয়স হয়েছে।
ইদানীংকালে ইউটিউবে প্রফেসর নোয়াম চমস্কির বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা শোনা ও দেখা যায়। মন ও মেধা শক্তির দিক থেকে তিনি বেশ সজীব। চমস্কি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। শেষ বয়সে এসে তার চিন্তাভাবনা উঠে আসে আলাপচারিতার মাধ্যমে। তার আলাপ-আলোচনাগুলো রেকর্ড করে রাখেন তার গুণমুগ্ধ ব্যক্তিরা। তার রেকর্ড করা কথাগুলো পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্মুক্ত সমাজে চমস্কিকে তার লেখাজোখার জন্য বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। নামকরা পাবলিশিং হাউজগুলো তার লেখা ছাপাতে চায় না। কারণ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির একজন কড়া সমালোচক। বিশ্ব পরিসরে তিনি একজন বিশিষ্ট পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। চমস্কি তার এক লেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত বনেদি পাবলিশাররা তার বই ছাপাতে চায় না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ যেন বাংলাদেশ, যেখানে একটি বিশেষ দেশের অনুরাগী না হলে কারোর পক্ষে বুদ্ধিজীবী পরিচয় পাওয়া বেশ কঠিন।
প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর নির্ভর করে ৫৫ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন বেলায়েত শেখ। খবরের কাগজে পড়লাম, বেলায়েতকে মার্কিন দূতাবাস শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বেলায়েত শেখের প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস।
গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বেলায়েত শেখকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। এতে বলা হয়, বেলায়েত শেখের মতো যেসব বয়স্ক শিক্ষার্থী স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত হননি এবং বিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুভেচ্ছা জানায়।
বেলায়েত তিন সন্তানের জনক। আগামী ১১ জুন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে তিনি উচ্চশিক্ষার পথে হাঁটতে পারেননি। মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পেজে দেওয়া পোস্টে বলা হয়, গাজীপুরের মাওনার বেলায়েত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা এবং সামাজিক রীতিবহির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেননি। গত বছর তিনি এইচএসসি পাস করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা চালানোর জন্য অযৌক্তিক প্রতিবন্ধকতা নেই বললেই চলে। সেসব দেশে পদার্থবিদ্যা পড়লেও অর্থনীতিতে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে সাধারণভাবে কোনো বাধা নেই।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জে. আর. হিকস পদার্থবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অকৃতকার্য হন। এরপর তিনি অর্থনীতিতে পড়াশোনা করলেন এবং নোবেল প্রাইজও পেলেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড অর্থনীতি পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। পরবর্তীকালে তিনি পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেন এবং একই বিষয়ে নোবেল প্রাইজও পান।
আমি পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিতের কথা জানি, যারা কোনো একটি বিষয়ের শিক্ষার্থী হলেও অন্য একটি বিষয়ে পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ মেধার পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এমন সব বাধার বিন্ধ্যাচল রয়েছে যার জন্য একজন মানুষ তার প্রতিভা ও মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে না।
জ্ঞানের রাজ্য তখনই সমৃদ্ধ হয়, যখন প্রতিভা ও মেধার মধ্যে মুক্ত প্রতিযোগিতার সুযোগ থাকে। উচ্চশিক্ষার পথে বিভিন্ন কায়দায় রোড ব্লক স্থাপন করে শিক্ষাটাকেই অর্থহীন করে ফেলা হচ্ছে। জানি না কবে এ দেশে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা প্রতিবন্ধকতামুক্ত হবে।
ড. মাহববু উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ