Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

‘কিশোর অপরাধ সমাজতত্ত্ব’ নিয়ে গবেষণা কোথায়?

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘কিশোর অপরাধ সমাজতত্ত্ব’ নিয়ে গবেষণা কোথায়?

৭-৮ বছর আগেও কিশোর গ্যাংয়ের কথা শোনা যায়নি। এ সময়টার মধ্যেই এদেশের অপরাধ জগতে কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাব ঘটেছে।

এরা যেসব অপরাধ করে তা কার স্বার্থে করছে এবং এর ফলে কী অর্জন হবে, তা তারাও সুস্পষ্টভাবে জানে না। তবে তারা যেসব অপরাধ করে তার জন্য প্রয়োজন হয় দুর্দান্ত সাহস।

তারা মনে মনে ভাবে, যেসব এলাকায় তাদের বাস সে এলাকাগুলো একান্তভাবেই তাদের সাম্রাজ্য। বাংলাদেশের অপরাধ জগতে কিশোর গ্যাংয়ের আবির্ভাব নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যেসব কিশোর একেকটি গ্যাং তৈরি করছে, তাদের বয়স সাধারণ কিশোরদের মতোই।

মনোবিজ্ঞানীরা বহু বছর আগেই বলেছেন কিশোর বয়সটা খুবই সংবেদনশীল। এই বয়সে যাকে সাধারণত বয়োসন্ধিকাল বলা হয়, সেই বয়সটা তার অন্তর্নিহিত শক্তির চরম বিকাশে উদ্যোগী হয়। বোঝা যাচ্ছে সমস্যাটির মূল কোথায়? সমস্যাটির মূলে রয়েছে কিশোর মনে দুর্দান্ত শক্তির অভিব্যক্তি ঘটানোর তাড়না। এই শক্তি এমন যে তা দিয়ে যেমন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার প্রয়াস সৃষ্টি হয়, ঠিক একইভাবে ভালো কিছু করারও সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে।

বিংশ শতাব্দীতে গুরুসদয় দত্ত ‘ব্রতচারী’ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। এই আন্দোলনে তৎকালীন বঙ্গদেশের কিশোররা প্রবল উৎসাহে যোগ দিয়েছিল। গুরুসদয় দত্ত ছিলেন একজন সিভিল সার্ভেন্ট। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার উচ্চপদে অবস্থান সত্ত্বেও ব্রিটিশ শাসকরা গুরুসদয় দত্তের এই আন্দোলনকে একটি মঙ্গলকর আন্দোলন হিসাবেই গ্রহণ করেছিল। ‘ব্রতচারী’ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল, জ-সো-বা। এই স্লোগানটির পরিপূর্ণ প্রকাশ ছিল, ‘জয় সোনার বাংলা।’ ব্রতচারীরা নানা ধরনের শারীরিক ব্যয়ামের কসরত করত। বঙ্গদেশের নৃত্য-সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছিল একটি ভিন্ন ধরনের নৃত্য, যাকে বলা হতো ব্রতচারী নৃত্য। যারা গুরুসদয় দত্তের এ আন্দোলনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা বলতে চেয়েছেন বঙ্গদেশে ব্রতচারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল কিশোর ও তরুণদের ব্রিটিশবিরোধী যুগান্তর ও অনুশীলন দলের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা। শিশু মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, চিলড্রেন্স মাসেল ক্রাই ফর অ্যান অ্যাকশন।

শিশু যখন কথা বলতে শিখে না, তখনো সে তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে এক ধরনের চাওয়া পাওয়ার জন্য কমিউনিকেশন গড়ে তোলে। শিশু যখন কান্না করে এবং হাত-পা ছুড়তে থাকে তার মধ্য দিয়ে শিশু তার চাহিদা জানান দেয়। কথা বলতে শুরু করার পর শিশুরা বড়দের তার চাহিদা সম্পর্কে স্পষ্টতর ভাষায় জানান দিতে পারে। একইভাবে কিশোররাও তার শক্তির মাহাত্ম্য জানান দিতে চায়। অভিভাবক ও আত্মীয়স্বজনদের কর্তব্য হলো কিশোরদের শক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশে এখন ব্রতচারী আন্দোলনের মতো কোনো আন্দোলন নেই। একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে একজন গুরুসদয় দত্তকেও চোখে পড়ছে না। তেমন কোনো ব্যক্তিত্ব সমাজে সক্রিয় হলে তাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সন্দেহের চোখে কেউ দেখবে না। বরঞ্চ এই ধরনের আন্দোলনকে কল্যাণকর আন্দোলন হিসাবেই বিবেচনা করবে। অনেকেই হয়তো জানেন না যে শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান ব্রতচারী আন্দোলনে বেশ কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। ব্রতচারী আন্দোলনের সুবাদে তিনি নিয়মিত ব্যয়াম করতেন। এর ফলে তার পেশিগুলো সুগঠিত হয়েছিল। ব্রতচারী আন্দোলন প্রধানত শারীরিক কসরতের ওপর জোর দিয়েছিল। এসব শারীরিক কসরত একক এবং দলগতভাবে চর্চা করা হতো। মাঠে-ময়দানে ব্রতচারীর কসরতগুলো করতে গিয়ে স্বদেশপ্রীতির বাক্য উচ্চারিত হতো। যেমনটি আমরা দেখি জ-সো-বা স্লোগানের মধ্যে। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকাটি বিপুলসংখ্যক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়ে উঠেছিল। এই পত্রিকাটি মুকুলের মাহফিল নামে শিশু-কিশোরদের জন্য একটি নিয়মিত বিভাগ চালু করেছিল। এই বিভাগে শিশু-কিশোররা গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখত। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা ছাপার অক্ষরে তাদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেখলে স্বর্গীয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠত। শিশু-কিশোরদের মধ্যে নিহিত এ সক্ষমতা আরও ভালো কিছু করার জন্য প্রেরণা জোগাতো।

মুকুলের মাহফিলের একটি লক্ষ্য ছিল শিশু-কিশোরদের শরীর চর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। এর জন্য গঠিত হয়েছিল মুকুল ফৌজ। দেশে এখন অনেক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দুঃখের বিষয় এসব পত্রিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশু-কিশোরদের টার্গেট করে উল্লেখযোগ্য কোনো বিভাগ চালায় না।

অতীতে দু-চারটি পত্রিকা শিশু-কিশোরদের জন্য নিয়মিত বিভাগ চালু রাখলেও পরবর্তীকালে কেন এই বিভাগটি আর চালাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণায় ব্রতী এ পত্রিকাগুলো মুনাফার দোহাই দিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটি বন্ধ করে দিয়েছে।

১৭ মে মঙ্গলবার একটি দৈনিক শেষের পাতায় একটি রিপোর্ট ছাপিয়েছে যার শিরোনাম হলো, ‘নারায়ণগঞ্জে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং/হামলায় দু’দিনে আহত ৫। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীরা। ধারালো অস্ত্র হাতে দলবেঁধে চলা, পথিমধ্যে প্রকাশ্যে কাউকে কুপিয়ে জখম করা তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তেমন সরব দেখা যায় না।

নারায়ণগঞ্জের পাড়া-মহল্লা, অলি-গলিতে গড়ে উঠছে একের পর এক কিশোর গ্যাং। অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা বখাটেদের পরিচয় অনেক সময় জানা যায় না। ১৩ ও ১৪ মে এদের হামলায় আহত হয়েছে পাঁচ জন। এর আগে এক সাংবাদিকের ওপরেও হামলা হয়েছে। ৩ এপ্রিল প্রথম রোজার রাতে নারায়ণগঞ্জ নগরের জামতলা কেন্দ্রীয় ঈদগাহর সামনে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শরীফ উদ্দিন সবুজের ছেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহমেদ অনন্ত শাহ। ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা হলে পুলিশ তিন কিশোরকে গ্রেফতার করে। তবে দ্রুতই তারা জামিনে মুক্ত হয়।

গত ১৩ মে রাতে নগরের গলাচিপা বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক অগ্রবাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক রশিদ চৌধুরী ও পথচারী মো. জসিম। আহত রশিদ চৌধুরীর ভাষ্য, বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্র হাতে মহড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েক দিন আগে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দুই যুবককে কোপাচ্ছে। সেই ভিডিওর সূত্র ধরে তাদের পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। এর জের ধরে তার ওপর হামলা হয়েছে বলে তার ধারণা।

এদিকে গত ১৪ মে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর থানা এলাকায় ৩টি হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় ২ শিক্ষার্থীসহ ৩ জন আহত হয়েছেন। ১৪ মে মিরাজুল ইসলাম দিপুকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১৫ মে পুলিশ নোয়াস নামে এক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। অন্য ঘটনাগুলোতে কোনো গ্রেফতার নেই।

কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা কী-জানতে চাইলে নারায়ণঞ্জের পুলিশ সুপার মো. জয়েদুল আলম বলেন, অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার মধ্যে ফতুল্লার বোয়ালিয়া খাল এলাকার ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। সব ঘটনাতেই পুলিশের সতর্ক নজরদারি রয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান বিষয়ে কোনো খবর থাকলে তা পুলিশকে অবহিত করতে তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান।

মানবজীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো কৈশোর ও তারুণ্য। এই বয়সের মানুষের মধ্যে থাকে অদম্য প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তি কিশোর ও তরুণদের সতত কিছু করতে উৎসাহী করে তোলে। এ প্রাণশক্তি যদি সঠিক পথে পরিচালিত হয়, তাহলে এরা সমাজে অনেক গঠনমূলক কাজ করতে পারে। লক্ষ্যবিহীন মানবজীবন অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কেউ বলতে পারেন ডাকাত দলের সর্দার হওয়াও তো একটি লক্ষ্য। আমি সেই ধরনের লক্ষ্যের কথা বলছি না। যে লক্ষ্য মানুষকে কল্যাণের পথে ধাবিত করে সে রকমটিই হওয়া উচিত লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্য। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানতে পারলাম, ধারালো অস্ত্র হাতে দলবেঁধে চলা, পথিমধ্যে প্রকাশ্যে কাউকে কুপিয়ে জখম করা তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও তেমন সরব দেখা যায় না। এসব কিশোরের সামাজিক পরিচিতিই হলো এরা অসচ্ছল পরিবার থেকে উঠে এসেছে। যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থায় অসচ্ছলদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই, সেহেতু তারা দৃশ্যমান নয়। তাদের আমরা দৃশ্যমান রূপে দেখতে পাই যখন তারা রাজপথে প্রকাশ্যে কাউকে ধারালো অস্ত্রে দিয়ে কোপাতে থাকে। বন্দুক বা পিস্তল দিয়ে কাউকে হত্যা করা অথবা আহত করতে যে সাহস বা মনের জোর দরকার তার চেয়েও অনেকগুণ বিকৃত সাহসের প্রয়োজন হয় কাউকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে। একজন কিশোর যখন এই কর্মটি করে তার অধঃপতনের ইতিহাসটি অনেক দীর্ঘ হয়ে ওঠে। এ রকম অবস্থায় তাকে শুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন বলতে হয়, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের দেশে কিশোর অপরাধীদের জন্য যে সংশোধনাগার রয়েছে সেগুলো কিশোরদের অপরাধ থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। অনেক সময় দেখা যায়, সংশোধনাগারের জীবন একজন কিশোরকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। কিশোর গ্যাংদের সঠিক পথে নেওয়ার পন্থা গ্রহণের আগে ভালো করে জানতে হবে আলোচ্য কিশোরটি এমন পথে কী জন্য পা বাড়িয়েছে। এটা জানা সম্ভব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষণার মাধ্যমে। আমাদের দেশে উচ্চতর পর্যায়ে সোসিওলোজি পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে।

সেই সময় থেকে আজকের দিনটি পর্যন্ত এদেশে শত সহস সমাজতত্ত্ববিদের সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু অপরাধের সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে তেমন কোনো গবেষণা দেখা যায় না। বিষয়টি নিয়ে যদি ভালো গবেষণা হতো তাহলে অপরাধবিরোধী নীতি-কৌশল গ্রহণ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতো।

কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধ বিজ্ঞানের একটি পৃথক বিভাগ চালু হয়েছে। এই বিভাগ নানা ধরনের অপরাধ সম্পর্কে কোনো গবেষণা করেছে কি? কার্ল মার্কস অপরাধ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, অপরাধ হলো, unorganized protest against exploitation. এই বক্তব্যটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এর যথার্থতা বুঝাতে হলে প্রয়োজন গবেষণা। কিন্তু সেই গবেষণা কে করবে?

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম